আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনে রবে কিনা রবে আমারে

নিশীথ রাতের বাদল ধারা

মনে রবে কিনা রবে আমারে সাতবছর পর ঢাকায় ফিরে এসে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। তবে মা বাবার খুশি, হাসিমাখা মুখগুলো দেখে মনে হচ্ছে আসার সিদ্ধান্তটা ঠিকই ছিল। মা তো কি করবে, কি খাওয়াবে, কি কিনে দেবে—এসব নিয়ে অস্থির। আজকে রাতে আবার ছোট ফুপ্পী, খালামনিদের দাওয়াত দিয়েছে। ভাবছি আজকে সবার মাঝখানে আবার সেই অসস্তি বিব্রত করবে কিনা।

যার ভয়ে একদিন দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। অনিকের সাথে ডিভোর্সের পর-পরই পালিয়েছিলাম আমেরিকায়। ভাগ্যিস, গ্রিনকার্ডটা ছিল। মানুষের আন্তরিক সান্তনাও তখন গাত্রদাহের সূচনা করত। মানষিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত হয়ে গেছিলাম, কেউ ফিসফিসিয়ে কথা বললেই সন্দেহ হত আমাকে নিয়ে কোন রসালো আলোচনা করছে।

ওখানে গিয়েও ধাতস্ত হতে অনেকদিন লেগেছে। আসলে মন্টেসরির চাকরিটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমাকে, ইনফ্যাক্ট এখনও সেইন রাখছে। সারাদিন কতগুলো দেব শিশুর সাথে খেলে, ওদের শিখিয়ে দিনটা পার হয়ে যায়, ভুলেই যাই যে আমি মা নই, কোনদিন হবার সুযোগও নেই। সকালে নাস্তার টেবিলে বসে খেয়ে চা খেতে খেতে আবোল তাবোল ভাবছিলাম। হয়তো অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছিলাম।

মার ডাকে ঘোর কাটল। “কিরে কি ভাবছিস? শোন, ভাবছি আজকে ডিনারে মোরগপুলাউ, এচোড়ের কোরমা, ঝাল খাসি, চিংড়ির মালাইকারি, ইলিশমাছ আর বেগুন ভাজা করব। শেষে কাস্টার্ড আর ঘরে পাতা দই ডেজার্ট। ঠিক আছে না? কাশ্মিরী আচার বানিয়েছিলাম সেটা আর সালাদও থাকবে। “ মা একনিশ্বাসে বলে গেল।

এত উচ্ছল কবে দেখেছি মাকে মনে পড়ে না। ছেলেবেলার মত মায়ের গলা জড়িয়ে ধরার লোভ সামলে উচ্ছল গলায় বললাম, “তুমি তো লঙ্কাকান্ড বাধিঁয়ে ফেলছ! হাই ফাই মেন্যু আম্মু, সব আমার ফেইভারেট—সত্যি, এমন চললে ফিরে গিয়ে আবার যোগব্যায়ামের ক্লাসে ভর্তি হতে হবে!” “কি যে বলিস তুই। খাস তো পাখির মত। শুকিয়ে একেবারে কাঠি। কি যে সালাদ টালাদ খেয়ে থাকিস তুই।

দেশে এসেছিস কয়েকটা দিনের জন্য-ঠিক মত খা-দা। শোন, আমাকে একটু বেরুতে হবে। কাস্টার্ড পাউডার নেই আর শশা, লেবু এসবও আনতে হবে। “ “আমি এনে দেই, তোমার কত কাজ। সাতাশ নাম্বারে মীনাবাজারেই তো পাওয়া যাবে তাইনা?” “হ্যা তা যাবে।

কিন্তু তুই যাবি? পারবি?” এরপরে হেসে ফেলা ছাড়া আর গতি কি। আম্মুও হেসে ফেললেন। “ঠিক আছে যা। গাড়ি নিয়ে যাস। “ ট্রলিতে কাস্টার্ড পাউডারের প্যাকেটটা রাখতে গিয়ে মনে পরে গেল।

অনিক খুব কাস্টার্ড পছন্দ করত। মার রান্না সব খাবার খুব খুশী হয়ে খেত আর আমাকে বলত মায়ের একটা গুনও তো পেলে না! কি অদ্ভুত একটা ছেলে, কোনদিন আমার মধ্যে ভাল কিছু দেখলে না! এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে। আমার মিসক্যারেজের পর থেকেই আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। আমি একটা বাচ্চার জন্য তখন পাগল হবার জোগাড়, ও সেসময় দূরে সরে যেতে লাগল, কাজের ব্যস্ততার অজুহাত দিত, এত উপেক্ষা করত! তার উপরে ওদের বাসা থেকে দিন রাত বাচ্চা হওয়া নিয়ে প্রেসার। শাশ্বড়ি হুজুর, তাবিজ হোমিওপ্যাথি কিছুই বাদ রাখেননি।

দিনরাত আমার সামনে বংশরক্ষা নিয়ে মাতম। ঈঙ্গিত করতেন আমার শারিরিক কোন অক্ষমতা আছে। অনিক কোনদিন বলেনি, এসব নিয়ে কেন আলোচনা কর তোমরা, বিভার কোন সমস্যা নেই বরং আমার আছে। আমাদের প্রতিরাতের ঝগড়া নিয়েও কত কটুক্তি। ওনার ছেলের জীবনে শান্তি নাই, শিক্ষিত চাকরিওয়ালি বিয়ে করানো ভুল হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

জীবন অসহ্য হয়ে গেছিল। আর পারছিলাম না। ওর মায়ের নামে যেদিন প্রথম বললাম যে উনি আদরের ভান করেন কিন্তু আমাকে আদতে পছন্দ করেন না, সেদিন অনিক এত রেগে গেল, এত অপমান করল, অশ্রাব্য গালিগালাজ করল, ঘরের জিনিষপ্ত্র ভেঙে একাকার। যেন আমাকে মারতে না পেরে নির্জীব জিনিষের উপর আক্রোশ মেটাচ্ছে। সেদিনই অত রাতে এক বস্ত্রে বের হয়ে এসেছিলাম—আর ফিরে যাবার ইচ্ছে বা রুচি হয়নি।

কি যে সব দিন গেছে! একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল বুক চিরে। ট্রলী ঠেলে পরের আইলে ঢুকতেই একটা হার্টবিট মিস করলাম। অনিক। যার কথা ভাবছিলাম, সেই মুর্তিমান দাঁড়িয়ে আমার সামনে। কাধেঁ ভিষন মিস্টি বছর তিন বা চারেকের একটি মেয়ে ওর গলা জড়িয়ে বসে আছে-চুলের মুঠি ধরে।

দুজনে কি নিয়ে খুব হাসছে। অনিককে দেখে সেই তিক্ততার স্মৃতিগুলো চারদিক গ্রাস করে ধেয়ে এল না—দম আটকাল না আগের মত। চোখ নামিয়ে ওদের এড়িয়ে যাবার জন্য তাড়াহুড়ো করে সামনে এগুচ্ছি, তখনি ওর প্রশ্নে থমকে দাঁড়াতে হ্ল, “বিভা না! কেমন আছ বিভা?” আবার তাকালাম ওর দিকে, এড়ানো গেল না এই আলাপচারিতা। “ভাল। তুমি?” “আমিও ভাল।

কবে এসেছ?” “এইত, সপ্তাহ খানেক। এটা তোমার মেয়ে? খুব মিস্টি হয়েছে। “ “হ্যা। আমার জান। “ ওর গলার উচ্ছলতা কেন যেন মন খারাপ করিয়ে দিচ্ছিল।

“তোমার ছেলে মেয়ে? তুমি বিয়ে করনি বিভা?” ম্লান হেসে মাথা ঝাকালাম। “নাহ! বিয়ে ব্যাপারটার উপর অভক্তি এসে গেছিল। বাসা থেকে অনেক জোড়াজুড়ি করেছিল অবশ্য। ন্যাড়া বেল তলাতে কয়বার যায় বল! আমাদের কথাই ধর, এইযে এত বছর প্রেম করে, পরিবারের মতের বিরুদ্ধে বিয়ে করলাম, সেটাই কত তিক্ততায় শেষ হল। আর এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় বিয়েতে প্রেম-ট্রেমের তো বালাই নেই, পুরোটাই হবে এক ধরনের সমঝোতা---সেটা যে খুব মধুর হবে সে আশা করা নেহাতই মুর্খতা।

ও পথ তাই আর মাড়াইনি। কি, হাসছ কেন?” “তোমার সব কিছু অতি বিশ্লেষন করার টেন্ডেন্ন্সিটা এখনো আছে। “ হাসি আসলেই সঙ্ক্রামক। হেসে ফেললাম আমিও। “স্বভাব কি বদলায় অনিক? যাক গে, আই হোপ তুমি সুখি হয়েছ।

“ কি ভাবলে এক সেকেন্ড তারপর তিক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বললে, “হ্যাঁ, তা বলতে পার। “ আমি হাসলাম। “ভাল। দেখা হয়ে ভাল লাগল অনিক। ভাল থেক।

আজ যাই। “ “হু। তুমিও ভাল থেক। “ বলেই আমার হৃদয় একসময় তোলপাড় করত যে হাসিতে, সেই হাসি হাসল ও! হঠাৎ কোথা হতে অস্থিরতার ঢেউ এসে দুলিয়ে দিল। ওদের পাশ কাটিয়ে চলে আসছি, পিছন থেকে আবার ডাক, “আমার মেয়ের সাথে যে কথা বললে না? এট-লিস্ট ওর নামটা জেনে যাও।

“ বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হ্ল, মুখে হাসি ফুটিয়ে পিছন ফিরে লক্ষীমন্তমেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ওহ সরি, কি নাম তোমার আম্মু?” মেয়েতো বাবার চুল নিয়ে খেলছেই, বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপও করলে না আমার প্রশ্নে। অনিকই উত্তর দিলে, “ওর নাম হৃদি, হৃদি। ভালবাসা ফুরায় হৃদি--মরে না। “ বলে স্থানুর মত আমাকে রেখে চলে গেল পিতা-কন্যা। আমাকে ভালবেসে দেয়া ওর নাম, ওর মেয়েকে দিয়েছে কেন অনিক? কেন? সত্যিই কি ভালবাসা ফুরায়, তার দাগ কখন মুছে না?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।