আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প-শেষটুকু-'শ্রাবনের হাওড় বাঁওড়'



বিকেলের রোদটা ক্রমশ ফিকে হযে আসছে । সবাই নৌকায় ঘুমুচ্ছে ,মাঝি দুজন তামাক টানছে । হুক্কার মাথায় থেকে থেকে লাল আগুন জ্বলে উঠছে। এত মনযোগ দিয়ে হুক্কা টানছে দেখে আমারও টানতে ইচ্ছে করছে। ছেলে হলে হয়ত ইচ্ছাটা পোষে রাখতাম না ।

কি আর করা?পানির দিকে তাকিয়ে তল দেখার চেষ্টা করছি । স্বচ্ছ পানির নীচে প্রত্যেকটা ঘাস আর শ্যাওলা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটা মাছ লাফ দিয়ে পানির উপরে উঠে আসছে আবার ডুবে যাচ্ছে। -শ্রাবণ,ভেতরে আস। সন্ধা লেগেছে আর বাহিরে থাকে না।

-আর একটু থাকি মা। আকাশটা কেমন বিষন্ন মনে হচ্ছে,হয়ত আমার মনটাই বিষন্ন লাগছে তাই আকাশটাকে এমন দেখাচ্ছে। -ভিতরে আইয়্যাপর অহন আর বাইরে থাহন লাগদ না । জ্বীন-ভূত নামে আওড়ে সন্ধ্যা বেলা । -আসছি নানু।

-একটু হুইত্যা থাক ভালা লাগবোনে। হারাডা দিন খালি তাইতুই করছস। আমরা ঘুমাইছি অতক্ষন অহন তুই একটু ঘুমা । নাও মাত্র মদন ছাড়াইছে আরো ৩-৪ ঘন্টা লাগবো। এবার হাতেমের উদ্দেশ্য নানা বলছে -ভালা কইরে দেইখ্যা নাও চালাইস,কানাওয়ালা ধরব।

-আইচ্ছে,ভাইসাব আপনে কোন চিন্তা করইন্না যে। আমরা ঠিকমতই চালাইবাম। একটু শোয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই মাথা সহ সারা গা দোলে । কেমন করে ঘুমাচ্ছিল ওরা?হয়ত তাদের কাছে এমনটা লাগেনি। উঠে বসলাম ,তারপর -নানু!কানাওয়ালা কি ? -রাইতের বেলা বদ জ্বীন নামে।

হেরা মাঝিরারে ভুল পথ দেহায়। তহন আর নিজের বাড়িত যাওনের রাস্তা পাওয়ন যায় না। হের লাইগ্যা রাইত হইলে কইলমা-কালাম ফড়ন লাগে বেশী কইরা। মনি ভয়ে অস্থির । নানু ভয়ের জন্য সুরা পড়ে মনিকে ফুঁ দিচ্ছে।

আর মা নানুকে বকা দিয়েছে কেন এই সব এখন বলল। -আওড়ের বেকতাই জানা থাহা ভাল । এরার অভিঙ্গতা লাগদোনা ? -সাথে কেউ না কেউতো থাকবেই ,ওরা কি একা আসবে কখনো তোমার হাওড়ের দেশে? -'তোমার হাওড়ের দেশে' এইডার মানে কিতা?আওড়ের দেশটা তর নিজের না ?বিয়া অইছে আর বেকতা তর পর অইয়্যা গেছে। নানুর মেজাজ ভীষন খারাপ । মা সুর বদলে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

নৌকা চলছে কদমশ্রীর হাওড়ে । দূর থেকে পর পর এক একটা গ্রাম দেখা যাচ্ছে। কুপি বাতির ডিমডিম আলো জ্বলছে প্রতিটা গ্রামের বুক জুড়ে। মনে হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠে নতুন কোন তারা রাজির মেলা বসেছে। চারিদিকে পানির আকাশ মাঝখানে ভূ-পৃষ্ঠের তারারা।

একটা কবিতা লিখতে পারলে ভাল হত। কিন্তু খাতা কলম ছাড়া বেশী দূর এগোবে না । তবুও চেষ্টা--- ' ভূ-পৃষ্ঠে তারা জ্বলে আমার হাওড়,ভাটির দেশে , পানিগুলি আকাশ হলে ঢেউ উঠে গা ঘেষে। ' -[মাঝিদের একজন]আম্মারা আফনেরা রেডি অউহাইন আমরা আইয়্যা পড়ছি। ঐ যে ঘাটটা দেহা যাইতাছে।

-হ্যাঁ !সবাই গুছিয়ে নাউ। মার মুখটা এখনই কান্নাকাটির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঘাটে নানুরা দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েকে বরণ করার জন্য । আর গলা জরিয়ে ধরে কান্নাকাটি হবে। এই কান্নাকাটির মানেটা হল -'অত দিন পরে আমরার কথা মন অইছে বেডি তর।

অত পাষান অইচছ ঢাহা গিয়া'। আবার যাওয়ার সময়ও এমনটি হবে তখন কারন থাকবে-'আবার কোনদিন দেহা অইব কেলা জানে। তাড়াতাড়িই হিরা আইচ নাতিডিরে লইয়্যা'। অবশ্য ওদের কান্নাকাটির দৃশ্যে শ্রাবণের মনটাও খারাপ হয় । মণি আর শুভটা হাসে ,বাসায় ফিরে ওদের কথাগুলি সুর করে কান্নার ছলে বলেবলে মাকে রাগাতে চায়।

মেঝ মামা করোটিয়া সাদত বিশ্বঃ কলেজে পড়ে। বাড়িতে ঢুকে দেখি মামাকে । ভীষন খুশি লাগছে । কারণতো একটা আছে!মামার মাছ ধরার নেশা। সেই কি বড় বড় মাছ।

কখনো ধরতে যাইনি তার সাথে। তবে এবার যাবই। ঘরের এক কোনে কাজের মহিলা দুজন কাহাইলে পিঠার গুড়ি কুঁটছে। মেহমান এলে এই আয়োজনটা দেখতে আমার ভালো লাগে । যদিও পিঠা আমার খুব পছন্দের না।

তবু নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মেহমান ভাবা যায়। কাল থেকে দেখা যাবে আরো আয়োজন। বড় বড় মাছের বেপারিকে খবর দেয়া হবে মাছ নিয়ে আসতে। গীত শুনতে আমি পছন্দ করি বলে খুদবানুর মাকে খবর দিবে নানু । সে এসে বিকেলে গীত শুনিয়ে যাবে যতদিন থাকি।

আর যাবার সময় নানু খুঁচিতে মেপে চাল দিয়ে দিবে সাথে কিছু আরো। তাতেই সে মহা খুশি। মামাকে অনেক কষ্টে রাজি করা হলো মাছ ধরতে যাবার সময় আমাকে সাথে নেবে । আয়োজন চলছে সন্ধা থেকে। কেউ হ্যাজাক লাইটে তেল ভরে ঠিকঠাক করছে,কেউ কোন কোন টেঁটা নেয়া হবে পরীক্ষা করছে।

হ্যাজাক লাইটে পাম্প দেয়া হচ্ছে অনেক্ষন ধরে, ঠিক হচ্ছে না । শংকা লাগছে যদি ঠিক না হয়তো যাওয়া বন্ধ। ঘন্টাখানেক পর আমরা রওনা হলাম। সাথে বাড়তি আর একটি নৌকা। হাওড়ের দিকে যাচ্ছে নৌকা।

লাইটের আলোতে পানির ভীতরকার সব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে । কোন শব্দ করা নিষেধ। শব্দ হলে মাছেরা পালিয়ে যায়। কথা বলা হচ্ছে ফিসফিস করে। পানির নীচে বড় একটা রুই মাছ মুখটা আধোআধো খুলে ধীরে চলছে।

মামা অতি সতর্কতার সাথে টেঁটা ছুড়ে মাছটার গায়ে ফুটিয়ে দিল। সাথে সাথেই দুজন লাফ দিয়ে মাছটাকে ঝাপটে ধরে পানি থেকে টেনেহিঁছরে নৌকায় উঠাল। এমনি চলতে লাগলো । মামা এক করে ছোট বড় অনেক ধরনের মাছ মারল। এদিকে ফজরের আজান শুনা যাচ্ছে পাশের গ্রামের মসজিদ থেকে।

এতক্ষন কত সময় চলে গেছে কেউ বুঝতেও পারেনি । বাড়ি ফিরে সবাই যেযার মতন ঘুমুতে গেলাম। শ্রাবণ এখন আর ছোট্টটি নেই। সে এখন শুধু সেই দিনগুলোর কথা ভাবতে পারে। যখন একলা বসে থাকে ।

কেউ থাকে না চারদিকটায় । ছুঁয়ে দেখতে পারে না আগের মতন করে। ফিরে যেতে ইচ্ছে করেছে বহুবার সেই হাওড়,সেই নৌকো,সেই পানির কলকল ডাকের কাছে। পারেনি আর। কখনো পারবে কিনা জানে না।

বদলেছে দিন,অনেক বছর,তার জীবন ,গাঁয়ের ধরন। সবেতেই পরিবর্তন এসেছে। তবুও মাঝে মাঝে একান্ত নিজের মতো করে সেই দিনগুলির কথা ভাবে। হারিয়ে যায় স্মৃতির কাছে । তখন মনটা ভার হয়ে যায় অজান্তেই।

শ্রাবণ ফিরে যেতে চায় তেমন করেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।