আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বই আলোচনা: ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও বহুজাতিকের স্বপ্নভঙ্গ



ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও বহুজাতিকের স্বপ্নভঙ্গ লেখক। । বিপ্লব দাস প্রকাশক। । জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী প্রকাশকাল।

। ডিসেম্বর ২০০৯ প্রচ্ছদ । । মেহেদী বানু মিতা মূল্য। ।

একশ আশি টাকা ISBN: ৯৭৮-৯৮৪-৩৩-১০১৭-০ বিশ্ব পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন এবং বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের জীবনের শোষণ ও লুণ্ঠন এক সূত্রে গাঁথা। আর এই সূত্রের আক্রান্ত ভূভাগগুলোর মধ্যেই একটি হচ্ছে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী জনপদ। দিনাজপুরের এই ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি পাওয়া গেছে। কয়লার মতো মূল্যবান খনিজ সম্পদ প্রাপ্তির ঘটনা অত্যন্ত সুখকর হওয়ার কথা। কিন্তু নিজ দেশের খনিজ সম্পদের মালিক যারা সেই দেশের নাগরিকদের সে সম্পদের ওপর থেকে অধিকার কেড়ে নেওয়ার ঘটনা তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নতুন নয়।

তাই ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রকল্প বিষয়ে ঐ এলাকার জনগণের মতামত অগ্রাহ্য করা এশিয়া এনার্জির কর্মকাণ্ডকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করায় রাষ্ট্রের জনগণের অর্থে লালিত বিডিআর (বর্তমানে এর নাম পরিবর্তন) বাহিনীর গুলিতে নিঃস্পন্দন হয়ে যায় তিনজন তাজা প্রাণ। এই ‘ফুলবাড়ী বিদ্রোহ’ বর্তমান সময়ে গণমানুষের অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। ‘ ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও বহুজাতিকের স্বপ্নভঙ্গ’ বইটিতে ফুলবাড়ী বিদ্রোহ, জাতীয় সম্পদ রক্ষা এবং তৎসংক্রান্ত বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন লেখক বিপ্লব দাস। পেশায় অধ্যাপক বিপ্লব দাস মানবাধিকার সচেতন, সংস্কৃতিমনস্ক এবঙ গণমানুষের আন্দোলনের কর্মী। তিনি একজন সংগঠকও।

পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়। ‘ ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও বহুজাতিকের স্বপ্নভঙ্গ’ তাঁর প্রথম গ্রন্থ। বইটির প্রথম রচনা ‘বাংলাদেশের কয়লা: প্রকল্পের লাভ-ক্ষতির বিভিন্ন দিক’। বাংলাদেশের কয়লা মজুদ বিষয়ে কিছু তথ্য তিনি প্রথমে তুলে ধরেছেন। দিনাজপুরের ৪৩ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে ফুলবাড়ী উপজেলায় পাওয়া গেছে অতি উন্নতমানেরর কয়লা।

ফুলবাড়ীর সাথে লাগানো নবাবগঞ্জ, পার্বতীপুর ও বিরামপুরে পাওয়া গেছে এই একইমানের কয়লা। এইসব নিয়ে ‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’। এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই লেখক দেখিয়েছেন কী করে এশিয়া এনার্জিম অস্ট্রেলিয়া, এডিবি এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হল। এরপরই লেখক প্রশ্ন তুলেছেন যে ফুলবাড়ী কয়লাখনি আমাদের জন্য উপকার বয়ে আনবে কি না? বাংলাদেশ সরকারের অতি সামান্য ৬% রয়্যালটির বাইরেও সামাজিক, পরিবেশ, কৃষি, পানি সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন যে ভয়াবহ ক্ষতি বয়ে আনবে তা নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন। এর পরিণতি নিয়ে আলোচনা করতে লেখক আরও উল্লেখ করেছেন,“অতিরিক্ত ময়লা আবর্জনা তথা মাটি ফেলার জন্য এক বিরাট এলাকার প্রয়োজন।

হিসেব অনুযায়ী কয়লা ও ময়লা আবর্জনার হার হচ্ছে ২৫:১। অর্থাৎ ১ মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলনের জন্য ২৫ মেট্রিকটন অতিরিক্ত মাটি ও ময়লা সরাতে হবে। ভূ-তলের দূষিত এই অতিরিক্ত মাটি ও ময়লা আবর্জনা ফেলা হবে আশেপাশের নদীতে, কৃষি জমিতে অথবা কোন খোলা জায়গায়। এসব দূষিত আবর্জনা পানিতে মিশে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করে তুলবে নদী ও সমস্ত কৃষি জমি। ফলে যৌক্তিক কারণেই ফুলবাড়ী কয়লাখনি প্রকল্পের বিরোধীতা চলছে।

” (পৃ.২২) ‘আমাদের স্ট্র্যাটিজিক সম্পদ’ রচনাটি আমাদের মূল্যবান খনিজ সম্পদ নিয়ে যে ষড়যস্ত্র চলেছে তা বুঝতে এবং জনগণের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেবে। ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র দাবিগুলো এখানে তুলে ধরা হয়েছে। ‘গণপ্রকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও পনি দারিদ্র্য’ লেখাটিতে অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘পাবলিক গুডস’ বলে সেই জমি, পানি সম্পদ, বনভূমি, তৃণভূমি, জলাভূমি, নদী, উন্মুক্ত জলাশয় যাদের ওপর এদেশের ৮০ভাগ মানুষের জীবন-যাত্রা নির্ভরশীল, সে সম্পদ রক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই বিষয়ে লেখক অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশী বিনিয়োগের বিশেষ বহুজাতিক কোম্পানির বিনিয়োগের বিষয়ে সতর্কতার কথা বলেছেন। ফুলবাড়িতে কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন বা বিতর্ক বারেবারে সামনে আসছে তা হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন।

‘বিভিন্ন দেশে আইন করে নিষিদ্ধ হচ্ছে উন্মুক্ত পদ্ধতি’ প্রতিবেদনটিতে লেখক দেখিয়েছেন যে পরিবেশেরর ভয়াবহ বিপর্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করে কোস্টারিকা, আর্জেন্টিনা, পেরুতে আইন করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি উত্তোলন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি চুক্তি করার পরও কোস্টারিকাতে তা বাতিল হয়েছে, পেরুর জনবসতি, পরিবেশ এবং জীবন-জীবিকার ধ্বংসাত্মক দিকটি বিবেচনা করে স্বর্ণ উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির একটি কানাডীয় প্রকল্প বাতিল হয়েছে। ‘সম্পদ লুণ্ঠন ও জনগণের সংগ্রাম’ ও ‘বিশেষজ্ঞ কথা ও বহুজাতিকের যত হত্যাকাণ্ড’ প্রতিবেদন দু’টিতে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুট করতে সেই রাষ্ট্রগুলোর শাসক শ্রেণী, বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদীদের চরিত্র আর ফুলবাড়িবাসীর দৃঢ়তা ও সচেতনতার কথা খুব সুন্দর ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,“এশিয়া এনার্জি ৫০ হাজার (এই সংখ্যাটি আর বেশি) জনগণকে উচ্ছেদ করে স্বপ্ন দেখাতে চায়, মডেল টাউন আর পরিকল্পিত নগর গড়ে দেবে, জমি কিনে দেবে, কিন্তু কোথায় দেবে তা জানায় না, কোথায় এত জায়গা? হাজার প্রশ্ন জাগে জনগণের, প্রশ্ন করে কোন উত্তর পায় না। তারা পাইপ লাইন দিয়ে পানি সরবরাহ করবে বলেছে।

এ জাতীয় পানি সরবরাহ অবাধ মুক্ত পানি প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হয়ে কোম্পানীর করুণায় আর পরাধীনতায় থাকতে হবে। আমরা জানি এসব কোম্পানী শুরুটা করে স্বপ্নীলভাবে শেষ করবে মহান্ধকার দিয়ে। ফুলবাড়ীর মানুষ বিচ্ছিন্ন ‘মানুষ প্রাণী’ হিসেবে বেঁচে থাকতে চায় না শুধুই ‘মানুষ’ হিসেবে বেঁচে থাকতে চায়। ‘ফুলবাড়ীবাসী একখণ্ড জমিও ছাড়বে না। রক্ত দিয়ে হলেও ফুলবাড়ীকে রক্ষা করবে।

তথাকথিত ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা প্রাচীন জনপদ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করতে দিবো না’- এটাই তাদের অঙ্গীকার। ফুলবাড়িবাসীর এই আন্দোলন-সংগ্রামকে কেবল আবেগ দিয়ে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশের সকল খনি উত্তোলনের কথা ভাবলে ১৫ কোটি মানব সন্তান আর এই মানচিত্রে থাকতে পারবে না। থাকবে শুধু খনিজ সম্পদ উত্তোলনে নিয়োজিত শাসকশ্রেণী ও বহাজাতিক কোম্পানীরা এবং তা লুটাপটির জন্যই। ” (পৃ.৩৭) ‘কয়লা ‘উন্নয়ন’ তত্ত্ব’, ‘বহুজাতিক কোম্পানী: পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ’, ‘আদিবাসী অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘন’ প্রতিবেদন তিনটিতে লেখক দেখিয়েছেন যে উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির নাম করে বহুজাতিক কোম্পানী বিনিয়োগের জন্য যে প্রচারণা চালানো হয় তার পিছনে কী করে লুণ্ঠন চলছে, কী করে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা নিপীড়ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

খুব দৃঢ়তার সাথে লেখক লিখেছেন, “ বিশ্বায়নের ধারায় এটাই (বিদেশী বিনিয়োগ এবং রপ্তানী) এখন সরকার গৃহীত উন্নয়নের ছক, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য লুণ্ঠন। বিনামূল্যে জল, বিনামূল্যে পরিবেশ, সমস্ত জমি, সস্তা জমি, সস্তা শ্রম এগুলো হল বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত। নিজ মূলধন, নিজ প্রযুক্তি এমনকি প্রয়োজনে নিজ কাঁচামাল নিয়ে এরা আসবে, চালাবে নির্বিচারে লুণ্ঠন, ধ্বংস করবে প্রকৃতি, পরিবেশ, জল, বায়ু, মাটি উৎপাদনের সমস্ত-রসদ। শেষে দেশের সার্বিব অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুকে ফেলে চলে যাবে নির্দ্বিধায়। এটা ইতিহাসে প্রমাণিত, প্রমাণিত ব্রাজিল, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও অন্যত্রও।

আসার সময় বিশাল জনগোষ্ঠীকে এরা জীবিকাচ্যুত করে, বাস্তুচ্যুত, নিঃসম্বল করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। যাওয়ার সময় এরা ভেঙে দিয়ে যায় গোটা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশের মেরুদণ্ড যা শুধুমাত্র নিঃসহায়, নিরাশ্রয় মানুষদের নয়, প্রভাবিত করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। এখানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কী ভাবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য স্বার্থ নিজেদের প্রয়োজনে এমন এক একটা প্রকল্প তৃতীয় বিশ্বের সামনে হাজির করে যেখানে বিজ্ঞাপন আর সরকারী প্রচারের আলোকে চাপা পড়ে যায় হানদারদের কদর্য মুখ, লুণ্ঠনকারীদের প্রকৃত পরিকল্পনা। ”(পৃ.৩৯) ‘বিরোধীতার পটভূমি: ঘটনাধারা ও প্রস্তুতি’, ‘জাতীয় কমিটির আন্দোলন: ঘটনাক্রম ও গণঅভ্যুত্থান’, ‘২৬ আগস্ট:অফিস ঘেরাও ও পরবর্তী চার দিন’, ‘ফুলবাড়ী হত্যাকাণ্ড: দেশবাসীল প্রতিক্রিয়া’, ‘পুলিশ-বিডিআরের নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ’, ‘ফুলবাড়ী আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ’, ‘ফুলবাড়ীর সংগ্রাম মৃত্যুর জয়গান,’‘আন্দোলনকারীদের বিরুদ্দে মামলা ও দালাল কথা’, ‘জাতীয় কমিটির আন্দোলন ও বিভিন্ন পর্যায়’, ‘খনিবিরোধী আন্দোলনের সাংগঠনিক কাঠামো ও নেতৃত্ব’, ‘ফুলবাড়ীর সংগ্রাম: রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও সুশীল সমাজ, ‘ছয় দফা সমঝোতা চুক্তি’, ‘বিশেষজ্ঞ কমিটির মূল্যায়ন প্রতিবেদন: প্রস্তাব নাকচ’, ‘অপকর্ম ঢাকতে এশিয়া এনার্জির নাম পরিবর্তন’ প্রতিবেদনগুলোর নামগুলোই এর বিষয়বস্তু সম্বন্ধে ধারণা দেয়। ফুলবাড়ী আন্দোলনের সবিস্তার বর্ণনা, রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালী শক্তির জাতীয় স্বার্থ বিরোধী অবস্থান, বহুজাতিক কোম্পানী ও সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, গণমানুষের জাগরণ, সংগ্রামের উত্তাপ ও আলো এসব বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হয়েছে এই রচনাগুলোতে।

ফুলবাড়ী সংগ্রাম শুধু একটি আঞ্চলিক আন্দোলন নয় একে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ এবং এর পরিসর কেবল বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলের মানুষ বনাম এশিয়া এ্নার্জি হিসেবে না দেখে লেখক আরও বৃহত্তর পরিসরে দেখেছেন, সেই সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় স্বার্থবিরোধী অবন্থানের কথা তিনি বলেছেন। তিনি বলেছেন, “ফুলবাড়ী সংগ্রাম ছিল প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম। কোন বুর্জোয়া সংগঠনের পক্ষে এরকম একটি সংগ্রাম গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়। তাদের দ্বারা জাতীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব নয় কখনই। তাদের প্রধান কাজ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে পাহারা দেয়া আর পাহারা দেয়ার কারণে বখশিস নেয়া।

এরাই দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের প্রধান স্্েরাত। এর বিপরীতে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা অতি সামান্য শক্তিই ধারণ করে। খনি বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাময়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো শেষ পর্যন্ত কোন কাজ করেনি। উল্টো এই দলগুলো জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। সাংগঠনিকভাবে বুর্জোয়া দলগুলো কার্যত ব্যর্থ হয়েছিল।

ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ আন্দোলনে থাকলেও জনগণকে সংগঠিত করতে প্রকাশ্যে কোন কাজ করেনি। কতিপয় চিহ্নিত দালাল এবং বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্ব কেবল বিরোধীই ছিলনা সবরকম ষড়যন্ত্র তারা চালিয়েছিল সংগ্রাম ব্যর্থ করতে। তবে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ আন্দোলনের জন্যে জনগণ ছিল প্রস্তুত। সমাজ ও রাষ্ট্রের নিম্নতম পর্যায় থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত দখল করে আছে এসব সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতিক দুবৃত্তরা।

কয়লাখনি হলে ফুলবাড়ীতে ক’টা বাঁশের সাঁকো উঠবে ও ক’টি ভাঙবে, সেখানে নদী বইবে না নর্দমা বইবে, ফুলবাড়ীর মানুষ মাথা তুলে হাঁটবে না হামাগুড়ি দিয়ে চলবে, না কি খোঁড়াবে, মানুষ মুক্ত থাকবে না শেকলে বাঁধা থাকবে না দঁড়িতে, মানুষ সেখানে সামনে হাঁটবে না পেছনের দিকে গড়াবে, ফুলবাড়ী বন-জঙ্গলে ভরে উঠবে নাকি মরুভূমি হবে সব সিদ্ধান্তই নিয়েছিল ঐ রাজনীতিকরা। আন্দোলন প্রকট আকার ধারণ করলে ফুলবাড়ীর সর্বস্তরের নারী-পুরুষ সম্মিলিত হযে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে বুর্জোয়া বড় দলগুলোরর তথাকথিত বড় নেতাদের কেউ কেউ আন্দোলনে যোগ দেয় এবং নিজেদের দেশপ্রেমিক ও ফুলবাড়ী জনগণের দুর্দিনের বন্ধু প্রমাণের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ফুলবাড়ীর জনগণ ঠিকই বুঝেছিল এ আন্দোলন কারা গড়ে তুলেছিল। জনগণ মনে রাখবে আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস।

”(পৃ.১০৮) ফুলবাড়ীর মাটি লক্ষাধিক বছরের পুরানো এবং এই মাটির বুকে রয়েছে আমাদের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর বসবাসের দৃষ্টান্ত। এর নিকটবর্তী অঞ্চলগুলোতে রয়েছে অনেক প্রতœসম্পদ প্রাপ্তির নিদর্শন। আমাদের সুপ্রাচীন সভ্যতার উদাহরণ হচ্ছে এই অঞ্চল। লেখক এসব কথা আলোচনা করা সাথে সাথে ‘ফুলবাড়ীর ইতিহাস-ঐতিহ্য জনপদ ও প্রতœসম্পদ’ রচনাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী উল্লেখ করেছেন, “বিজ্ঞানীরা বলেন, কয়লাতে ‘সোনা’প্রাপ্তির সম্ভাবনা প্রবল সে কথা একেবারে উড়িয়ে দিলে চলবে না। অতীতের গল্প কথায় সোনা চিত্রিত হয়েছে সকল অনর্থের মূল হিসাবে।

এই সোনার লোভেই স্পেনীয়রা ধ্বংস করেছিল আজটেক আর মায়া সভ্যতা। পৃথিবীর থেকে অনেক জাতির নাম অস্তিত্ব মুছে দিয়ে স্পেনীয়, পর্তুগীজ আর ব্রিটিশ উপনিবেশিকরা জাহাজ ভর্তি সোনা নিয়ে এসেছিল তাদের নিজ নিজ দেশে। এই সোনার অধিকার নিয়েই সংঘটিত হয়েছে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। আমেরিকার সোন দখল নিয়ে ইংল্যান্ড ও স্পেনের যুদ্ধ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সোনা নিয়ে ইংল্যান্ড ও ট্রান্সভ্যালের যুদ্ধ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ”(পৃ.১২৭) বাংলাদেশে স¤প্রতি সময়ের গণমানুষের মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলনগুলোর মাঝে ফুলবাড়ীর আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

লেখক এই আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নভাবে পরিবেশ বাঁচাও, আদিবাসীর অধিকার, সম্পদ রক্ষার আন্দোলন হিসেবে না দেখে একে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখেছেন। বইটির ভাষা অতি প্রাঞ্জল, সরল এবং বাহুল্যবর্জিত। এর রচনাগুলো সহজে পড়া যায়। তবে বইটির মুদ্রণ ত্র“টির বিষয়ে আরেকটু যতœবান হওয়া প্রয়োজন ছিল। কোনো কোনো অঞ্চলের মানুষের সংগ্রামের ঘটনা ধীরে ধীরে পুরো জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রূপান্তরিত হয়, আবার ধীরে ধীরে বিক্ষিপ্তভাবে ঘটে যাওয়া গণজাগরণ ক্রমান্বয়ে বৃহৎ গণবিস্ফোরণের রূপ ধারণ করে এমন উদাহরণ ইতিহাসে আছে।

এই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের জন্য মানুষের গণসংগ্রামের ঘটনাগুলোকে লিপিবদ্ধ করে রাখা খুব প্রয়োজন এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ‘ফুলবাড়ী কয়লাখনি ও বহুজাতিকের স্বপ্নভঙ্গ’ বইটিতে লেখক বিপ্লব দাস সেই সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।