আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. হুমায়ুন আজাদের জীবনী, ২০তম পর্ব

সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা

বহুমাত্রিক সাহিত্য (প্রথম অংশ) হুমায়ুন আজাদ একাধারে ভাষাবিজ্ঞানী, কবি, ঔপন্যাসিক, কিশোর সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে তার সুদীপ্ত পদচারণা। এজন্যই তিনি বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সব ধরণের লেখাই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে তিনি সব ধরনের লেখাতেই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।

তিনি একাধারে সৃষ্টিশীল ও মননশীল লেখক। তাঁর সৃষ্টিশীল লেখার মধ্যে মননশীলতা রয়েছে আবার মননশীল লেখার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। তাঁর সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, রাষ্ট্র বিশে-ষণ যেমন পাঠক দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে আবার কবিতা এবং উপন্যাস লিখেও কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সব ধরনের লেখার মধ্যেই তিনি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়। তিনি যখন কবিতা বা উপন্যাস লিখেছেন সেখানে শিল্পীসত্তা প্রকট আবার যখন প্রবন্ধ মানে মননশীল কিছু লিখি সেখানেও তাঁর মননশীল সত্তা প্রকট।

তিনি বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখেছেন। প্রথম পর্বে কবিতা, সাহিত্য সমালোচনা, ভাষাবিজ্ঞান চর্চা করেছেন। তখন এবং তারপর বিশ্বের সাহিত্য, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়েও লিখেছেন। তিনি জীবনের সম্পূর্ণ রূপ, সৌন্দর্য, কদর্য-অসৌন্দর্যের রূপ চিত্রণ করতে চেয়েছিলেন। সেটা তাঁর কবিতায় রয়েছে, উপন্যাসে রয়েছে, প্রবন্ধে রয়েছে।

হুমায়ুন আজাদ কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলেও তাঁর দেশব্যাপী বোদ্ধামহলে ব্যাপক পরিচিতি ঘটে ভাষাবিজ্ঞান স¤ক্সর্কে লিখে। তিনি পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানের উপর। গবেষণা করে লিখেছেন- প্রোনোমিনালাইজেশন ইন বেঙ্গলি(১৯৮৩)। একই বছর লিখেছেন 'বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র'। ১৯৮৪ সালে লিখেন 'বাক্যতত্ব' এবং'বাঙলা ভাষা (প্রথম খন্ড)' পরের বছর লিখেন দ্বিতীয় খন্ড।

১৯৮৮ সালে লিখেন 'তুলনাম'লক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান' এবং এর পরের বছর 'অর্থবিজ্ঞান'। 'বাঙলা ভাষা' প্রথম খন্ড বেরোনোর পর অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় বইটি তাঁর মাথায় তুলে ধরে তাঁকে বলেছিলেন, আপনাকে কেউ স্বীকৃতি দেবে না তবে এ কাজের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে অনারারি ডিলিট ডিগ্রী দিলাম। বিশ্বভারতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বৃদ্ধ অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে দেখে বলেছেলেন, আমার বিশ্বাস হয় না আপনি হুমায়ুন আজাদ। যিনি বাঙলা ভাষা স¤ক্সাদনা করেছেন তাঁর বয়স এতো কম হতে পারে না। তাঁর বয়স হওয়া উচিৎ অন্তত পঁচাত্তর, এর আগে এমন জ্ঞান হতে পারে না।

পশ্চিম বঙ্গের বাঙলা একাডেমি উদ্বোধন করা হয়েছিল রাজ্যপালকে এই বইটি উপহার দিয়ে। তিনি বাঙলা একাডেমিকে দশ খন্ডে বাঙলা ব্যাকরণ লিখে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা রাজি হতে সাহস করেনি। কিশোরদের উপযোগী করে তিনি ভাষাবিজ্ঞানের দুটি বই লিখেছেন। ভাষাবিজ্ঞানও যে এতো সহজভাবে উপস্থাপন করা যায় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই বই দুটি। তিনি ১৯৭৬ সালে লিখেন-'লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী' এবং ১৯৮৭ সালে লিখেন- 'কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী'।

তিনি যদি শুধু ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে লিখে যেতেন তাহলে হয়তো আরো সম্মানিত হতে পারতেন কিন্তু তিনি তা চান নি। প্রথম বই কবিতার হলেও শুরুতে কবিতা কম লিখেছেন। নিজের কবিতা স¤ক্সর্কে তিনি বলেছিলেন, 'অন্যদের সাথে আমার কবিতার পার্থক্য এর তীব্রতা, এর সৌন্দর্যতা, এর কবিত্ব। তাদের সাথে আমার ভিন্নতা বিষয়ে, ভাষায়, সৌন্দর্যের তীব্রতায় ও শিল্পকলাবোধে। আমার কবিতার স্টাইলে দেখতে হবে এর ভাষা ব্যবহার, শব্দচয়ন, বাক্যগঠন এর ছন্দ মানা ও না-মানা; এর কল্প-রূপক প্রতীক ও স্টাইলের অন্তর্ভুক্তি।

আমি অনেক ক্ষেত্রে ছন্দ মানার জন্য ছন্দ মানি নি, যদি দেখেছি যে ছন্দের কবিতার মধ্যেও মাত্রা মিলিয়ে ছন্দটি কৃত্রিম মনে হচ্ছে, তখন আমি তা মানি নি। স্তাবকবিন্যাস, চিত্রকল্প রচনা পদ্ধতি, রূপক তৈরির পদ্ধতি, ভেতরে তো চেতনা রয়েছেই। আমি কবিতায় বানানো পাগলামো বাতিকগ্রস্থতা, আবোলতাবোল বকা পছন্দ করি না। হেয়ালি পছন্দ করি না, আমি কবিতাকে নিটোল কবিতা করতে চেয়েছি, আর আমার কবিতায় রয়েছে আধুনিক চেতনা। আমার দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলনও কবিতার অংশ।

ভাবালুতা আমাদের দেশে খুব প্রিয়, আমি তা করি নি। ওগুলো গাল ফুলিয়ে পড়ার জন্য। ' পশ্চিম বাঙলার এক সমালোচক হুমায়ুন আদাদের একটি বইয়ের কবিতাগুলোকে ত্রিনাদাদের অগ্নিনৃত্যের সাথে তুলনা করেছিলেন। হুমায়ুন আজাদের কাব্যগ্রন্থ মাত্র ৭টি। তিনি বলতেন, কবিতার মতো প্রিয় কিছু নেই আমার বলেই বোধ করি, তবে আমি শুধু কবিতার বাহুপাশেই বাঁধা থাকি নি।

খ্যাতি, সমাজ বদল এবং এমন আরো বহু মহৎ উদ্দেশ্যে কবিতা আমি লিখিনি বলেই মনে হয়; লিখেছি সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্যে, আমার ভেতরের চোখ যে শোভা দেখে, তা আঁকার জন্যে; আমার মন যেভাবে কেঁপে উঠে, সে কম্পন ধরে রাখার জন্য। হুমায়ুন আজাদের প্রকাশিত প্রথম বই কবিতার- 'অলৌকিক ইস্টিমার' (১৯৭৩)। আমাদের পরিচিত বলয় নিয়েই লিখেছেন। শৈশবে শোনা পদ্মা নদীতে চলা স্টীমারের সিটির শব্দ নিয়ে লিখেছেন- .. .. নীল ইস্টিমার চোখের মতোন সিটি বাজাচ্ছে থেমে থেমে / আমি ঘুমের ভেতর থেকে লাফিয়ে উঠছি / অন্ধহাতে খুঁজে ফিরছি আমার নিবিড় ট্রাউজার .. ..। কী গভীর আবেগ, প্রাণ ছুঁয়ে যায় বসন্তের বাতাস।

এই কাব্যগ্রন্থের 'ব্লাড ব্যাংক' (লিখেছেন ১৯৬৯ সালে) কবিতাটটি একাত্তরে স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনেকবার আবৃত্তি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা দিয়ে একটি পোস্টারও করা হয়েছিল। তাঁর কবিতার গভীর আবেগ কামনা বাসনা স্বপ্ন সর্বদায় থাকলেও দেশের সামাজিক অস্থিরতায় পরবর্তীতে প্রাধান্য পায় রাজনীতি। ১৯৮০ সালে প্রকাশ পায় 'জ্বলো চিতাবাঘ'। সমাজ ও রাজনীতির উপর তীব্র ঘৃণা প্রকাশ পায় 'সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে' (১৯৮৫) কাব্যগ্রন্থে।

কবিতাগুলো শিল্পময়। তিনি লিখেছেন- .. .. এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্র / শিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের ঠোঁট / গদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স - লেলিন, / আর বাঙলার বনের মতো আমার শ্যামল কন্যা / রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক / আমি জানি সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।