আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. হুমায়ুন আজাদের জীবনী, ২২তম পর্ব

সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা

বহুমাত্রিক সাহিত্য, তৃতীয় অংশ নারী গ্রন্থটি লিখতে তাঁর সময় লেগেছে এক বছর কয়েক মাস। নারীবাদ ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর প্রিয় বিষয়। তবে ১৯৯০-উৎসাহ বোধ করেন নারী সম্পর্কে বই লেখার। প্রথাগত সমাজকে তিনি আক্রমন করে আসছিলেন অনেক দিন ধরে। তিনি এক সময় বুঝতে পারেন একে ব্যাপকভাবে আক্রমণ করা সম্ভব শুধু নারীকে বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে।

তিনি বলেছেন, 'বর্তমান সমাজ ও সভ্যতা মানুষের উপযুক্ত নয়, তা অর্ধ মানুষের উপযুক্ত। ' এই বইটিতে তিনি কোনো অভিনব তথ্য উদঘাটন করেন নি; প্রচুর তথ্য এ বিষয়ে মেলে, তিনি সেগুলোকে তাঁর মতো করে তাত্ত্বিক কাঠামোতে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর আলোচিত প্রবন্ধের বই ‘নারী’ ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হলে তিনি মৌলবাদীদের রোষানলে পড়েন। বইটিতে নারীর প্রতি যুগে যুগে নিপিড়নের কথা বলা হয়েছে। মৌলবাদীদের দাবীর প্রেক্ষিতে সরকার ১৯৯৫ সালে বইটি নিষিদ্ধ করে।

তবে ২০০০ সালে আইনী লড়াইতে বইটি মুক্ত হয়। নারী নিষিদ্ধ হলে তিনি অনুবাদ করেন 'দ্বিতীয় লিঙ্গ'। হুমায়ুন আজাদের কিশোর সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে- 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না', 'আব্বুকে মনে পড়ে', 'আমাদের শহরে একদল দেবদূত', 'বুক পকেটে জোনাকী পোকা', 'অন্ধকারে গন্ধরাজ'। এছাড়া তিনি একটি ইংরেজি বই লিখেছেন কিশোরদের জন্য- 'আওয়ার বিউটিফুল বাংলাদেশ'। ইংরেজিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা সেরা বই।

কিশোরদের জন্যও তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা অনেক নয়, কিন্তু যা লিখেছেন তা কিশোর উপরোগী মহান সাহিত্য। লেখাগুলো যেমন সুখপাঠ্য, তেমনি সুললিত ও দেদীপ্যমান। এখানেও পাওয়া যাবে সত্য ও সৌন্দর্যের অনাবিল চিত্র। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার সেতু বন্ধনে কিশোরদের দাঁড় করান তিনি। এখান থেকেই কিশোররা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং অবশ্যই প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে শিখবে।

এ এক স্বপ্নিল সৌন্দর্যতা ও সৃজনশীলতা। কিশোরদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। তাদের আলোকিত উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে। পংঙ্কিল সমাজ ব্যবস্থা ভেঙ্গে মানবিক চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে সুদূরপ্রসারী আলোকিত পথে পা বাড়ানোর উপযোগী হয়ে উঠবে কিশোর। 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' বইটিতে উঠে এসেছে হুমায়ুন আজাদের শৈশব-কৈশোর কাল।

এটা কিশোরদের নিয়ে মহান এক উপন্যাস হতে পারতো। উপন্যাসের চরিত্র না থাকলেও তাঁর বইটি হয়ে উঠেছে চিত্তসঞ্চালনশীল এক মহান কিশোরগ্রন্থ। হুমায়ুন আজাদ তাঁর কিশোরকালকে জীবন্ত করে তুলে এনেছেন বইটিতে। এরচেয়ে সাবলিলতা, এর চেয়ে সত্য সৌন্দর্য বাংলা সাহিত্যে বিরল। পুরো বইটিতেই রয়েছে উপমার ফুলঝুড়ি।

রয়েছে অনেকগুলো অসাধারণ হৃদয়গ্রাহী বাক্য। তাঁর আব্বুকে মনে পড়ে এক ভিন্ন রকম কিশোর উপন্যাস। এক আব্বু যিনি ডাইরীতে লিখে গেছেন পুত্রের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, তীব্র ভালবাসার কথা। যিনি ফিরে আসেন নি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিশোররা বিশেষ ধারণা পাবে।

বইটি পড়লে বড়দের চোখও ভিজে উঠে। 'আমাদের শহরে একদল দেবদূত'- এক নষ্ট শহরের কষ্টের গল্প। একদল দেবদ–ত সেই শহরকে উদ্ধার করেছিল। আমাদের শহরগুলো নিয়েও আশা জাগিয়ে তুলে। 'বুক পকেটে জোনাকী পোকা' গদ্যে ও পদ্যে মিশেল দেয়া এক চমৎকার বই।

তাঁর ছোট মেয়ে স্মিতাকে উৎসর্গ করা একটি ছড়া রয়েছে- নাম 'শুভেচ্ছা'। ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো / ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালী গান, ভালো থেকো / ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা / ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা.. .. হুমায়ুন আজাদ এক পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে ড. আহমেদ শরীফ, শামসুর রাহমান, আব্দুর রাজ্জাক ও শওকত ওসমান এর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন । এই সাক্ষাৎকারগুলো নিয়ে একটি বহুল পঠিত বইও রয়েছে। কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ বই- 'শামসুর রাহমান: নিঃসঙ্গ শেরপা'। এই প্রথম কোন জীবীত কবিকে নিয়ে আরেক প্রধান কবির বই।

এখানে তিনি শামসুর রাহমানকে প্রধান কবি হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের নিজ রচিত সাহিত্যের মতোই তাঁর সাক্ষাৎকার আকর্ষণীয়। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- 'আতায়ীদের সাথে কথোপকথন' এবং 'একুশ আমাদের অলিখিত স্বাধিনতা দিবস'। মাসিক বলাকা তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়ে সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে ৯৪ পৃষ্ঠার একটি ম্যাগাজিন বের করে। পরবর্তীতে এই সাক্ষাৎকারটি বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে- 'হুমায়ুন আজাদ এই বাংলার সক্রেটিস' নামে।

মহাবিশ্ব নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভ্রান্ত ধারণা দ–র করতে লিখেছেন- 'মহাবিশ্ব'। তিনি বিচিত্র বিষয় নিয়ে বই লিখেছেন। তাঁর 'প্রবচনগুচ্ছ' ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। এখানেও তিনি তীব্র কটাক্ষ করেছেন প্রচলিত অনেক বিশ্বাস ও প্রথাকে। যেমন- (১) সাহিত্য জীবনের মতোই আপত্তিকর।

(২) মানুষ সিংহের প্রশংসা করে কিন্তু গাধাকেই পছন্দ করে। (৩) মানুষ যতদিন অসৎ থাকে ততদিন তাঁর কোন শত্রু থাকে না ইত্যাদি। প্রথাবিরোধী এই অসাধারণ প্রবচনগুচ্ছ নিয়েও অনেকে সমালোচনা করেছেন; বুঝতে না পেরে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগতভাবে যেমন ছিলেন প্রথাবিরোধী, তাঁর সাহিত্যও অন্যদের চেয়ে আলাদা। সেটা যেমন মানের দিক থেকেও আবার বিষয়ের দিক থেকেও।

পৃথিবীতে সাহিত্যের এতো বিচিত্র বিষয় নিয়ে এতো সাবলিলভাবে লিখেছেন খুব কম লেখকই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।