আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: হঠাৎ একদিন

মানুষ মরে গেলে পঁচে যায়| বেঁচে থাকলে বদলায়| কারণে অকারণে বদলায়........ নীলা কান থেকে হেডফোন নামিয়ে বলল, "উফফ বাপ্পী!এক্সিডেন্ট করবে তো! একটু আস্তে চালাও না!" "ভয় কিসের? বৃষ্টি তো কমে গেছে। বলতে বলতে আমি একটা বাঁক নিলাম। রাস্তা এখানে ফর্টিফাইভ ডিগ্রি কোণ করে বেঁকে গেছে, আহামরি কোন বাঁক নয়। নতুন কেনা ফোর্ড ফিয়াস্টা ক্ল্যাসিক গাড়িটা কোন শব্দই করল না, কিংবা বাঁকের কারণে আমরা তেমন ঝাঁকিও খেলাম না, কিন্তু নীলা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। বলল, "মা গো! এভাবে কেউড্রাইভিং করে?" "আচ্ছা নীলা, সবসময় সবকিছুকে এত ভয় পাও কেন বলো তো? বাসায় তেলাপোকার ভয়ে কাত, রাতে ভূতের ভয়ে কাত, অফিসে বসের ভয়ে কাত, রাস্তায় এক্সিডেন্টের ভয়ে কাত, এত ভয় কিসের তোমার? ঢাকা পৌঁছাতে অনেক বাকী, এসো, আজ তোমাকে একটু ড্রাইভিং শেখাই!" "ওরে বাবা! না না!! আমার বড্ড ভয় করে!!" "কাম'ন নীলা,লেট'স কাম আউট ফ্রম দিস।

আজ তোমাকে ড্রাইভিং শেখাবই। " "না না! আমি পারব না। " "আলবাৎ পারবে! আমি গাড়ি সাইড করছি। এসো তো। " "প্লিজ ডা'লিং! ট্রাই এনাদার ডেই।

" "এনাদার ডেই? হাহ! ইট নেভার কামস। " "প্লিজ...। " আমি হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিলাম। এই মেয়েকে বোঝানো আমার কম্ম নয়। আমি গিয়ার বদল করলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পিডোমিটারের কাঁটা ৬০-এ নেমে এল ৭০ থেকে। নীলা গাড়ির রেডিও অন করে দিল। একটা রিনরিনে মেয়েলি গলা ভেসে এল রেডিওতে। "...পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন নেচে ওঠে...। " গায়িকা শ্রেয়া ঘোষাল।

ক্ল্যাসিক টোন নয়, রগরগা আধুনিক ব্যান্ড আর ডিসকো মিউজিক। পুরুষ গলাটা সম্ভবত নচিকেতার। আধুনিকায়ন করলেও গানটার এপিল কমেনি। বেশ লাগছে শুনতে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম।

শ্রেয়া ঘোষালের গান নয়, গান শুনতে শুনতে নীলা ঠোঁট মেলাচ্ছিল- সেই গান। নীলা অসম্ভব ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। যদিও অনেক বলে কয়েও স্টেজে উঠাতে পারিনি ওকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রায়ই ডাক পড়তো ওর, বিশেষ করে রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে। অনেক ভাল গাইত কিনা! কিন্তু ওর বড্ড ভয়।

স্টেজে হাজার হাজার মানুষের সামনে গাইতে হবে ভাবলেই নাকি ভয়ে ওর কলজে শুকিয়ে যায়। এই ভয়ই ওকে খেল। সবকিছুতেই অতিরিক্ত ভয়। নীলার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই মেয়েটা কি ভীষণ ভয়কাতুরে। শরতের স্নিগ্ধ সকাল ছিল সেটা।

নীলারা আমাদের বার তলা ফ্ল্যাটের সেভেনথ ফ্লোরে থাকত। আমরাও একই ফ্লোরে থাকতাম । নীলারা তখন নতুন উঠেছে ফ্ল্যাটে। ভালমতো সবাইকে চিনে উঠতে পারেনি তখনো। সেই সকালে আমি ফ্ল্যাটের পিছনে আমাদের ছোট্ট বাগানটায় গিয়েছিলাম পানি দিতে।

একটা চারাগাছের গোড়ার মাটি আলগা হয়ে গিয়েছিল। বাসা থেকে একটা শাবল এনে ভালমত কুপিয়ে কুপিয়ে মাটি এনে জড়ো করলাম চারাগাছটার গোড়ায়। কাজ শেষে শাবলটা হাতে নিয়ে লিফটে উঠতে যাব, দেখি সালওয়ার কামিজ পড়া একটা মেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে লিফটে উঠল। আমিও পিছন পিছন গিয়ে উঠলাম, হাতে শাবল তখনো। মেয়েটা দেখলাম একই ফ্লোরের বাটন টিপল।

তাই চুপচাপ শাবল হাতে দাড়িয়ে রইলাম পাশে। মেয়েটা একবার আমার দিকে তাকায়, একবার শাবলের দিকে তাকায়। তারপর ভয়ে ভয়ে বলে, "আ...আ...আপনি কোন বাটন টিপলেন না কেন?" মেয়েটা ভয় পেয়েছে বুঝতে পেরে মজা পেলাম খুব। মানুষকে ভয় দেখানোর মধ্যে প্রচন্ড মজা আছে। আমি ভিলেনের মতো শয়তানী ভাব নিয়ে মুচকি হাসলাম।

মেয়েটা আরো ভয় পেল। "আ...আ...আপনি কোন ফ্লোরে যাবেন?" আমি ভয়ংকর রকম ঠান্ডা গলায় বললাম, "আপনি যে ফ্লোরে যাবেন, সেই ফ্লোরে। " মেয়েটা এ কথা শুনে ছিটকে তিন হাত দূরে গিয়ে লিফটের দেয়াল ঘেঁষে দাড়াল। লিফট খুলতেই হন্ত-দন্ত হয়ে হেঁটে গেল! আমি খুব একচোট হেসে নিলাম। এখন অবশ্য প্রতিদিনই মেয়েটা,মানে নীলার সঙ্গে একই লিফটে উঠতে হয়! আমরা একই ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে একই কোম্পানিতে কাজ করছি, একই ছাদের নিচে থাকছি।

আমাদের বিয়ে হয়েছে গত সপ্তাহেই। "বাপ্পী, সকালে কিছু খাওয়া হয়নি। কোন একটা রেস্ট্রন্টের পাশে থামাও তো। কিছু খেয়ে নেই। " নীলার কথায় আমি বাস্তবে ফিরে এলাম।

ড্রাইভিং হুইলটা শক্ত করে ধরলাম। হ্যা, আসলেই খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে! নীলার মায়ের বাড়ি, চট্টগ্রাম থেকে ফিরছি আমরা। বেশ সকাল সকাল বেড়িয়েছি। তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। "নীলা, একটা রেস্ট্রন্ট দেখতে পাচ্ছি।

শ্যাল উই স্টপ?" "হ্যা, থামাও। " আমি গাড়ি থামালাম। বেশ সুনসান, নির্জন জায়গা। ভাল একটা রেস্তেরা দেখা যাচ্ছে। ফাস্তফুডও বলা যায়! তেমন কোন কাস্টমার নেই এই সময়ে।

কোনার দিকের একটা টেবিলে বসে পড়লাম দু'জনে। দু'টো পিৎজা অর্ডার করলাম। খেয়ে দেয়ে বিল মিটিয়ে বেরিয়ে আসতে যাব, ঠিক তখন মনে পড়ল যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। কিংবা কিছু একটা চোখে পড়েছে যেটার গুরুত্ব বুঝতে পারছি না, অথচ বোঝা উচিত। নীলা ধরতে পারল ব্যাপারটা।

"এনিথিং রং বাপ্পী?" আমি চারিদিকটায় আরেকবার চোখ বুলালাম। পেলাম না কিছুই। "নাথিং, নাথিং'স রং। " গাড়িতে উঠে এলাম। "দেখো, কি সুন্দর রোদ উঠেছে?" নীলার কথা ঠিক।

বেশ রোদ উঠেছে চারিদিকে। বৃষ্টিতে ভেজা মাঠঘাট ঝলমল করছে রোদে। ড্রাইভিং করছি, মাইলখানেক গিয়েছি সামনে, ঠিক এমন সময় বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল বিষয়টা। রেস্ট্রন্টে বসে কেন অদ্ভূত লেগেছিল,বুঝতে পারছি এখন। প্রচন্ড হার্ড ব্রেক কষে গাড়ি দাড় করালাম।

ভাগ্যিস, সিট বেল্ট বাঁধা ছিল! নইলে নীলা নির্ঘাত উইন্ডশীল্ডে গিয়ে বারি খেত। "বাপ্পী,হয়েছে কি তোমার? আর ইউ ওকে?" আমি উদভ্রান্তের মতো নীলার দিকে তাকালাম। নিজেকে পাগল পাগল মনে হল। "নীলা,আমি দেখেছি!" "কি দেখেছ?" "নাহ, ভুল হতেই পারে না। আমি ঠিক ঠিক দেখেছি।

" "কি?" কথা বলার সময় নেই। আমি গাড়ি ঘোরালাম দ্রুত। রেস্তোরার দিকে ইউ টার্ন নিলাম। নীলা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এক মিনিটও লাগল না, আমরা উড়ে চলে এলাম রেস্তোরায়।

গাড়ি থামালাম। "বাপ্পী, কি হয়েছে বলবে তো?" আমি বোতল থেকে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেলাম। একটু শান্ত হল মন। "নীলা, রেস্ট্রন্টের নাম দেখেছ?" নীলা গলা বের করে উকি দিয়ে দেখল নামটা-"লালুগঞ্জ ওয়েল ফুড!" "লালুগঞ্জ, এই নামটা শুনে কিছু পড়ে?" নীলা চুপচাপ ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর চেহারা।

"রাহেলা বেগম! তুমি কি তার কথা ভাবছ?" "হ্যা, তার কথাই ভাবছি। দশ বছর ধরে এই লালুগঞ্জ গ্রামটাকে আমি খুঁজছি, আর আজ পেয়ে গেলাম, কো-ইনসিডেন্টলি!" "তেত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে। তোমার কি মনে হয় এতদিন তিনি বেঁচে আছেন?" "হ্যা নীলা, আমার বিশ্বাস তিনি বেঁচে আছেন। যদিও...এটস জাস্ট এন ইনটিউশান! বাট....আ ভেরি স্ট্রং ওয়ান!" "যদি বেঁচে থাকেনও, তাহলেও প্রশ্ন আছে। তিনি এখনও এই গ্রামেই আছেন? এত বছর পর তাকে খুঁজতে গেলে, শি মাইট হ্যাভ প্রবস!" "আমি জানি নীলা, এত বছর পর তিনি এই গ্রামে নাও থাকতে পারেন।

হয়তো তিনি জীবনটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নিয়েছেন এতদিনে। হয়তো তার সামনে গিয়ে দাড়ানোটা পজিটিভ নাও হতে পারে। তবুও আমাকে যেতে হবে নীলা, আই হ্যাভ টু! আই কান'ট স্কেইপ!" "আমি কি ঢাকায় মা-কে ফোন করে দেব যে, আমাদের আসতে দেরি হতে পারে। " মা মানে আমার মা, নীলার শ্বাশুরি| "হ্যা, দাও। তবে এখনি রাহেলার কথা বলার দরকার নেই।

" নীলা ফোন করতে যাবে, আমি ওর হাত ধরে ফেললাম। "নীলা, আর ইউ এশেইমড অফ মি?" "ছিঃ! কি যে বল!" নীলা ধরে রাখা হাতটায় জোরে চাপ দিল। তারপর বলল, "তুমি যদি রাহেলার কথা আমার কাছে লুকোতে, তাহলে হয়তো খারাপ লাগতো। বাট ইউ ডিডন'ট। ইউ আর ফ্রাংক।

আমি তোমার জন্য এশেইমড নই বাপ্পী, বি শিওর। " "জানি, আই ট্রাস্ট ইউ। " নীলা একটা অভয়ের হাসি দিয়ে ফোন হাতে নিল। আমি নিশ্চিন্ত বোধ করলাম। নীলার মধ্যে দ্রুত অন্যের মনোকষ্ট বুঝে নেওয়ার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।

আমি মোবাইল ফোন বের করে আজকের তারিখ দেখলাম- ৮ মে, ২০০৬ । অফিস খুলতে দু'দিন বাকী এখনো। নীলা ফোনে মায়ের সঙ্গে কথা বলছে। আমি গাড়ির ডেকে হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। রাহেলার কথা মনে পড়ল।

সে শেষ একটা চিঠি দিয়েছিল। তেমন কিছু লেখা ছিল না সেখানে। সে ভাল আছে, এবং লালুগঞ্জ নামের কোন একটা গ্রামে স্কুলে শিক্ষকতা করছে। এতটুকুই। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি, নীলা তখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েছিল।

দীর্ঘ আট বছর পেরিয়ে গেছে তারপর। এই আট বছরের দীর্ঘ সম্পর্কে নীলার কাছে আমি কোন কথাই লুকাইনি। রাহেলার কথাও নয়। নীলাও খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছিল এটা। কখনো ওর মধ্যে এ নিয়ে কোন হীনম্মন্যতা দেখিনি।

"মাকে বললাম যে দেরী হতে পারে। " "ভাল করেছ। ভাবছি কোথ্থেকে শুরু করব। " "রেস্ট্রন্টের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলেই পারো। বয়স্ক লোক,নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বলতে পারবে।

" "ঠিক বলেছ। " রেস্তোরায় গিয়ে দেখি,ম্যানেজার-স্টাফ­সবাই মিলেটিভিতে হিন্দি সিনেমা দেখছে। কাস্টমারের কোন চিহ্ন নেই। আমরা ঢুকতে সবাই একটু নড়েচড়ে বসল। কাউন্টারের সামনে গিয়ে ম্যানেজারকে বললাম, "এক্সকিউজ মি, রাহেলা বেগম নামের কেউ কি এই গ্রামে থাকেন?" ম্যানেজার মাথা চুলকে বলল, "উমম...রাহেলা? না তো! আসলে স্যার, এটা তো মফস্বল শহর, এখানে মহিলাদেরকে অমুকের মা কিংবা তমুকের মেয়ে নামে ডাকা হয়।

" "তাই? তাহলে তো চিন্তার বিষয়!" "আপনি আর কোন তথ্য দিতে পারেন তার সম্পর্কে?" "আর কোন তথ্য.....নাহ, আর তেমন কিছু জানা নেই। কোন ফটোগ্রাফও নেই তার। " নীলা হঠাৎ বলল,"তিনি স্কুল শিক্ষিকতা করেন কিংবা একসময় করতেন। " তাই তো, এই সহজ তথ্যটা আমার মাথায় এলো না! "আপনি নিশ্চিত ম্যাম?" "হ্যা! কেন?" "আসলে এই গ্রামে একটাই স্কুল আছে,আর এই স্কুলের টিচারদের আমি ভালভাবেই চিনি। তাদের মধ্যে কোন রাহেলা নেই।

আমি শিওর। " আমি হতাশ হয়ে তাকালাম নীলার দিকে। নীলা বলল, "আচ্ছা, এমন হতে পারে না যে, দশ-পনের বছর আগে সে টিচার ছিল,এখন অবসর নিয়েছেন?" "হতেও পারে। যদিও আমার তা মনে হয় না। আমি তো ষোল বছর ধরে এই গ্রামে আছি।

" "আচ্ছা, আপনি স্কুলটা কোন দিকে বলুন তো, আমরাই গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি। " "এই রাস্তাটা ধরে তিন কিলোমিটার সোজা চলে যান, তারপর বাঁয়ে মোড নিলেই পাবেন স্কুলটা। " স্কুলঘরটা বেশ ছোট। তবে সুন্দর। লাল রঙের ছাদ, চকলেট রঙের বিল্ডিং।

প্রাইম্যারি স্কুল। ছেলেমেয়েরা লাল প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে স্কুলে এসেছে। স্কুলের সামনের কাঁচা পথটার বেশ খারাপ দশা। কাদাপানি জমে অবস্থা কেরোসিন। আমাদের ঝকঝকে নতুন গাড়িটার চেহারা বেশ দর্শনীয় হল কাদা মেখে।

স্কুল ঘরটার সামনে গাড়ি দাড় করালাম আমি। সম্ভবত গ্রামে গাড়ি-টাড়ি তেমন আসে না। কারণ ছাত্র-ছাত্রী-স্টাফরা আমাদের দেখে ছোটখাট একটা ভীড় জমাল স্কুলের বারান্দায়। আমরা নামলাম গাড়ি থেকে। নীলা শাড়ি একটু উচু করে সাবধানে পা ফেলছিল।

কাদা ভালই জমেছে পথে। "আপনাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি?" একজন কমবয়সী শিক্ষক আমাদের কাছে এসে প্রশ্ন করল। "আমরা রাহেলা বেগম নামের একজন শিক্ষিকাকে খুঁজছি। " "রাহেলা বেগম? এ নামে তো কোন টিচার নেই আমাদের এখানে। " "জ্বী, এখন হয়তো নেই।

কিন্তু পনের বিশ বছর আগে নিশ্চয়ই ছিল!" "আপনি নিশ্চিত?" "ইয়েস, আ'য়াম!" "তাহলে আপনি প্রিন্সিপাল স্যারের সঙ্গে কথা বলুন। তিনি ভাল বলতে পারবেন। " প্রিন্সিপাল বেশ প্রবীণ। বয়সের ভারে নুয়ে পডেছে মাথা। তবে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।

আমরা তার কক্ষে ঢুকতে সে ভ্রু কুঁচকে তাকাল! খাতায় কি যেন হিসেব করছিল। আমরা ঢোকায় সম্ভবত তার হিসেবে গরমিল হয়ে গেল। নীলাই কথা বলল তার সঙ্গে। "সরি টু ডিস্টার্ব ইউ স্যার। আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

আপনি কি আমাদের একটু হেল্প করবেন?" ঢাকার কথা হয়তো কাজের গুরুত্বের জন্য বলল নীলা। তবে প্রিন্সিপ্যাল কোন ভদ্রতার ধার দিয়ে গেল না। "হ্যা, বারান্দায় আপনারা একজন স্যারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি শুনেছি। আপনারা রাহেলার খোঁজ করছেন, তাই না?" "আ...জ্বী!" "রাহেলাকে এখানে সবাই বড়মা বলে চেনে।

পঁচিশ বছর আগে সে এই স্কুলে পড়াত। " "ঊনি কি বেঁচে আছেন এখনও?" "বহাল তবিয়তে। " " কোথায় থাকেন তিনি?" "আসার পথে আপনারা কোন খামারবাড়ি দেখেছেন?" "উমম...মনে...। " আমি বললাম, "হ্যা দেখেছি। বিশাল দীঘির পাড়ে একটা ফার্মহাউস টাইপের কি যেন ছিল।

" "হ্যা, ওটাই। ওটার সাথে লাগোয়া একটা দোতলা দালান আছে, সেখানেই আপনাদের রাহেলা থাকেন। " "অনেক ধন্যবাদ। " *** *** *** "বড় মা?" "হ্যা। " "তিনি তো ঘরেই আছেন।

" "একটু দেখা করতে চাই আমরা। " "অপেক্ষা করুন, আমি তাকে বলে আসি আপনাদের কথা। কি হন সে আপনাদের?" "আত্মীয়া। " একটু ইতস্তত করে বললাম। মেয়েটা সমঝদারের ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে চলে গেল।

আমাদের গাড়িটা ফার্মহাউসের সামনে দাড়িয়ে আছে। বিশাল ফার্মহাউস। একপাশে বৃহদায়তন দীঘি। টলমলে কালো জল। কয়েকটা রাজহাস ঘুরছে দীঘির পানিতে।

ফার্মহাউসের পিছনে সবজীর ক্ষেত। প্রচুর পরিমাণে ফুলকপি, টমেটো, মূলা, লালশাক আরও অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে। অনেকগুলো মেয়ে কাজ করছে ক্ষেতে। একটা মেয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। কয়েকজন দীঘির শান বাঁধানো ঘাটে বসে বসে কাপড় ধুচ্ছে।

সবাই মেয়ে। একটা পুরুষও দেখলাম না আশোপাশের চৌহদ্দিতে। একটু অস্বস্তি লাগল। যে মেয়েটা রাহেলাকে ডাকতে গিয়েছিল,সে ফিরে এল একটু পরেই। "আসুন আপনারা।

" নীলাকে নিয়ে মেয়েটার পিছু পিছু এগোলাম। সিড়ি ভেঙে দোতলার একটা স্টাডিরুমে নিয়ে গিয়ে বসাল সে আমাদের। সাঁজানো গোছানো স্টাডিরুম। বইয়ে ঠাসা। দস্তয়ভস্কি, টমাস হার্ডি, মার্ক টোয়েন, এরিক মারিয়া, আইজ্যাক অসিমভ, আলবেয়ার কাম্যু, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, সব ক্ল্যাসিক কালেকশান।

গত বিশ-ত্রিশ বছরে প্রকাশিত কিছু দেখলাম না। দেয়ালে একটা বড়সড় পেইন্টিং ঝুলানো। ফার্নান্দো বেঁতেরোর আঁকা, ডেথ অব লুইস শ্যালে। মোটাসোটা লুইস শ্যালে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাচ্ছে, সেই দৃশ্য! বেশ সৌখিন মানুষ মনে হচ্ছে রাহেলা বেগমকে। পনের মিনিট পেরিয়ে গেল।

"উনি কি আসবেন?" নীলা বলল। আমি উত্তর দিতে যাব, এমন সময় দরজা থেকে একটা কন্ঠ বলে উঠল, "আপনারা আমার কাছে এসেছেন?" রাহেলা দাড়িয়ে আছে দরজায়। তাকে দেখে আমরা মোটামুটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। শাড়ী পড়া মধ্যবয়স্কা কোন মহিলাকে আশা করেছিলাম আমরা। রাহেলা একদমই তা নয়।

তার পরণে ধুসর প্যান্ট। গায়ে কয়েক সাইজ বড় ঢোলা একটা শার্ট। দেখে কোনমতেই পয়ত্রিশ-চল্লিশের বেশি মনে হয় না। যদিও আমার হিসেব মতে তার বয়স বর্তমানে ৪৮ ! রাহেলার ঠোঁটে সিগারেট। নিজেও স্মোক করি বলে বুঝতে পারছি, সে একজন চেইন স্মোকার।

এ বয়সেও অসম্ভব রকমের সুন্দরী রাহেলা বেগম। ফিটফাট জিমন্যাস্টিক শরীর। গাঁও গেরামে এত আধুনিকতা একটু যেন বেমানান। নাক দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সে বলল, "আপনারা বলেছেন আপনারা আমার আত্মীয়। তাই কি?" আমি বললাম, "জ্বী, তাই।

" "কেমন আত্মীয়?" আমি তার চোখে চোখ রেখে বললাম, "আপনি আমার মা। " রাহেলার শক-নার্ভগুলো নিশ্চয়ই অনেক ভাল, আমার কথা শুনে তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া হল না। যেন অজানা অচেনা একটা পুরুষ এসে কাউকে মা দাবী করে বসতেই পারে, এতে কোন "আজ থেকে কয়েকযুগ আগের কথা। ১৯৭১ সালের ১৭ ই জুলাই। আপনাদের গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করল।

৪৭ জন নরনারীকে হত্যা করল তারা, তুলে নিল ১৯ জন তরুণীকে। আপনি সেই ঊনিশজনের একজন। আপনার বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। তারপর....ইউ গট রেইপড ফর সেভরেল টাইমস । দু'দিন পর আপনি এক পাকিস্তানী কর্পোরালের গলায় ছুরি চালিয়ে পালিয়ে এলেন।

আপনার বাবা আপনাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেল। আপনি প্রেগন্যান্ট হয়েছিলেন ঐ ঘটনায়। দিল্লীর একটা হসপিটালে একটা পুত্রসন্তানের জন্ম দেন আপনি...আমাকে। কলঙ্ক বয়ে বেড়ানোর ইচ্ছে ছিল না আপনার একদমই। এক প্রবাসী বাঙালী নিঃসন্তান দম্পতিকে দত্তক দিলেন আপনি সন্তানটা।

তারপর হাড়িয়ে গেলেন চিরতরে। আমিই সেই হতভাগা সন্তান!" রাহেলা বেগম নির্লিপ্ত হয়ে সব শুনল! বলল, "হতভাগা? হতভাগা ভাবছ কেন নিজেকে? তুমি আমার কাছে থাকলে যে ফিউচার পেতে, তার চেয়ে দশগুন ভাল একটা ফিউচার পেয়েছ এখন। যাক এসব পুরানো কাসুন্দি । কেন এসেছ আজ হঠাৎ?" আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। আসলেই তো, কেন এসেছি আমি? "গত সপ্তাহে আমার বিয়ে হয়েছে।

আপনার দোয়া নিতে এসেছি!" "আমার দোয়া? আমি তো নাস্তিক! দোয়া টোয়া এসব বুলশিটে আমি বিশ্বাস করি না। " "কেন?" "যেদিন সাতজন নরপশু আমাকে ধর্ষণ করল নির্মমভাবে, সেদিন যে ঈশ্বরকে ডেকেও কোন সারা পাইনি, সেই ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন ছিল না আমার। আর এমনিতেও, মাহাত্মা গান্ধীর সেই কথাটা শোনোনি? গড হ্যাজ নো রিলিজন!" আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম! "কেমন আছেন আপনি এই গ্রামে?" "এই তো ভালই। বাস্তুহাড়া, নির্যাতিতা সব গরীব মেয়েদের নিয়ে এই ফার্মটা গড়ে তুলেছি। বেশ আছি।

" "ও..আচ্ছা!" "তুমি রাগ করে নেই তো আমার উপর?" "নাহ!" "মিথ্যে বলছ কেন বাপ্পী? তোমার দেখেই বোঝা যাচ্ছে!...এ কি তুমি কাঁদছ?" রাহেলার গলায় বিদ্রুপ এখনো! নীলা আমার কাঁধে হাত রাখল। আলতো করে চাপ দিল। আমি একটু ধরা গলায় রাহেলাকে বললাম, "দেখুন, আমার পালক বাবা-মা আমার জন্য অনেক করেছেন। তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তারা আপনার কথাও লুকোননি আমার কাছে।

সব শুনেছি, মেনে নিয়েছি। কিন্তু ভীষণ অভিমান হতো আপনার কথা ভেবে। একবারও কি দেখা করতে পারতেন না আপনি?" "আমি তোমার লাইফে ইন্টারাপ্ট করতে চাইনি। তাছাডা, তোমাকে লালন-পালন করার মতো শারীরিক বা মানসিক অবস্থাও ছিল না আমার সেই সময়ে। মাত্র তো কিশোরী আমি তখন! আই হোপ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যানড।

" আমি হঠাৎ নীলার হাত ধরে উঠে দাড়ালাম। "আমরা তাহলে চলি। " তিনি কিছুই বললেন না, চুপচাপ সিগারেট ফুঁকতে লাগলেন। আমার ভীষণ অভিমান হল তার নিষ্ঠুরতা দেখে। দরজার কাছে চলে এসেছি, এমন সময় তিনি বললেন, "ইজ দেয়ার এনিথিং আই মে ডু ফর ইউ ইয়ংম্যান?" আমি "না" বলতে গিয়ে থেমে গেলাম।

একটু দ্বিধা নিয়ে বললাম, "আপনি আমার সাথে, ঢাকা গিয়ে থাকবেন প্লীজ?" একরাশ ধোঁয়ার মেঘ থেকে তিনি বলে উঠলেন, "সরি! নট পসিবল! আর কিছু?" "নো থ্যাংকস!" *** *** *** আমরা নিচে নেমে এলাম । গাড়ি স্টার্ট দেব, এমন সময় রাহেলা বেগম দোতলার বারান্দা থেকে বলে উঠলেন, "এই বাপ্পী শোনো!" আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে দিলাম, "বলুন!" "আমার ড্রাইভিং করতে খুবই ভাল লাগে। তুমি যদি ঢাকা পর্যন্ত আমাকে ড্রাইভিং করতে দাও, তাহলে তোমার সাথে ঢাকায় থাকতে রাজি আছি! কি বল?" আমি অবাক হলাম। অবাক হয়েই হ্যাসূচক মাথা দোলালাম!আরো অবাক হলাম যখন দেখলাম একটা কাজের মেয়ে মাথা নডানোর সঙ্গে সঙ্গে একটা স্যুটকেস আমাদের গাড়িতে তুলে দিল। তার মানে রাহেলা বেগম প্রস্তুত হয়েই ছিলেন আমার সঙ্গে আসার জন্য।

তিনি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই আমি তাকে জডিয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। বুকের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো একসাথে বের হয়ে এল। "মা, তুমি এতবছরে একবারও আমাকে দেখতে এলে না কেন?" মা এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,"বোকা ছেলে,এত বড় ছেলের কাঁদতে হয়?" মা ড্রাইভিং শুরু করতে আমার মনে হল, তিনি চমৎকার ড্রাইভিং করেন। নাহ, আমার মা আসলেই সেরা মা! (সমাপ্ত) (এই গল্পটা আমার অলসতম সময়ের লাগামহীন কল্পনা।

তাই গল্পটা সিরিয়াসলি না নেওয়ার অনুরোধ করছি। ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.