আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওই মাংস না খাইলে পাগল অইয়া যাইমু



১৯৭৫ সালের তোলপাড় করা নরমাংস খাওয়ার ঘটনা সারা দেশে লোকমুখে ফিরতে ফিরতে একসময় পর্দার আড়ালে চলে যায়। মানসিক চিকিৎসার জন্য খলিলুল্লাহকে পাবনা পাঠানোর মাধ্যমে ঘটনাটি মিলিয়ে যেতে থাকে। তবে যারাই ঘটনাটি শুনেছে, তাদের মনে তা বিভীষিকার সূচনা করেছে। ১৯৯৭ সালের দিকে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে প্রতিবেদকের সঙ্গে নরমাংসখেকো খলিলুল্লাহর সাক্ষাৎ মেলে আজিমপুর কবরস্থানের গেটে। লম্বা, বয়সের ভারে কিছুটা কুঁজো, চাপ দাড়িওয়ালা, লুঙ্গি-শার্ট পরা খলিলুল্লাহ নিজেকে সুস্থ দাবি করে।

তবে সুস্থ হলে এখনো কেন কবরস্থানের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়, এ প্রশ্নের জবাবে সে বলে_তার কোনো আত্দীয়স্বজন বা জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সন্ধান জানে না। কেউ তার খোঁজ নিতেও আসেনি। যার কারণে কবরস্থানের এখানে-সেখানে সে ঘুরে বেড়ায়। মানুষ তার পরিচয় পেয়ে দুই-চার টাকা সাহায্য দেয়। তা দিয়ে তার পেট চলে যায়।

রাতে কবরস্থানের বাইরে কোনো জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ে। মানুষের মাংস ও কলিজা খাওয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে খলিলুল্লাহ প্রথমে কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। পরে তাকে পেটপুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে বেশ কাজ হয়। অনর্গল বলে যায় পুরনো দিনের কথা।

তবে কেন সে নরমাংস খেত, তা ঠিকমতো বলতে পারেনি। হঠাৎ মাথায় গণ্ডগোল হলে সে কী করত তা নিজেই অনুভব করতে পারত না। তবে খলিলুল্লাহ প্রতিবেদকের কাছে আরো জানায়, পাবনা মানসিক হাসপাতালের চিকিৎসায় সে ভালো হয়ে যায়; কিন্তু কলিজাখেকো বলে কেউ তাকে কাজ কিংবা আশ্রয় দেয়নি। অনেকে শারীরিকভাবে আঘাতও করেছে। যার জন্য শুধু বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে কবরস্থানকে বেছে নিয়েছে।

তবে মরা মানুষের মাংসের লোভে নয়, শুধু নিজেকে সমাজ থেকে দূরে রাখার জন্য। যদি মানুষের মাংস খাওয়ার জন্যই কবরস্থানে আসি, তাহলে তো কবরস্থান কর্তৃপক্ষ অনেক আগেই তাড়িয়ে দিত বলে সে দাবি করে। তবে দৈনিক বাংলা কিংবা বিচিত্রায় তাকে নিয়ে যখন কভার স্টোরি করা হয়, তখন সে ছিল উন্মাদ। প্রতিবেদক আরিফুর রহমান যখন খলিলুল্লাহকে বললেন তাকে বেশি বেশি লাশ খেতে দেওয়া হবে, তখন সে লাফ দিয়ে উঠে বলেছিল, ‘স্যার, আমাকে লাশ খেতে দেবেন?’ হা হা বলে একটা অট্টহাসিও দিয়েছিল। এরপর প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাব দেয়_ প্রশ্ন : এখন বল তুই সত্যিই লাশ খাস? উত্তর : হ, খাই।

প্রশ্ন : কেন খাস? উত্তর : ভালো লাগে। প্রশ্ন : না খাইয়া থাকতে পারস না? উত্তর : ওই মাংস না খাইলে পাগল অইয়া যাইমু। প্রশ্ন : শোন। কয়দিন পর পর খাস? উত্তর : দুই হ্না। আঙুল দিয়ে দুই দেখাল।

প্রশ্ন : কয়দিন আগে খাইছিস? উত্তর : পরশু দিন। একটা মাইয়া খাইছি। কইলজা স্যার। মুখে হাসি। তেল ভি খাইতে পারি।

প্রশ্ন : কি খাইতে ভালো লাগে, কইলজা না তেল? উত্তর : এইখানের মাংস। হাত দিয়ে ঊরু দেখাল। প্রশ্ন : শোন, আর মাংস খাবি না বুঝলি। আর খাবি? উত্তর : খামু। প্রশ্ন : কেন, তোর খারাপ লাগে না? গন্ধ আসে না? উত্তর : হা হা, ভালো লাগে।

এরপর প্রতিবেদক ইয়ার্কি করে বললেন, তুই যে মানুষের মাংস খাস তা কি বাস্তবে দেখাতে পারবি? সঙ্গে সঙ্গে খলিলুল্লাহ মর্গের ভেতরে ঢুকে ছুরি দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে আসে। সঙ্গে কলিজার টুকরো। তার সামনেই পৈশাচিকভাবে কলিজার টুকরো কচকচিয়ে খেতে লাগল। এরপর প্রতিবেদক খলিলুল্লাহকে ডেকে ২০ টাকা দিলেন, যাতে ঘটনাটি অন্য কোনো সাংবাদিককে না বলে। তবে খলিলুল্লাহর শর্ত ছিল একটাই_সাংবাদিককে মর্গের ডোম রবিকে বলে দিতে হবে তাকে যেন মরা মানুষের কলিজা বেশি খেতে দেয়।

এ প্রতিবেদক ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে খলিলুল্লাহকে পেয়ে পুরনো ঘটনার অবতারণা করলে তার চোখ চঞ্চল হয়ে ওঠে। অতৃপ্ত মনের নরমাংস খাওয়ার নেশা যেন চোখেমুখে প্রকাশ পায়। পুরনো অভ্যাসটা এখনো ভুলতে পারেনি। তবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়। বলে, স্যার অতীতকে ভুলতে চাই।

সভ্য হয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাঁচতে চাই। খলিলুল্লাহ যেভাবে কলিজাখেকো হলো! দৈনিক বাংলায় সংবাদটি ছাপা হওয়ার পর গণমাধ্যমে রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। কিছুদিনের জন্য খলিলুল্লাহ হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তি। এক কাঠি ক্যাপস্টেন সিগারেট পেলে যে খলিলুল্লাহ খুশিতে আটখানা হয়ে যেত, তাকে খুশি করার জন্য ট্রিপল ফাইভ আর বেনসন অ্যান্ড হেজেজের কার্টন আসতে থাকে। বিনিময়ে দরকার সাক্ষাৎকার।

কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমকে সে সুযোগটা বেশিক্ষণ দিতে রাজি হয়নি। সকালের দিকে খলিলুল্লাহ নরমাংসের নেশায় মর্গে আসতেই হাসপাতাল কর্মচারীরা তাকে ধরে ফেলেন। তারপর তাকে হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক কর্নেল এম এল রহমানের কক্ষে হাজির করা হয়। কর্নেল সাহেব ডেকে পাঠান কলেজের অধ্যক্ষ ডা. এম এ জলিল, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সামাদসহ আরো কয়েকজন মানসিক বিশেষজ্ঞকে। তাঁরা খলিলুল্লাহকে অভয় দিয়ে ঘটনা খুলে বলতে বললে অনেক চাঞ্চল্যকর কাহিনী বেরিয়ে আসে।

তা তার জবানবন্দিতেই জানা যাক। রবি ডোম আর খলিলুল্লাহ ছোটবেলায় বন্ধু ছিল। তখন সে লালবাগ এলাকায় থাকত। সেখান থেকে প্রতিদিন হেঁটেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের মর্গে আসত। রবি ডোমের বাবা ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রথম ডোম।

সে-ই খলিলুল্লাহ ও রবি ডোমকে প্রথম মরা মানুষের মাংস খেতে দিত। পরে রবি ডোম নরমাংস খাওয়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু খলিলুল্লাহ তা ছাড়তে পারেনি। অন্তত ১৫ দিন পর পর তার নরমাংস চাই। শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ নয়, মিটফোর্ড হাসপাতালের গোপাল ডোম ও সোনা ডোম তাকে মরা মানুষের মাংস খেতে দেয়।

নরমাংস ছাড়াও লাশের কাফনের কাপড় চুরি করা তার নেশা। ঢাকার বিভিন্ন কবরস্থান থেকে কবর খুঁড়ে কাপড় এনে তা মৌলভীবাজারের কাছাকাছি পুরনো কাপড়ের দোকানে বিক্রি করত। কাপড় বিক্রির টাকা দিয়ে স্বাভাবিক খাবার খেত। খলিলুল্লাহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আরো বলেছে, সে তার খালা মমিনাকে মানুষের মাংস খাসির মাংস বলে রান্না করে খাইয়েছে। এসব তথ্য শুনে কর্তৃপক্ষ রীতিমতো হতবাক হয়ে যায়।

এরপর তাৎক্ষণিক পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে মুরগির কাঁচা মাংস এনে দেওয়া হয় তাকে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে মুরগির কাঁচা মাংস চার ডাক্তারের সামনেই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, খলিলুল্লাহকে আর জনসমক্ষে রাখা যায় না। পরে সে জ্যান্ত মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে_এ আশঙ্কায় পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ এসে খলিলুল্লাহকে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে রমনা থানায় নিয়ে যায়।

শুরু হয় নতুন করে পুলিশি জেরা। কিন্তু পুলিশকে বোকা বানিয়ে খলিলুল্লাহ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করে_সে মানুষের মাংস খায়, ভবিষ্যতেও খাবে। এ ঘোষণার ভেতর দিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়, খলিলুল্লাহ কোনো দাগি ক্রিমিনাল নয়, একজন জটিল মানসিক রোগী। মানসিক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে ঢাকার আদালতে পাঠানো হয়। সবকিছু শুনে বিচারক খলিলুল্লাহকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর নির্দেশ দেন।

স্বঘোষিত ও প্রমাণিত নরমাংসসেবী খলিলুল্লাহর আত্দপরিচয় সম্পর্কে অনেক খোঁজখবর নিয়েও কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে দৈনিক বাংলার মেডিক্যাল কলেজ প্রতিনিধি আরিফুর রহমানের কাছে সে স্বীকার করেছে, তার গ্রামের বাড়ি নরসিংদী এলাকায়। বাবার নাম আব্দুল মান্নান। গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে বিভিন্ন বাসায় চাকরের কাজ করত। কিন্তু বাসায় কাজ করতে গিয়ে মনিবের প্রহারে তার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দেয়।

এর পরের ঘটনা তার মনে নেই। খলিলুল্লাহর শেষ জীবন কেটেছে আজিমপুর কবরস্থানের আশপাশে আজিমপুর পুরনো কবরস্থানের গেটের ভেতরে যেতেই বর্ষীয়ান খাদেম নাজেমের সঙ্গে দেখা। তিনি এখানে ৩০ বছর ধরে মুর্দারের দাফন-কাফনের কাজ করছেন। খাদেম নাজেম নামেই তাঁকে সবাই চেনে। নরমাংসখেকো খলিলুল্লাহর কথা বলতেই তিনি মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, খইল্লা পাগলার কথা বলছেন তো? শেষ জীবনের বছরগুলো কেটেছে এ কবরস্থানের গেটেই।

লম্বা কিছুটা কুঁজো মানুষটি সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকত। বিকেলে কবরস্থানের দিকে শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। লাশ দাফন কিংবা কবর জিয়ারত করতে আসা লোকজনের ভিক্ষায় তার পেট চলত; কিন্তু সে তো চার থেকে পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। বৃদ্ধা মরিয়ম বিবি, ৩৫ বছর ধরে কবরস্থানের ফটকে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। খলিলুল্লাহর সঙ্গে তাঁর বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানান তিনি।

তাঁর দেওয়া তথ্য হলো_খলিলুল্লাহ পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ঢাকায় আসে; কিন্তু মানুষের মাংস খাওয়ার অপবাদ তার কপাল থেকে যায়নি। কোথাও গেলে তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতো। মহল্লার লোকজন ইট দিয়ে তাকে আঘাত করত। ঘৃণায় তাকে কেউ কাজ দিত না। যার কারণে আজিমপুর করবস্থানের গেটে বসে সে ভিক্ষা করত।

সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়েই সে কবরস্থানের ভিক্ষুকদের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। আজিমপুরের আদি বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, চার থেকে পাঁচ বছর আগেও লম্বামতো একটি লোক খালি পায়ে মহল্লার এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। মানুষের কাছে হাত পেতে খাবার সংগ্রহ করত। পরে জেনেছি সে নর মাংসখেকো খলিলুল্লাহ; কিন্তু সব সময় চুপচাপ বসে সে যেন কী ভাবত। কাউকে ধমক দেওয়া কিংবা গালি দেওয়ার কথা শোনা যায়নি।

তবে তার চোখমুখের দিকে তাকালে বোঝা যেত, একসময় মানুষটি হিংস্র ছিল। চোখের ভাষায় বলে দিত তার পক্ষে লাশ খাওয়া অসম্ভব ছিল না। কবরস্থানে কর্তব্যরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবার কাছে সে খইল্লা পাগলা নামে পরিচিত ছিল। তবে কখনো তাকে পাগলামি করতে দেখা যায়নি। গেট পেরিয়ে কবরস্থানে তাকে কখনো ঢুকতেও দেওয়া হয়নি।

এমনকি সেও কখনো কবরস্থানের ভেতরে ঢোকার আবদার করেনি। খলিলুল্লাহর সঙ্গে বসে ভিক্ষা করত নইমুদ্দিন, সাফিয়া, পুতলিসহ আরো অনেকে। তারা জানায়, খইল্লা পাগলার নাম শুনে সবাই আঁতকে উঠত; কিন্তু একসময় মনে হলো মাংসখেকো খলিলুল্লাহর মৃত্যু হয়ে গেছে। এখন সে খলিলুল্লাহকে দেখা যায় সাদাসিধে নরম মনের মানুষ। তাই কবরস্থানের সবাই তাকে আদর করে ডাকত ‘খইল্লা পাগলা’ বলে।

কয়েক বছর আগে মারা গেলেও কবরস্থানের মানুষের মন থেকে সে হারিয়ে যায়নি। এখনো তারা ভিক্ষুক খলিলুল্লাহকে মনে রেখেছে। কথা উঠতেই তারা খইল্লা পাগলার স্মৃতিচারণে মেতে ওঠে বলে জানান কবরস্থানের পাশের পান দোকানি স্বপন। তার মতে, একসময় কলিজাখেকো খলিলুল্লাহকে নিয়ে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল; কিন্তু শেষ জীবনে সে মানুষটি সম্পূর্ণ ভালো মানুষ হয়ে গিয়েছিল। বউ-বাচ্চা নিয়ে সুন্দরভাবে সে সংসারকর্ম করত।

কবরস্থানের পাশের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব ইমাম হোসেন বলেন, খলিলুল্লাকে পত্রপত্রিকায় যেভাবে উপস্থাপন করেছিল, বাস্তবে তাকে সে রকম মনে হয়নি। জীবনের শেষ সময়ে এখানেই কেটে গেছে তার। কখনো মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে দেখেনি কেউ। কয়েকবার ভিক্ষা চেয়ে না পেলে চুপচাপ থাকত। জিদনী রহমান বলেন, খলিল পাগলা মারা যাওয়ার এক বছর আগেও আমার নানার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাসায় এনে খাওয়ানো হয়েছে।

প্রতিবারই ভিক্ষুকদের খাওয়ানো হলে সে অবশ্যই উপস্থিত থাকত। কবর খননের কাজ করেন আল আমিন। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে খলিল পাগলাকে দেখতাম কবরস্থানের ভেতরে প্রবেশ করে হাঁটাহাঁটি করতে। তাকে দেখলে মনে হতো, কী যেন সব সময় ভাবত। খলিল পাগল নামে সবাই চিনে থাকলেও তার মধ্যে কোনো পাগলামি লক্ষ করা যায়নি।

এখানের এক ভিক্ষুক মহিলাকে বিয়ে করে সে। যেভাবে খলিলুল্লাহর নাম ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে অবাধে ঘুরে বেড়াত খলিলুল্লাহ। মাঝেমধ্যে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গেও যেত। মরা মানুষের পোস্টমর্টেম হওয়ার পর কাটাছেঁড়া নরমাংস কিংবা কলিজা খেয়ে তৃপ্তি পেত সে। মর্গের ডোমরা লাশ থেকে বিশেষ মাংস কেটে দিতেন খলিলুল্লাহর হাতে।

এ চাঞ্চল্যকর ঘটনা মেডিক্যালের দুই-চারজন কর্মচারী জানলেও পাগল বলে ঘটনাটির পাত্তা দিতেন না তাঁরা। পরে সংবাদ মাধ্যমে ঘটনাটি এলে সারা দেশে তা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। গ্রেপ্তার হয়ে খলিলুল্লাহ পাবনা পাগলা গারদে অন্তরীণ হয়। সেখানে চিকিৎসা শেষে আবার ফিরে আসে ঢাকায়। তবে এবার মর্গে নয়, সে ঠাঁই করে নেয় আজিমপুর কবরস্থানে।

কবরস্থানের ফটকে ভিক্ষাবৃত্তিকে জীবিকা হিসেবে বেছে নেয়। সেখানেই তার শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। যেভাবে খলিলুল্লাহর নাম ছড়িয়ে পড়ে ১৯৭৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন আরিফুর রহমান। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও মাথায় ঘুরত লেখালেখির পোকা। সেই সুবাদে দৈনিক বাংলার মেডিক্যাল রিপোর্টার হয়ে হাসপাতালের প্রতিটি কক্ষ, বারান্দা, অলিগলি, বিভাগ ও মাঠঘাট চষে বেড়াতেন তিনি।

তখন জানতে পারেন, মেডিক্যালের মর্গে গভীর রাতে ভূতের আনাগোনা হয়। প্রথম প্রথম তিনি বিষয়টি আজগুবি হিসেবে উড়িয়ে দেন। কিন্তু পরে মেডিক্যালের দু-একজন ব্যাপারটি সত্য বলে জানান। তাই অনেকটা কৌতূহলবশত এ ভূতের সন্ধান করতে গিয়েই আরিফুর রহমান পেয়ে যান এক অবিশ্বাস্য ও শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী; যা শুনে ভূতেরাও পালিয়ে যাওয়ার জোগাড়। জলজ্যান্ত এক মানুষ লাশঘরে এসে চুপিচুপি মরা মানুষের কলিজা খেয়ে চলে যায়।

নাম খলিলুল্লাহ। তার এ লোমহর্ষক ঘটনা ডোম শংকর ও রমেশের চোখে পড়লেও তাঁরা এড়িয়ে যান। মর্গে কত মানুষই তো আসে। কত রকম ধান্ধা করে তারা। খলিলুল্লাহ না হয় মরা মানুষের কলিজা খায়।

ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারীদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে তিনি প্রমাণ পান খলিলুল্লাহ মরা মানুষের মাংস খায়। বিশেষ করে কলিজা খেতে তার বেশি পছন্দ। এ চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি অনুসন্ধানে নামেন তৎকালীন দৈনিক বাংলার এ তরুণ সাংবাদিক। কথা বলেন সবার সঙ্গে, এমনকি খলিলুল্লাহর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি তৈরি করেন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন।

সেই প্রতিবেদনে খলিলুল্লাহর মাংস ভক্ষণরত ছবি যুক্ত হয়, তা ১৯৭৫ সালের ৪ এপ্রিল সংখ্যা দৈনিক বাংলায় ছাপা হয়। দৈনিক বাংলার সহযোগী ম্যাগাজিন সাপ্তাহিক বিচিত্রার ১৮ এপ্রিল, ১৯৭৫ সংখ্যায় প্রচ্ছদ হিসেবে এ কাহিনী ছাপা হলে সারা দেশে হইচই পড়ে যায়। লোকমুখে ফিরতে থাকে খলিলুল্লাহর অবিশ্বাস্য এ কীর্তি। কলিজাখেকো খলিলুল্লাহ বিভিন্ন ধাঁধা ও গ্রাম্য কবিতায় স্থান করে নেয়। ষাটোর্ধ্ব দেলোয়ার হোসেন প্রতিবেদককে তৎকালীন খলিলুল্লাহকে নিয়ে ঢাকা শহরে কী চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল, তার একটি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।

তিনি তখন একজন যুবক। সারা দেশে খলিলুল্লাহকে নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে তিনিও তাকে একনজর দেখার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে ছুটে গিয়েছিলেন। সেখানে তখন হাজার হাজার মানুষের ঢল নেমেছিল। অনেক চেষ্টা করে তিনি মেডিক্যাল কলেজের অভ্যন্তরে ঢুকে তাকে একনজর দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। তাঁর এক চাচা তখন সেখানে ব্রাদারের চাকরি করতেন।

এই চাচার সাহায্যে মেডিক্যালের ভেতরে ঢুকেছিলেন। তখন খলিলুল্লাহকে আটক করে মেডিক্যালের অধ্যক্ষের কক্ষে আনা হয়েছিল। সেই সময় দেলোয়ার হোসেন তাকে একনজর দেখেছিলেন। সেই যুবক দেলোয়ার এখন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তিনি বলেন, তখন খলিলুল্লাহ উপস্থিত চিকিৎসকদের সামনেই কচকচ করে মুরগির মাংস খেয়ে দেখায় সে কিভাবে মানুষের কলিজা কিংবা মাংস খেত।

সেই স্মৃতি মনে হলে এখনো তিনি আঁতকে ওঠেন। তিনি আরো জানান, তখন তাকে একনজর দেখার জন্য সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সংবাদকর্মীদের ভিড় লেগে গিয়েছিল। মেডিক্যাল থেকে তাকে প্রথমে রমনা থানায় নেওয়া হয়। থানা থেকে ঢাকা কোর্টের মাধ্যমে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর পরও খলিলুল্লাহকে নিয়ে প্রতিদিন সারা দেশে চায়ের টেবিলে আলোচনার ঝড় উঠতে থাকে।

অনেক দিন ধরে পত্র-পত্রিকার পাতায় তাকে নিয়ে বিভিন্ন কাহিনী ছাপা হতে থাকে। সন্তানদের চোখে খলিলুল্লাহ ছিল আদর্শ বাবা মানুষের মাংসখেকো খলিলুল্লাহর মৃত্যু হয় ২০০৫ সালের দিকে। মৃত্যুর আগে তার জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। কয়েক বছর নানা রোগে ভুগে অনেকটা বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। তার ছেলে রমজান আলী জানায়, টাকার অভাবে বাবার চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি।

মুখে পানি এসে হাত-পা ফুলে গিয়ে মারা যান। তবে চিকিৎসার খরচের জন্য দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। কেউ কেউ খলিলুল্লাহর সন্তান বলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। খলিলুল্লাহর স্ত্রী নুরজাহান বেগম অনেক কষ্ট স্বীকার করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর পাশে ছিলেন। তিনি জানান, খলিলুল্লাহর স্ত্রী বলে কত লাঞ্ছনা-গঞ্জনা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে তার কোনো শেষ নেই।

সাহায্য চাইতে গেলে অনেকে গলাধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। খলিলুল্লাহকে মানুষখেকো হিসেবে লোকজন ধিক্কার দিলেও সে যে কত ভালো মানুষ ছিল স্ত্রী হিসেবে আমার চেয়ে আর কেউ ভালো জানত না। তার মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর সে কী করেছে তা তার মনে ছিল না। তবে সুস্থ হয়ে ওঠার পর সে একজন সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হয়ে গিয়েছিল। সন্তানদের সে খুব আদর করত।

খলিলুল্লাহর সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল নুরজাহানের, সেদিনের কথা স্মরণ করতেই গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে তাঁর দু-চোখ বেয়ে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছেই বলেন, প্রথম যখন দেখি তখন তার আচরণ ছিল শিশুর মতো। খুবই নরম মনের মানুষ ছিল। পাবনা থেকে চিকিৎসা নিয়ে ভালো হওয়ার পরই আজিমপুর কবরস্থানের আশপাশে ঘুরতে থাকে। ভালো হওয়ার আগে মানুষের মাংস খাওয়ার অপরাধে কেউ তাকে দেখতে পারত না।

একদিন দেখি সারা দিন না খেয়ে ক্ষুধায় কাঁপছে। কিছু বলছে না। তখন আমিই তাকে দোকান থেকে রুটি কিনে দিই। প্রথমে খেতে চায়নি, আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে ওই খাবার খায়। সেই থেকে আমাকে দেখলেই কাছে আসত।

অল্প কথা বলত। এভাবেই একসময় তার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি এবং পরে বিয়ে হয়। নুরজাহান বেগমও বর্তমানে বৃদ্ধ। তাঁর দুই ছেলে রমজান আলী ও রাজ্জাক হোসেন ছোটখাটো কাজ করে কোনোরকম সংসার চালাচ্ছে। কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলবাগের এক বস্তিতে মাত্র এক হাজার ৫০০ টাকা ভাড়ায় বসবাস করছে।

বছরের অধিকাংশ সময় নুরজাহান বেগম অসুস্থ থাকেন। তবে তিনি কারো কাছে নিজেকে খলিলুল্লাহর স্ত্রী বলে পরিচয় দিতে পারেন না। দিলে মানুষখেকোর বউ বলে লোকজন হেয় চোখে দেখে। তিনি বলেন, আজিমপুর কবরস্থানের মানুষগুলোর ভালোবাসায় খলিলুল্লাহ সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পেরেছিল। তা না হলে সে আবার অসুস্থ মানুষ হিসেবে আগের জীবনে ফিরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

আজিমপুর কবরস্থানের পাশে একটি গাড়ি ভাড়া দেওয়ার দোকানে খলিলুল্লাহর ছেলে রমজান কাজ করে। তার সঙ্গে প্রতিবেদকের একাধিক দিন কথা হয়। সে জানায়, অধিকাংশ মানুষ খলিলুল্লাহর সন্তান বলে তাদের হেয় চোখে দেখে। তবে কেউ আবার সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দেয়। ডেকে নিয়ে তাদের কাজ দেওয়ার ঘটনাও সে উল্লেখ করে।

রমজান ও রাজ্জাক তাদের বাবাকে নিয়ে গর্ব করে। কারণ আর দশজন বাবার মতো তাদের বাবাও তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। স্নেহ-ভালোবাসা দিয়েছেন। আবার প্রয়োজনে শাসনও করেছেন। বাবা যে মানুষের মাংস খেতেন, তার আচরণ দেখে তার সন্তানদের বর্তমানে তা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়।

রমজান বলে, সেই ছোটবেলায় বাবা একদিন না দেখলে বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিতেন। একদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর। ওষুধ খাওয়ার পরও ভালো না হওয়ায় আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করেন। কখনো ধমক দিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন না। মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হতেও দেখিনি।

এত ভালো মানুষ কিভাবে মানুষের মাংস খেতেন_আমি ভাবতেই পারি না। খলিলুল্লাহ পাবনা মানসিক হাসপাতাল থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ঢাকায় ফিরে এলেও মানুষ মনে করত সে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে। কিন্তু সে পাবনা থেকে একজন সুন্দর মনের মানুষ হয়ে ফিরে আসে। এর পরও তার পরিবারের সদস্যরা এখনো সমাজের কাছ থেকে স্বাভাবিক আচরণ পাচ্ছেন না। তুচ্ছতাচ্ছিল্য নিয়ে তাদের জীবন চলছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।