আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অণুগল্প:তবু চোখ মানেই নদী

ঘরেও নহে পারেও নহে,যে জন আছে মাঝখানে...............

এখন ভরা বর্ষনের সময়, ভরা ঢল জাগার সময়। তাই যে কেউ, যখন তখন যমুনার ঢেউ দেখতে পাবে, আর নিশ্চিত বলবে যমুনার জলতো ঘোলা। যমুনার পানি ঘোলা, কারণ আছে; সময়-সময় দু’পাশের মাটিকে কণায় কণায় ধুয়ে নিয়ে আসে ; পারলে কখনও ভিটার পর ভিটা, গ্রামের পর গ্রাম। এবং যমুনা চাইলে এর সবই করতে পারে। কিন্তু সব কি আর করতে দেওয়া যায়? নিজেদের বলে যা আছে ,তা বাঁচানোটা সবার আগে জরুরি।

অতএব বাঁধ দেয়া হলো। আমাদের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ। তারপর ধুলা উড়ানো ‘বহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ’। সবার আগে আমার যে প্রশ্ণের উত্তর জানবার ছিল ,যমুনার ভয়ে যে বাঁধের এই মহাসমারোহের সৃষ্টি, তার নাম কেন বহ্মপুত্রের নামে। জানা হয়নি।

কিন্তু বাঁধের প্রসঙ্গকে উপলক্ষ্য করে কিছু গল্প-কাহিনীসুলভ জীবনকে জানার সুযোগ হয়েছিল। আমার দাদীর জীবন নদীর মতো। কখনও এই যমুনার চরের মতো ধু-ধু করে জেগেছে, কোন কোন বারে যখন ডুবেছে মনে হয়েছে মাঠ ডুবলো, পথ তলিয়ে গেলো, ভিটা ভেসে অতল হলো। নদীর স্রোতকে আমার কাছে সংগ্রামের গতির মতো লাগে। সে নিজের পথ তৈরির সংগ্রাম করে, গ্রামের পর গ্রাম কাঁপিয়ে দিয়ে বহু জীবনকে বাঁচায়, মরণাপন্ন করে ।

তবু চলে। দাদীর শৈশব এগারো বছর টিকেছিল। যমুনার বুকে, নৌকা-ভেলায় ওই বালকিা-বঁধু হাসতে হাসতে যেত মায়ের ঘরে। স্বামী-সোহাগী হয়েও, শ্বশুর বাড়িতে যেতে মনে হতো কেউ নেই তার। মাত্র পনরোতে দাঁড়িয়ে প্রথম নাকফুল ছেড়েছিলেন, বিধবা হয়ে মরণের শোক কতখানি বুঝেছেন।

আবার যখন অন্যজনের ঘরে এলেন ,বয়স সতেরো। আমার চল্লিশ পেরোনো দাদাকে দেখলেই যমুনার বুকে নাকি ডুবে মরতে ইচ্ছা করতো। তবু ঘরে মন বসালেন। অভাবের সংসারকে খাঁটি করে তুলতে চাইলেন গৃহিণী হয়ে, মা হয়ে, নদীর মতো নিজের পথ নিজে করে চলার ভান করে। আমার দাদা মারা গেলেন।

বর্ষা মৌসুম। নদীর পানিতে সব ডুবে আছে। কবর দেওয়া নিয়ে আলোচনা চলছিল। দাদীর কাছে জানতে চাওয়া হলো। তিনি কিছুই বললেন না।

পরে বাবা-চাচারা সিদ্ধান্ত নিলেন। উঁচুমতো এক ভিটায় কবরের ব্যবস্থা করা হলো্, কলা গাছ লাগানো ভিটা। দাদী কে এরপর আমরা প্রায়ই দেখতাম কোন একটা কলাগাছে হেলান দিয়ে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে আছেন। নদীর বুকে তরঙ্গ থাকুক বা নাই থাকুক, তখন হয়তো দাদাকে দেখতে না পেয়ে ঘোলা ঢেউয়ের মতো উন্মনা হওয়ার ইচ্ছা করতেন। সারাজীবন যমুনাকে দেখেছেন ,যমুনার গতিকে তুলনা করে জীবনের দর্শন শিখেছেন, ভালোবেসেছেন।

নদীর পানি ঘর থেকে নেমে গেলে খুশি হয়েছেন,তবু নদীকে অভিশাপ মনে হয়নি। কিন্তু আমার মনে হয়। আমি মন থেকেই মনে করি নদী দাদীর জীবনে সীমানাপ্রাচীরের মতো। নদীকেন্দ্রিক জীবনে তিনি শেষবার যখন নদীর দিকে তাকিয়েছিলেন তার চোখমুখে আমি নদী ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা দেখেছিলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তবু নদীর পানির খোঁজ নিতেন।

জানতে চাইতেন বাঁধের কতখানি তলিয়েছে। বাইরে বের হওয়ার উপায় ছিল না। তবু এমন করে নদীর কথা বলতেন যেন উত্তাল যমুনার চেয়ে সুন্দর কিছু তিনি দেখেন নাই। শয্যাশায়ী দাদীকে আমরা জানাইনি, এই যমুনা তখন অনেকটা রাক্ষুসি। দাদার কবর,কলার ভিটা তখন ভাঙছে।

থামানোর উপায় নাই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।