আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেইসবুক স্ট্যাটাসে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদি ফেইস



মনোযোগের সাথে ফেইসবুক স্ট্যাটাসগুলো লক্ষ্য করলে একাউন্টধারী ব্যক্তির রাগ-ক্ষোভ-অভিমান-মনোভাব-আত্মরতি-অহং ইত্যাদি নানান বৈশিষ্ট্যের মধ্য দিয়ে একাউন্টধারী ব্যক্তির সাধারণ কিছু প্রবণতার ধারণা পাওয়াটা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের বর্তমান শাসক দলটির ফেইসবুক একাউন্ট আছে কি-না জানিনা, তবে ধর্মীয় অনুভূতির উপর আঘাত, নেতা-নেতৃর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে কার্টুন অংকন ইত্যাদি অযুহাতে একেবারে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ার মধ্যে দিয়ে শাসক শ্রেণীর যে ”স্ট্যাটাস”টি দেখা গেল সেটা কিন্তু ফ্যাসিবাদেরই চেহারা। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এই ফ্যাসিবাদি স্ট্যাটাস কিন্তু এদের কিংবা এদের সহযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলের জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। বাকশাল কায়েম, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতন, ”জাতীয়” স্বার্থে পত্রপত্রিকা এবং রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ থেকে শুরু করে পরবর্তী সামরিক শাসনামালে রাজনীতি এবং মত প্রকাশের অধিকারের উপর নিয়ন্ত্রণ কিংবা হালের ”গণতান্ত্রিক” আমলে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার, কিংবা বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন RAB কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড, বিভিন্ন দলীয় মিডিয়ার দখলদারিত্ব কায়েম করা কিংবা বিপক্ষ দলের মিডিয়ার উপর আক্রমণ, মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া কিংবা একেবারে সাম্প্রতিককালে বিডিআর বিদ্রোহের পরপর জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে ইউটিউব বন্ধ করা, প্রতিপক্ষের টেলিভিশন ”চ্যানেল ওয়ান”, জনপ্রিয় টকশো বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা বিরোধীদলের পক্ষের সংবাদপত্র ”আমার দেশ” কে নানান অযুহাত তুলে বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি শাসক শ্রেণীর এক ও অভিন্ন ফ্যাসিবাদী চেহারা স্পষ্ট করে তুলে ধরে। মাঝে মাঝে এসব ঘটনা আমাদের মাঝে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করলেও সংকটগ্রস্থ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর ফ্যাসিবাদ কিন্তু ধারবাহিক একটা বৈশিষ্ট্য।

হিটলার মুসোলিনির ধ্রুপদি ফ্যাসিবাদী প্রবণতাগুলো যদি লক্ষ করি তাহলে বাংলাদেশ নামের ”গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রে সেই ফ্যাসিবাদের একটা স্রোত সর্বদাই প্রবাহমান দেখতে পাব। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হলো গণতন্ত্র। কিন্তু পুঁজিবাদ কি তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে সক্ষম? গণতন্ত্র তত্ত্বগতভাবে হলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার সমতায় বিশ্বাস করে, গণতন্ত্রের চোখে এক মানুষ এক ভোট, সবার ভোট সমান। অন্যদিকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হলো অসমতা, অসমতা থাকে বলেই গুটি কয়েক পুঁজিপতির মালিকানায় থাকে সমাজের বেশিরভাগ সম্পদ এবং বেশিরভাগ মানুষের শ্রমের ফল মেরে দিয়েই পুঁজিপতির মুনাফার চক্র চলমান থাকে, পুঁজিবাদ টিকে থাকে, বিকশিত হয়। ফলে তত্ত্বগতভাবেই, যে পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গুটি কয়েক মালিকের স্বার্থ রক্ষা করেই টিকে থাকে তার পক্ষে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সমতার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব হয় না।

ফলে মালিক শ্রেণীর স্বার্থে পুঁজিবাদ তার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিশ্র“তি যেমন জনগণের সম অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদির উপর ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করতে থাকে। আইন-আদালত, একাডেমিক কারিকুলাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের উপর মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণ বা হেজিমনির মাধ্যমে পুঁজিবাদ পরোক্ষভাবে এই নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ বজায় রাখে। কিন্তু সংকটগ্রস্থ হলে এই পরোক্ষ ভাবের বিলাসিতা বাদ দিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী ডাইরেক্ট একশানে চলে যায়। এই ডাইরেক্ট একশান যখন স্রেফ সামরিক ধাঁচের জবরদস্তির মাধ্যমে চালানো হয় তখন সেটাকে আমরা সামরিক শাসন বা একনায়কতন্ত্র বলি, কিন্তু এই চাপিয়ে দেয়ার ব্যাপারটির সাথে যদি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, কোন ধর্মীয় অনুভূতি, দেশপ্রেম, বিশেষ জাতীয়তাবোধের আবেগ, জরুরী অবস্থায় জরুরী কর্তব্যবোধের প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদি মিশিয়ে দেয়া হয়, তখন সেটা হয়ে উঠে ফ্যাসিবাদ। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত/উন্নয়নশীল বুর্জোয়া রাষ্ট্রে সংকট প্রায় সর্বকালীন একটা বৈশিষ্ট্য বলে এই ফ্যাসিবাদী চেহারা বেশির ভাগ সময়ই দৃশ্যমান।

এই ফ্যাসিবাদ কখনও জাতীয় সমস্যা/সংকটের মূল থেকে দৃষ্টি ফেরানোর জন্য একটা সার্বক্ষণিক সংকটের আবহ, জাতীয় নিরাপত্তার জুজু কিংবা সিরিয়াল কিলার ধরা থেকে শুরু করে জাতীয় শত্রু আবিস্কার ইত্যাদি নানান ধরনের ডাইভারশান তৈরী করে, জাতীয়তাবাদের রূপ ধরে সংখ্যালঘু দমন করে, জরুরী এবং অনিবার্যতার দোহাই দিয়ে মৌলিক অধিকার হরণ করে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে ইত্যাদি। শুধু হিটলারের জার্মানি কিংবা মুসোলনির ইতালি নয় আজকের ”উন্নত” আমেরিকা থেকে শুরু করে ”অনুন্নত” বাংলাদেশ সর্বত্রই পুঁজিবাদি রাষ্ট্রের এই ফ্যাসিবাদী চেহারা চোখে পড়ে। ফ্রি ইনকোয়েরি পত্রিকায় ড: লরেন্স ব্রিট হিটলারের জার্মানি, মুসোলনির ইটালি, ফ্রাংকোর স্পেন, সুহার্তোর ইন্দোনেশিয়ায় ফ্যাসিবাদি রাষ্ট্রের চরিত্র পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ফ্যাসিবাদের ১৪ টি বৈশিষ্ট্যের কথা লিখেছিলেন। বৈশিষ্ট্যগুলো সংক্ষেপে এরকম: ১) জাতীয়তাবাদী জিগির: শাসক শ্রেণী কর্তৃক জাতীয়তাবাদী নানান শ্লোগান, গান, প্রতীক, পতাকার অবিরাম ব্যবহার। পতাকা সর্বত্রই দৃশ্যমান, জাতীয় প্রদর্শনী কিংবা ব্যাক্তিগত পোশাকে পতাকার প্রতীকের ব্যাবহার।

২) মানবাধিকার লংঘন: কোন বিশেষ শত্র“র ভয় কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার অযুহাতে মানবাধিকার লংঘন করা হয়। জনগণকে বোঝানো হয়, বিশেষ প্রয়োজনে কিংবা সংকটে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে হত্যা, নির্যাতন, জেল-জুলুম জায়েজ। ৩) সাধারণ শত্রুর আবিস্কার/কোন বলির পাঠার ব্যাবহারের মাধ্যমে একতার অনুভূতি তৈরী করা: সাধারণ শত্রু আবিস্কার করা হয় যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা হয়, এরকম সাধারণ শত্র“ হলো- ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু, সন্ত্রাসবাদী, সমাজতন্ত্রী কিংবা কমিউনিষ্ট। ৪) সামরিক বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব: দেশে নানা সংকট থাকা সত্ত্বেও সামরিক খাতে বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়। সামরিক পেশাকে গৌরবান্বিত করে তুলে ধরা হয়।

৫) লিংগ বৈষম্য: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র পুরুষতান্ত্রিক, রাষ্ট্রে চলমান লিংগ বৈষম্য আরো দৃঢ় হয়, বিবাহ-বিচ্ছেদ, গর্ভপাত, সমকামিতা ইত্যাদি দমন করা হয় এবং রাষ্ট্র পরিবারের চূড়ান্ত অভিভাবক হিসেবে আবির্ভূত হয়। ৬) নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম: গণমাধ্যম কে কখনও সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করা হয় আর কখনো পরোক্ষভাবে সরকারী নিয়মকানুনের মাধ্যমে কিংবা সরকারের পক্ষের লোক জনের বেশি বেশি উপস্থাপনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। সবচেয়ে বেশি সেন্সরশিপ দেখা যায় যুদ্ধের সময়। ৭) জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়াবাড়ি: জাতিয় নিরাপত্তার ভয় দেখিয়ে রাষ্ট্র জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করে। ৮) ধর্ম এবং রাষ্ট্র একাকার: ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণী দেশের প্রধান ধর্মকে ব্যাবহার করে জনমত প্রভাবিত করার কাজে।

৯) কর্পোরেট ক্ষমতার প্রতিপালন: শিল্প এবং ব্যাবসায়িক পুঁজি সরকারকে ক্ষমতায় বসায় এবং সরকার এবং পুঁজিপতিদের মধ্যে একটা পারস্পরিক উপকারী সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১০) শ্রমিক শক্তির উপর দমন-পীড়ন: শ্রমিকের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা যেহেতু শাসক শ্রেণীর প্রতি হুমুকী স্বরূপ তাই শ্রমিক সংগঠন বিলুপ্ত করা হয় বা তাদের উপর দমন-পীড়ন চালানো হয়। ১১) বুদ্ধিবৃত্তি এবং শিল্প সাহিত্যের প্রতি বিবমিষা: ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা এবং একাডেমেশিয়ানদেরকে শত্র“ হিসেবে ধরা হয় এবং শিল্প-সাহিত্যে মুক্তচিন্তার প্রকাশকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়। ১২) অপরাধ এবং শাস্তি বিষয়ক বাড়াবাড়ি:ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর থাকে অসীম ক্ষমতা। দেশপ্রেমের নামে নাগরিকেরা প্রায়শই পুলিশি নির্যাতন এবং নাগিরক অধিকতার হরণকে মেনে নিতে থাকে।

১৩) ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি: ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে অনেক বন্ধু ও ভাই বেরাদররাই যেন শাসন-প্রশাসনের কাজ কর্ম চালায়। ক্ষমতাবানদের দ্বারা জাতীয় সম্পদ এবং অর্থ-কড়ি লুটপাট ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ১৪) ভূয়া নির্বাচন: ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে প্রায়ই ভূয়া নির্বাচন হয়। অনেক সময় পরোক্ষভাবে প্রচার প্রচারণা, আইনী নিয়ন্ত্রণ, মিডিয়ার প্রভাব কিংবা বিরোধীদের একেবারে নির্মুল করে হলেও নির্বাচন জয় ছিনিয়ে আনা হয়। ফ্যাসিবাদের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো মাথায় রেখে আমরা যদি বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, দেশপ্রেম, বাঙালি/বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের রাজনৈতিক বেচা-বিক্রি, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে জনগণের মতামতকে প্রভাবিত করতে ধর্মের ব্যবহার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ কিংবা জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থী দমনের নামে বিশেষ ক্ষমতা আইন কিংবা বিশেষ বাহিনী র‌্যাবের ব্যাবহার, ক্রসফায়ার, মানবাধিকার ল্ঘংন, সামরিক খাতের প্রাধান্য, লিংগ বৈষম্য, গণমাধ্যমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ, রাষ্ট্রের কাছে শিল্প ও ব্যাবসায়িক পুঁজির প্রাধন্য, শ্রমিক শ্রেণীর উপর চালানো শোষণ ও জুলুম-নির্যাতন এবং আইন করে তাদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার হরণ, ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতি, ভূয়া নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ ইত্যাদি সকল ফ্যাসিবাদী প্রবণতাই খুব স্পষ্টভাবে বিরাজমান।

ফলে যে বুর্জোয়া শাসক শ্রেণী যুগ যুগ ধরে এদেশের কোটি কোটি নাগরিকের উপর ফ্যাসিবাদের খড়গ চালাচ্ছে, তার পক্ষে আট-নয় লক্ষ ফেইসবুক ব্যবহারকারীর অধিকার হরণ কিংবা দুই চারটা টেলিভিশন চ্যানেল বা পত্রিকা বন্ধ করাটা খুব অস্বাভাবিক বা ব্যাতিক্রমী ব্যাপার নয়। ফেইসবুক বন্ধ কিংবা টেলিভিশন/পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার ফলে বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধে যে ক্ষুব্ধতায় আমরা ফুঁসে উঠেছি, সেই ক্ষুব্ধতা যতদিন না এই ফ্যাসিবাদি গোটা ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে চালিত হয়ে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে না তুলছে ততদিন মাঝে মাঝেই শাসক শ্রেণীর এই ফ্যাসিবাদি চেহারার নানান রুপ আমাদের দেখে যেতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।