আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: দূর অরণ্যের ডাক

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

বছর কয়েক হল সাদিয়া আর আশরাফ সুন্দরবনের বইখালীতে জেলে শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। বইখালী জায়গাটা শিবসা নদীর তীরে; মনজুরকে ওরা অনেকবারই বইখালী যেতে বলেছে। কাজের চাপে যাওয়া হয় না।

এবার এক অদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াতে বইখালী যাওয়ার সুযোগ হল মনজুরের। আজ লাঞ্চের পর অফিসে বসে দেশিও জাহাজ নির্মান শিল্পের ওপর একটা অনুসন্ধানী রিপোর্ট লিখছিল মনজুর। একটি দেশিয় শিপইয়ার্ড দাবী করেছে সরকারি সহায়তা পেলে জাহাজ শিল্প খাতে বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। ওখানকার একজন সাবেক ইঞ্জিনিয়ার মুরাদ আহমেদ। মনজুরের ছেলেবেলার বন্ধু।

সে এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষন করে। সেটিই খতিয়ে দেখতে গিয়েছিল মনজুর। পরিবেশ ক্ষতি করে নদীর পাড়ে 'র'স্টিলে স্যান্ড ব্লাস্ট করেছেন কর্তৃপক্ষ - যা আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ ও ভয়াবহ ক্ষতিকারক। লেখাটা প্রায় শেষ করে এনেছে। রায়হান ভাইয়ের ফোন এল।

ক’দিন ধরে তাগাদা দিচ্ছেন রায়হান ভাই। এখন ইনকাম করছিস। আর কতদিন? এখন আলাদা হওয়ার কথা ভাব। তুই এক কাজ কর মনজুর। তুই বরং মেসে ওঠ।

বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ঝুমুর না-হয় আমার এখানেই থাকুক। তোর ভাবীর এতে আপত্তি নেই। মনজুর আজও সময় চাইল। না! না! আর সম্ভব না! তুই কি চাস তোর জন্য আমার সংসারে আগুন ধরুক! না! তা হলে? নিজেকে সংযত করে অনেক কষ্টে মনজুর বলল, এখন রাখি। হাতে এখন কাজ আছে।

রাতে তোমার সঙ্গে কথা হবে। বলে মোবাইল অফ করে দেয় মনজুর; দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাবার কথা মনে পড়ে। বাবা আহমেদ হোসেন সৎ মানুষ ছিলেন। দীর্ঘদিন সরকারি চাকরি করেও ঢাকা শহরে জমি কি ফ্ল্যাট কিনতে পারেন নি।

বাবার মৃত্যুর কয়েক মাস পর মাও চলে গেলেন। মনজুর তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসের ছাত্র। রায়হান ভাই ততদিনে ইস্ট-ওয়েস্ট ব্যাংকে ঢুকেছে। রায়হান ভাইই ওর পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছে। অবশ্য মনজুরও টিউশনি করত।

রায়হান ভাইয়ের প্রতি ও গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। রায়হান ভায়ের ইচ্ছে মনজুর যেন অতি সত্ত্বর মেসে ওঠে। রায়হান ভায়ের ইচ্ছে মনজুরের জন্য আদেশ। মনজুর জানে- রুমানা রায়হান ভায়ের কলাবাগানের ফ্ল্যাটে উঠবে। মেয়েটি শায়লা ভাবীর বড় বোনের মেয়ে; বগুড়ায় থাকে।

ঘরটা ওর জন্যই ছাড়তে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে রুমানা । ওর ভর্তি পরীক্ষার আগে ও পরে মনজুরকেই তো দৌড়ঝাঁপ করতে হল অফিস বাদ দিয়ে। রুমানার সঙ্গে অবশ্য মনজুরের একটা উষ্ণ সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। মাঝেমাঝে অনেক রাতে ফোন করে ।

শায়লা ভাবীকে অবশ্য রায়হান ভাই বলেছিল রুমানা যেন ঝুমুরের ঘর শেয়ার করে। শায়লা ভাবী কী কারণে রাজী হয়নি। হয়তো ঘরে যোয়ান-মর্দ থাকবে তা শায়লা ভাবীর বড় বোনের পছন্দ নয়। এখন মনজুরকে ঘরটা ছাড়তেই হবে। ছোট্ট ছিমছাম ঘর, সংলগ্ন স্নানঘর; পুবমুখি জানালা, রট আয়রনের খাট, লেখার টেবিল, কম্পিউটার ও এক পাশে বইয়ের র‌্যাক মিলে আপন এক মায়াময় জগৎ গড়ে তুলেছিল ।

ও ঘরে এখন রুমানা থাকবে। বাড়িতে অতিথি এলে অবশ্য মনজুরকে ড্রইংরুমের মেঝেতে ফ্লোরিং করতে হয়। এতে মনজুরের কোনও অনুযোগ নেই। এর চে সংসারের মায়াগন্ডির আকর্ষন অনেক বড়। ...বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত ঝুমুর না-হয় আমার এখানেই থাকুক।

তোর ভাবীর এতে আপত্তি নেই। ...রায়হান ভাইয়ের এই কথাটাই এখন একমাত্র সান্ত্বনার। আজ রাতে বাসায় ফিরবে কি না ভাবছিল মনজুর। শরীর জুড়ে ঘাম ও অবসাদ ছড়াচ্ছে দ্রুত। গলার কাছে জমাট বাঁধছে তৃষ্ণা।

ঘরশূন্য মানুষের ঘর ছাড়ার মুহূর্তে কেমন লাগে? যারা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়-তাদের? এই প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ঘুরল মাথার ভিতরে...সাংবাদিকতার বেতন এত কম । বাবার ইচ্ছে ছিল বলেই সাংবাদিকতার পেশায় এসেছে। বেতন কম ঠিকই- তা সত্ত্বেও মেসের খরচ টানতে পারবে। কাজের অবসরের দু’ মুহূর্তের উষ্ণ সংসার- এর মায়া বড় গভীর। এক সঙ্গে খাওয়া কি টিভি দেখা; বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া।

নাবিল আর ফারিয়ার আদর সোহাগ। ঝুমুরের রাঁন্না করা ডিম আলুর তরকারী। এসব কারণেই মেসে ওঠা হয় না। তা ছাড়া ঝুমুর ইডেনে পড়ছে। ওর পড়ার খরচের সঙ্গে টুকটাক হাত খরচও দিতে হয়।

সপ্তাহে সপ্তাহে ভাবীকে এটা-ওটা গিফট দিতে হয়-নইলে মুখ ভার করে। নাবিল আর ফারিয়ার জন্য প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিতেই হয় ... এই জুস কি চিপস; ঝুমুরের জন্য ফোন কার্ড, রায়হান ভাইয়ের জন্য টাই। খবরের কাগজের বিল, ইলেকট্রিক বিল, বুয়ার বেতন, গ্যাসের বিল আর বিকেলের নাশতার টাকাও মনজুরই দেয়। এর পর হাতে আর কি থাকে। সিগারেট কমিয়েছে।

আজকাল রিকশায় কমই চড়ে ...বেশির ভাগ সময় বাসে চাপে কি হাঁটে। এর জনও কোনও অনুযোগ নেই ওর। এত দিনে ও জেনে গেছে সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশাতেও মারপ্যাঁচ আছে। ও অত নীচে নামতে পারে না। বাবার কথা মনে হয়।

মায়ের মৌন শান্ত মুখটি মনে পড়ে। রায়হান ভাইয়ের মানসিক গড়ন হয়তো অন্যরকম। গত মার্চে আশুলিয়ায় সাড়ে তিন কাঠা জমি কিনেছেন। এখন ইস্ট-ওয়েস্ট ছেড়ে প্রিমিয়ার ব্যাংকে আছেন। ভীষণ ঘামছিল মনজুর।

ঘরশূন্য মানুষের ঘর ছাড়ার মুহূর্তে কেমন লাগে? যারা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়-তাদের? এক গ্লাস পানি খেল ও। পার্টিশনের ওপার থেকে সিনিয়র রিপোর্টার ফেরদৌস আমিন বেরিয়ে এলেন। কালো মতন চশমা পরা লম্বা মাঝবয়েসী রসিক একটা মানুষ। বললেল, মনজুর, আপনি কি আজ সন্ধ্যার পর ফ্রি? হ্যাঁ। কিছু না ভেবেই বলল মনজুর।

তা হলে আজ সন্ধ্যায় আপনি একটা টক শো তে যান। আমার যাওয়ার কথা। আমি গুলশান যাচ্ছি। সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী প্রেস কনফারেন্স ডেকেছেন। ’৭২ এর সংবিধান নিয়ে তাঁর কি সব বলার আছে।

টক শো? মনজুর অবাক। ওর সহকর্মীরা অনেকেই বেসরকারি টিভির টক শোতে গেলেও ও কখনও যায়নি। হ্যাঁ। কোন্ চ্যানেল? ফেরদৌস আমিন বললেন। বিষয়? বিষয় আর কি।

পোশাক শিল্পের বিদ্যমান অস্থিরতা। বলে কাঁধ ঝাঁকাল ফেরদৌস আমিন । ওহ্ । মনজুরের মনে পড়ল গতকাল পোশাক শিল্পের এক নারী শ্রমিক কে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। তার আগে মেয়েটিকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে।

ও শিউরে ওঠে। ফেরদৌস আমিন হেসে বললেন, দেখবেন, আবার বেফাঁস কথা বলতে যাবেন না কিন্তু। মনজুরও মলিন হাসে। আর এটা রাখুন। বলে বুক পকেট থেকে একটা হলুদ রঙের খাম বার করে মনজুরের দিকে বাড়িয়ে দিলেন ফেরদৌস আমিন ।

কি এটা! মনজুর বিস্মিত। টাকা। আরে মনে নেই - গত মাসে আপনার কাছ থেকে দু’হাজার ধার নিয়েছিলাম। ওহ্। বলে খামটা নিয়ে পকেটে রাখে মনজুর।

ভুরুতে ভাঁজ আর তিরতির উদ্বেগ নিয়ে সন্ধ্যার আগেই স্টুডিওতে পৌঁছল মনজুর। আসন্ন সন্ধ্যার শহরটা থমথম করছিল। সম্ভবত সেই পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিক কে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে। তার আগে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে বলে। ঝিরঝির বৃষ্টিতে হেড লাইটের আলো।

মনজুর বিষাদ বোধ করে। এ শহর কত নির্মম! এ শহরে মৃত্যু কি সহজ! উদয়-অস্ত খেটে খাওয়া নারীকে টর্চার করে। ছাদ থেকে ফেলে খুন করে। স্টুডিওতে পৌঁছে দেখল সেখানে উপস্থিত আছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ। বিশিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পমালিক মিজানুর রহমান চৌধুরী ।

একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার জসীম মল্লিক। উপস্থাপকটি ঝকঝকে তরুণ। সজল রায়হান। নতুন প্রজন্মে অত্যন্ত জনপ্রিয়। অনুষ্ঠানের গোড়ায় তিনি বললেন, দর্শক, আপনারা জানে যে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকা ধরে সাতটি গ্রেডে পোশাকশ্রমিকদের জন্য মজুরি পুননির্ধারন করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মন্ত্রণালয়ে শ্রমমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এক সংবাদ সম্মেলনে পোশাকশ্রমিকদের জন্য নতুন এ মজুরিকাঠামো ঘোষণা করেন। এটি আগামী ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হবে। নতুন মজুরিকাঠামো অনুযায়ী গ্রেড-১-এর শ্রমিকেরা নয় হাজার ৩০০ টাকা, গ্রেড-২-এর শ্রমিকেরা সাত হাজার ২০০ টাকা, গ্রেড-৩-এর শ্রমিকেরা চার হাজার ১২০ টাকা, গ্রেড-৪-এর শ্রমিকেরা তিন হাজার ৭৬৩ টাকা, গ্রেড-৫-এর শ্রমিকেরা তিন হাজার ৪৫৫ টাকা, গ্রেড-৬-এর শ্রমিকেরা তিন হাজার ২১০ টাকা, গ্রেড-৭-এর শ্রমিকেরা তিন হাজার টাকা এবং শিক্ষানবিশ শ্রমিকেরা আড়াই হাজার টাকা করে মজুরি পাবেন। বলে উপস্থাপক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, এ ব্যাপারে আমরা অধ্যাপক আবু আহমেদের কাছ থেকে তার মতামত জানতে চাইব। অধ্যাপক আবু আহমেদ তাঁর মতামত রাখলেন।

উপস্থাপক এবার তৈরি পোশাক শিল্পমালিক মিজানুর রহমান চৌধুরীকে জিগ্যেস করল, নূন্যতম মজুরি ৫০০০ টাকা করা হলে উৎপাদনশীলতা বাড়ত কি না? মিজানুর রহমান চৌধুরী বললেন, আপনার কথা তাত্ত্বিকভাবে সত্যি। তবে টাকা তো ছাপিয়ে মজুরি দেওয়া যায় না। মজুরি আয় করে দিতে হবে। মিজানুর রহমান চৌধুরী কে জসীম মল্লিক চট্টগ্রাম বন্দর সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন করলেন। এরপর উপস্থাপকসহ প্রত্যেকে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।

গতকালের নারী শ্রমিকের মৃত্যুর প্রসঙ্গটি উঠে আসে। চৌধুরী সাহেব পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছেন। মনজুর মিজানুর রহমান চৌধুরীকে জিগ্যেস করে, বিশ্বকাপের সময় তো মিলিয়ন ডলার লাভ করলেন। এখন নূন্যতম মজুরি ৫০০০ টাকা করা হচ্ছে না কেন? জসীম মল্লিক বলে, আসলে বিশ্বকাপের সময় লাভ করেছে মুষ্টিমেয় ফ্যক্টরি। এখন নূন্যতম মজুরি ৫০০০ টাকা করা হলে ছোট ফ্যক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে।

অকাট্য যুক্তি। তবে মনজুর ক্রোধ টের পায়। বলে, গতকাল একজন পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিক কে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। তার আগে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছে। আপনাদের ক্যামেরা এখনও সে ঘরে ঢুকল না কেন? যে ঘরে শক দেয়, সে ঘরটি টিভিতে দেখালেন না কেন? কেন! জনগন জানতে চায়।

জসীম মল্লিক কাঁধ ঝাঁকাল। এর মানে কী সের মধ্যে কি। উপস্থাপক সজল রায়হান থমকে যায়। থমকে যান অধ্যাপক আবু আহমেদও। মিজানুর রহমান চৌধুরীর থলথলে গোলাকার মুখটি খাবি খাওয়া কাৎলা মাছের মতো দেখাল।

মনজুর টের পায় ওর চাকরি আর থাকল না। ওর পত্রিকার মালিক একজন বিশিষ্ট তৈরি পোশাক শিল্পমালিক। প্রবল হট্টগোল আর অস্বস্তি নিয়ে টক শো শেষ হয়। অনুষ্ঠান শেষে সজল রায়হান বলল, আপনি ওই অস্বস্তি¡কর প্রসঙ্গটি টেনে না আনলেও পারতেন মনজুর। কেন? মনজুর পালটা প্রশ্ন করে।

আপনার কথায় চৌধুরী সাহেব অপমানিত বোধ করেছেন। আপনি কত পেয়েছেন? আমি কত পেয়েছি মানে! সজল রায়হানের ফরসা মুখটি লালচে হয়ে উঠতে থাকে। মনজুর পা বাড়ায়। আড় চোখে দেখল চৌধুরী সাহেব কার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছেন। লবিতে দাঁড়িয়ে ছিল জসীম মল্লিক।

সে শীতল কন্ঠে বলে, মনজুর। এত মাথা গরম হলে এ লাইনে থাকা সম্ভব না। লাইন মানে! মনজুর শরীরময় প্রবল ক্রোধের উত্থান টের পায়। সে বেরিয়ে আসে। বেসরকারী টেলিভিশনের অফিসটি কাওরান বাজারে।

ফুটপাতে উঠে এসে টের পেল, ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরছে। জুলাই মাস শেষ হতে আর কয়েক দিন বাকি। একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটতে থাকে মনজুর। বাড়ি ফিরে লাভ নেই। ঝুমুরের মুখটি ভেসে ওঠে।

ও এখন কি করছে কে জানে। ভাইয়ের সংসারে খুব একটা ভালো নেই ঝুমুর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের হাজারটা কাজ করতে হয়। সকালের রুটি তৈরি থেকে নাবিল আর ফারিয়ার বিছানা তৈরি । রাত দশটায় কখনও কখনও শায়লা ভাবীর বিরিয়ানি খেতে হলে ঝুমুরকেই যেতে হয় গলির মাথা পর্যন্ত।

মেয়েটা লক্ষ্মী বলেই মুখ বুজে সব সহ্য করছে। রুমানার মুখটিও ভেসে ওঠে। ভারি মিষ্টি একটা মেয়ে। শ্যামলা। ডাগর আঁখি।

ও মনে মনে রুমানার উদ্দেশ্যে বলে ‘তোমাকে ভালোবাসি বলেই আমি আর ফিরব না রুমানা। ’ মনজুর সিদ্ধান্ত নেয়: কখনও অবসর পেলে রুমানাকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবে। উলটো দিক থেকে একটা মাইক্রোবাস আসছিল। এ ধরনের বাহন সাধারনত পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত হয়। মনজুরের কেমন সন্দেহ হয়।

তখন লবীতে চৌধুরী সাহের কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। ও চট করে বাঁ পাশে সরে আসে। এ দিকে অপরিসর রাস্তা। রাস্তায় গর্ত, কাদাপানি ভরা; দু’পাশে ভাতের হোটেল। দুর্গন্ধ, আধো-অন্ধকারে থেমে থাকা ট্রাক ও সি এন জি।

একটা সিন এন জি -র সামনে পৌঁছে ‘শ্যামলী’ বলে উঠে পড়ল। বুকটা কাঁপছিল। ... বাসে উঠে বসে টিপটিপ উত্তেজনা বোধ কর ছিল। মনে হল বাসে এক্ষুনি কয়েকজন র‌্যাব উঠবে। পলাতক বিডিআর বলে ফাঁসিয়ে দেবে।

তৈরি পোশাক শিল্পমালিক মিজানুর রহমান চৌধুরীদের হাত অনেক দূর অবধি যায়। মাইক্রোবাসে কারা ছিল? ... বাস ছাড়ল। খিদে মরে গেছে। অন্ধকারে ডিজেলের গন্ধ। মনজুরের ঝিমুনি পায়।

শরীর জুড়ে অবসাদ। মোবাইল অফ করে দেয়। রুমানা ফোন করবে। মানসপটে সাদিয়া ও আশরাফের মুখ ভেসে ওঠে। ওরা নিশ্চয়ই কাল অবাক হয়ে যাবে ওকে দেখে।

সাদিয়া আর আশরাফ মনজুরের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। তিনজনই টুকটাক লেখালেখি করত। ‘মউয়াল’ নামে ছোট কাগজ বার করত। উদ্বোধনী সংখ্যায় সাদিয়া লেখা একটি কবিতা আজও মনে আছে। গলুইয়ে মাছের গন্ধ; মেঘলা একটি দিন।

মাছের গন্ধমাখা গলুইয়ের ওপর শহর ছাড়িয়ে গেলে যতটা জলজ আর অর্ধ-নগ্ন থাকা যায় - সেরকম উবু হয়ে ছিলাম। মেঘলা দিনের বিমর্ষ আলোয় আমারে প্রণতি জানায় শিবসার হাসিখুশি শুশুক। নদীর দু’পাড়ে- গেওয়া-গরান-ওড়া ও ধুন্দুল; তাহাদের পাতার ওপর বৃষ্টির ঝিরঝির ঝিরঝির শব্দ- শ্রাবণের শেষ জলধারা... গোলপাতার নীচে ভিজছিল নিঃস্ব মউয়াল; তাহাদের ভয়ডর নাই? চকিতে সরে যায় তুখোর বাগডাস! রায়মঙ্গল থেকে উঠে আসা মিশমিশে কালো মাঝি ভাতের হাঁড়ি চাপিয়েছে নৌকায় ছৈয়ের নীচে। কাল রাতে সে বলেছিল পচাব্দী গাজীর উপাখ্যান। আমারও স্বপ্নে তারপর যথারীতি এসেছিল হলুদ একটি বাঘ রাজগোখরাও মিশেছিল ডালে! পরদিন সকালে আমি উবু হয়ে ছিলাম শিবসার গূঢ়তম জলের ওপরে।

কতকাল আগে যেন... গলুইয়ে মাছের গন্ধ; মেঘলা একটি দিন। ওদের ছোট্ট দলে সোসিওলজীর শারমীন বীথিও ছিল। রংপুরের মেয়ে। ভারি মিষ্টি দেখতে, চমৎকার ভাওয়াইয়া গাইত । মনজুরের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল বীথির।

সেইবীথি একবার সাদিয়াকে জিগ্যেস করেছিল, সাদিয়া, তোরা যে পরস্পরকে এত ভালোবাসিস, তোরা নিশ্চয়ই পাস করার পর পরই বিয়ে করে ফেলবি না? না। কেন? সাদিয়া তখন আল মাহমুদ থেকে আবৃত্তি করে:‘আমার তো কপিলে বিশ্বাস/ প্রেম কবে নিয়েছিল ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ। ’ বীথি হতভম্ভ। অনার্স এর পর বীথির এক কোরিয়া ফেরৎ পয়সাওয়ালা খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়ে যায়। মনজুর দুঃখ পায়নি।

বীথি খুবই ঘরোয়া মেয়ে। বরং রুমানা অনেক ডিপ। রুমানাকে যা যা বলার ছিল বলা হল না ... এই দুঃখ। এই দুঃখ এখন সুন্দরবনের আলোবাতাস রোদ আর বৃষ্টিতে ভিজে ভুলে যাবে। সুন্দরবনের জীবন বিপদজনক।

সাদিয়া/আশরাফরা স্বেচ্ছায় সে জীবন বেছে নিয়েছে। ওরা দরিদ্র মউয়াল ছেলে মেয়েদের পড়ায়; পড়ায় দুধর্ষ বনডাকাতের ছেলে মেয়েদেরও । উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ূ পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন ওরা। ‘মউয়াল’ নামে ছোট কাগজটির সম্পাদকীয় মনে আছে মনজুরের... নানান জাতের জীবজন্তু, পাখপাখালি আর বাহারি ম্যানগ্রোভ, উদ্ভিদে ভরপুর সুষমামণ্ডিত এক বনাঞ্চলের নাম ‘সুন্দরবন’। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বনের ডাঙায় বাঘ, হরিণ, বানর, শূকর, বনবিড়াল, সজারু, বক, ঈগল, মাছরাঙা, শালিক, ফিঙে, মুনিয়াসহ নানাজাতের জীবজন্তু আর পাখপাখালি; বনের ভেতর বয়ে যাওয়া ছোট-বড় নদী আর খালের পানিতে বাস করে লোনা পানির বড় বড় কুমির, অজগর, গোখরা, গুইসাপ, শুশুক থেকে শুরু করে শত প্রজাতির মাছ।

এরা সুন্দরবনের স্থায়ী বাসিন্দা। সাইক্লোন আর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে এই বনভূমি। ‘হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য’; ‘ফারাক্কার প্রভাবে মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস : আগামরা রোগে আক্রান্ত সুন্দরীসহ বহু গাছ’ ও ‘বনজুড়ে এখনও দেখা যায় মানবসভ্যতার ক্ষতচিহ্ন’ ...সুন্দরবনকে বাঁচাতেই হবে। কেননা, ওরা বিশ্বাস করে একুশ শতকে সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাক্তি- রাষ্ট্র না । জলডাকাতের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে।

ডলফিনদেরও বাঁচাতে হবে। এই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সাদিয়া/আশরাফরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়েই শিবসা নদীর পাড়ে চলে আসে। অবশ্য অনেক আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলে আসা যাওয়া ছিল। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র নিয়ে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করত। ‘বেনে বউ’ পাখির ওপর নির্মিত বারো মিনিটের একটি প্রামাণ্যচিত্রের জন্য ওরা ফিলিপাইনভিত্তিক একটি আর্ন্তজাতিক সংগঠনের পুরস্কারও পায়।

সাদিয়া তুখোর ফটোগ্রাফার। ওর সুন্দরবনের ‘সবুজ ব্যাঙ’ সিরিজ ঢাকার দৃক গ্যালারিতে প্রদর্শিত হলে দেশিবিদেশি দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে যায়। সাদিয়া বলে, ‘মনজুর, এই যে আমরা নিভৃতে একজন মউয়ালকে অরণ্যসচেতন করে তুললাম, কিংবা একটি আহত ফিঙের সেবা করলাম কি একটি বাওয়ালির দরিদ্র মেয়েকে অক্ষরজ্ঞান দিলাম ... এইই আমাদের জীবনের পরম লক্ষ । শহরের মানুষ তা নাই-বা জানল সে কথা। ’ শিবসা পাড়ের সুন্দরী গেওয়া, কেওড়া, গরান গাছে ঘেরা ছিমছাম উঠানের এক কোণে সাদিয়া/আশরাফদের স্কুল।

স্কুলের নাম ‘বনের পাঠশালা। ’ আজই মনজুর সে উঠানে প্রথম পা রাখবে। রূপসা নদী ঘাট। চারি দিকে ভোরের পবিত্র আলো ছড়িয়ে আছে। ঘাটে নৌকা ও ট্রলারের ভিড়।

মনজুর এগিয়ে যায়। সাদিয়া গতমাসে একবার ঢাকায় এসেছিল। তখনই বইখালীর ঠিকানা বিস্তারিত বলে দিয়েছিল। গতকাল অনেকটা কাকতালীয় ভাবেই সিনিয়র রিপোর্টার ফেরদৌস আমিন ধার শোধ করল। নইলে পকেট প্রায় ফাঁকাই ছিল।

দৈব কি চায় আমি শহর পরিত্যাগ করি। মনজুর অভিভূত হয়ে ভাবে। শহরে পোশাক শিল্পের কর্মীদের ইলেকট্রিক শক দেয়, ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করে ...শহরের বাইরে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশ তার অনেক সবুজ জমিন রেখে দিয়েছে শান্তিবাদীদের জন্য । ... একটা ট্রলার বইখালীর দিকে যাবে। উঠে বসল ও।

অন্য সহযাত্রীরাও ছিল। মাত্র ট্রলার ছেড়েছে। খিদে টের পেল। ঝুলিতে পাউরুটি/কলা আছে। ঘাট থেকে কিনেছে।

ভীষণ ঘামছিল মনজুর। ঘরশূন্য মানুষের ঘরছাড়ার মুহূর্তে কেমন লাগে? যারা নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়-তাদের? বোতল বার করে এক ঢোক খনিজ পানি খেল। মেঘ করেছে। করুক। বৃষ্টি আসবে।

আসুক। দক্ষিণের নিবিড় অরণ্যবনের অঝোর বৃষ্টিতে ভিজে সব ভুলে যাবে মনজুর। রুমানার মুখ, এমন কী ঝুমুরের মুখ ... সব।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.