আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: ডোন্ট অরি

নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই

বান্দরবানে নিয়ে এসেও যথারীতি মামা আমাকে বিপদে ফেললেন। উনি বলেছিলেন যে হোটেলটা উনার পরিচিত। কিন্তু পরিচিত তো কি? হোটেলে জায়গা না থাকলে উনি কি যাদু করে রুম বানাবেন? ঈদের সিজন। লোক আসে অনেক। সবাই বুক করে রেখেছে কয়েকমাস আগে।

তো আগে আসলেই হতো। কিন্তু ঢিলা লোকের অজুহাতের অভাব হয়না। মামা আমাকে বলেছিলেন, "চিন্তার কিছু নেই। এসব জায়গায় কে যাবে বেড়াতে? জায়গাটা দুর্গম, একটা ছম ছম ভাব আছে। ভাঙাচোরা রাস্তা।

চারদিকে বন। চিম্বুকে ঘোরার জন্য তো আরও হোটেল আছে। " কিন্তু উনি কি খেয়াল করেন না যে পত্রিকাগুলো এখন ভ্রমণকাহিনী ছাপায়। এরা জানিয়ে দিয়েছে যে নিদমহল হোটেলের কাছেই "সোনাছড়ি" নামের একটা দারুন সিনিক জায়গা আছে। আর যে কারণ সব রুম বুকড।

এখন উপায় একটা হলো ৮/১০ মাইল দুরে কোন হোটেলে উঠে যাওয়া। গায়ে খুব শক্তি ছিলনা। ঢাকায় থাকলে ট্যাং ঠান্ডা পানিতে মিশিয়ে ঢক ঢক করে গিলে ফেলতাম। মামা নিশ্চিন্তে আবারও বলেছিলেন, "ডোন্ট অরি ভাগ্নে, আমি তো আছি"। একটা গল্প পড়েছিলাম।

একটা লোক অনেক উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে গেছে। নিচে পাথুরে নদী। সে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতেই একটা গুরুগম্ভীর শব্দ শুনতে পেল, "আমি আছি, ডোন্ট অরি"। তারপর সে হুহু করে নিচের দিকে পড়ছে আর চিৎকার করছে। সে হঠাৎ পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা একটা গাছের ডাল পেয়ে আঁকড়ে ধরলো।

ডালটা ভেঙে যাচ্ছে তাই "বাঁচাও, বাঁচাও" বলতেই আবার সেই গুরুগম্ভীর শব্দ, "ছেড়ে দাও ওটা, ডোন্ট অরি"। ছেড়ে দিতেই আবারও পড়ছে তো পড়ছেই। নিচে পাথর, পানিতে কুমিরেরা হা করে আছে। তখনও শুনতে পাচ্ছে দৈববাণী, "ইটস ওকে, ডোন্ট অরি"। মামা সেই রকম ডোন্ট অরি লোক।

বাস ছেড়ে দিলেও ডোন্ট অরি, পকেটমারি হলেও ডোন্ট অরি, কেউ মুমুর্ষু হলেও ডোন্ট অরি। মামা ফিরে এসে বললেন, "একটা উপায় করে ফেললাম, ভাগ্নে। হোটেলের কেয়ারটেকারের বাসাটা এইদিকে। তার মালপত্র রাখার কক্ষটা এক রাতের জন্য কিছু পয়সা দিয়ে পেয়ে গেলাম। খাওয়াটা নিদমহলের ক্যান্টিনে সেরে ফেললেই হবে"।

কেয়ারটেকারের স্টোররুমে ঢুকে বমি এসে গিয়েছিল। মনে হয়নি সেটা ধোয়া হয়েছে কখনো। কাঠের বাসা, ইঁদুরের উৎপাত ছিল নিশ্চয়ই। মেঝেতে ছোপ ছোপ চুনের দাগ। আর যে চৌকিটা পেতে গিয়েছিল সেটাও ছারপোকার আখড়া।

একজন উপরে ঘুমাতে পারবে। নিচে গামছা পেতে একজন থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। জানালা না থাকায় দমবন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। হাতমুখ ধোয়ার জন্য সিলভারের জগে পানি দিয়ে গিয়েছিল কেয়ারটেকারের মেয়ে। মামা বলেছিল, "দেখলি, মাত্র ৫০ টাকায় পেয়েছি।

পয়সা তো বাঁচলো। যদি ৩/৪ টা দিন এখানে কাটাতে হয় মন্দ কি"! তখন সকাল ১১টার মতো বাজে। ক্যান্টিনের পাশে ছাতাওয়ালা একটা বসার জায়গায় ১০/১২টি চেয়ার পাতা। আমরা সেখানে বসেছিলাম। একটা নতুন যুগল এসেছে।

পুতুপুতু ভাব বোঝা যাচ্ছে মেয়েটার মধ্যে। হাতের পাঁচ আঙুলে সোনার আংটি। গলায়ও সোনার চেইন । ভাত খাবার সময় এমন সোনা পরে ঘোরে একমাত্র হানিমুনের কাপল। আর বয়স্ক পরিবারও আছে।

কর্তাটি নড়তে পারেনা টেবিল থেকে ক্যান্টিন পর্যন্ত - সে দুর্গম পাহাড়ে হেঁটে দেখবে কী করে? তার স্ত্রী গল্প শুরু করেছে। গল্প আর কী স্বামীর সঙ্গে কোথায় কোথায় গিয়েছে। তাদের গাড়ি বাড়ি ইত্যাদি। একটা শুকনো ছিপছিপে গড়নের লোক চুপ করে বসেছিল। মামা এরপর তার মুখ খুললেন।

বললেন, "জায়গাটার নাম কেন "সোনাছড়ি" সেটা নিয়ে আগ্রহ ছিল আমার। সাধারণত সমস্ত ছড়িগুলোর একটা ইতিহাস থাকে"। নতুন বিবাহিত মেয়েটির নাম সোনিয়া। মেয়েটা ফর্সা, চোখগুলো কিউরিয়াস। সে মিষ্টি করে বললো, "তা, জানতে পেরেছিলেন, কেন এই নাম?" মামা বললেন, "হ্যা, কিছুটা জেনেছিলাম।

এখানে ২/৩ বছর আগেও একবার এসেছিলাম। তখন কেয়ারটেকার ছিল খুব বুড়ো একটা লোক। এবার এসে শুনলাম সে আর নেই। সেই কেয়ারটেকার বলেছিল, সোনা ছিল স্থানীয় মগ উপজাতীয়দের সর্দারের মেয়ে। সেই মেয়ে শহর থেকে বেড়াতে আসা এক ছেলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।

সেই প্রেমের পরিণতিটা ভাল হয়নি। ছড়ি মানে ঝরণা। সেই প্রেমের স্মৃতিতেই সোনাছড়ি নাম। টেকনাফে কেউ গিয়েছেন? ওখানে মাথিনের কুয়া বলে কুয়া আছে। সেখানেও প্রায় একই ঘটনা ঘটে।

পাহাড়ি মেয়েরা সহজেই শহুরে ছেলেদের প্রেমে পড়ে যায় আর ওরা খুব আবেগী হয়"। সোনিয়া মনে হয় এটা বলার পর তার নতুন স্বামীকে নিয়ে চিন্তাতে পড়ে গেল। মামা সান্ত্বনা দিয়ে বলছিল, "এসব গল্প অনেকটাই লোককথা। কিন্তু কাকতালীয় ভাবে জেনেছিলাম এই হোটেলটার আগে নাম ছিল "হোটেল সোনাছড়ি"। মালিক ছিল এক হিন্দু ব্যবসায়ী।

কেন হোটেলের নাম বদল হলো সেটা জিজ্ঞেস করেছিলাম কেয়ারটেকার বুড়োটাকে। ১৯৮৫ র দিকে কথা। এক লোক ঢাকা থেকে সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন এখানে। রাত তিনটা বাজে। হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পায় কেয়ারটেকার।

হারিকেন নিয়ে গিয়ে দেখে লোকটার স্ত্রী সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ফাঁসিতে ঝুলছে। জিহ্বা বের হওয়া। দরজাটা খোলা। কিন্তু লোকটা নেই। এখান থেকে পুলিশস্টেশন বেশ দুরে, ডাক্তারও ছিলনা তখন।

মেয়েটা সন্তান সম্ভবা ছিল। গায়ে দামী জামাকাপড়। হতে পারে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল। কিন্তু বিবাহিত হলে সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে কোন স্বামী এমন পাহাড়ি এলাকায় আনবেনা। আর কোন মেয়ে ফাঁসি নিলে চিৎকারও করবেনা।

আর স্বামী পাশে থাকতে সিলিং এ ঝুলে আত্মহত্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পুলিশ পরে রহস্য উদ্ধার করেছিল- লোকটা আসলে ওড়নায় প্যাচ দিয়ে হত্যা করে মেয়েটাকে। কেয়ারটেকারের ভাষ্য অনুযায়ী মেয়েটাকে ফাঁসি থেকে নামানোর পর কাটা মুরগির মত ছটফট করছিল। তারপর থেকে অনেকদিন এই হোটেলে কেউ আসতো না। জঙ্গলের মধ্যে এমনিতেই কম আসে লোকে।

কারেন্ট নেই রাতে। মালিক জ্যোতিষচন্দ্র তখন কমদামে হোটেলটা বিক্রি করে দেয় বর্তমান মালিকের কাছে। গতবার এসেও ২২ নম্বর রুমে তালা দেখেছি। মানুষ তো সব বাড়িতেই মরে। তাই বলে কি থেমে থাকে কিছু?"।

বয়স্ক লোকটা মনে হয় খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল এই মর্মান্তিক ঘটনাটা। তার হয়তো কোন মেয়ে আছে! খারাপ লাগা স্বাভাবিক । মামা যোগ করলেন, "তবে জানেন একটা আশ্চর্য জিনিস, সেই দ্বিতীয় মেয়েটার নামও ছিল "সোনা"! পৃথিবীর অনেক কিছুই খুব অদ্ভুত, তাই না? মনে হয় কেউ সাজিয়ে রেখেছে"। সবাই চুপ হয়ে শুনছিল। এমন সময় ক্যান্টিন থেকে খেতে ডাকলো।

খাওয়া শেষে আবার সেই স্টোররুমে ফিরতে হলো। জিরাচ্ছিলাম, বিকালে বের হবো বলে। এমন সময় কেয়ারটেকার এসে খবর দিলো হোটেলের ২২ নম্বর রূমে উঠেছিল যে দম্পতি তারা কোন কারণে ঢাকায় ফেরত যাচ্ছে। মামা একটু হাসলেন। বললেন. "ভাগ্নে , গল্পটল্প লিখতে জানলে, অলওয়েজ একটা উপায় হয়।

বলেছিলাম না ডোন্ট অরি"। আমি বললাম, "তার মানে পুরোটাই বানানো, এই সর্দারের কন্যা, বুড়ো কেয়ারটেকার, অন্ত:সত্বা মেয়ের আত্মহত্যা, সব?"। মামা বোকার মত প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন, "আরে, জীবনে এই প্রথম এলাম এখানে, এতকিছু জানবো কখন!"

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.