আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রন্থ পর্যালোচনা : ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান (এম. এন. রায়)- একজন কম্যুনিস্টের মহৎ নিরীক্ষণ

বলুন! ইহাই আমার পথ। আমি এবং আমার অনুসারীগণ মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকে জাগ্রত জ্ঞান সহকারে এবং আমি অংশীবাদীদের অর্ন্তভূক্ত নই (আল-কুরআন)

গ্রন্থকার পরিচিতি: ইন্ডিয়ার চবিবশ পরগণায় জন্মগ্রহণকারী খ্যাতনামা বঙ্গদেশীয় তাত্ত্বিক ও সংগঠক মানবেন্দ্র নাথ রায় (১৮৮৭-১৯৫৪)। যিনি এম.এন.রায় নামেই অধিক খ্যাত। র‌্যাডিক্যাল হিউমানিস্ট আন্দোলনের পুরোধা এই ব্যক্তি লেলিন, স্টালিন, ট্রটস্কি, বুখারিনের সাথে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মেক্সিকো ও ইন্ডিয়াতে তিনিই প্রথম কম্যুনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলেন।

বিশ্ব-বিপ্লবের লক্ষ্যে বহু দেশ তিনি এ সময় সফর করেন। বিশ্বখ্যাত কম্যুনিস্ট নেতৃবৃন্দ, আইনস্টাইনদের মত বিজ্ঞানীদের সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে তিনি নেহেরু, সুভাষ বোসদের সাথে ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে পারঙ্গম ও মানব সভ্যতার প্রতি মমতাময় দূরদৃষ্টির অধিকারী এম. এন. রায় ছিলেন একাধারে রাজনীতিবীদ, লেখক ও বৈজ্ঞানিক। কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও তিনি ১৬টিরও বেশী বই লিখেছেন।

অক্সফোর্ড থেকে তার সমুদয় রচনাবলী ৪ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে তিনি কম্যুনিজম পরিত্যাগ করেন এবং সাম্যবাদী অর্থনৈতিক বিপ্লবের পরিবর্তে দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনে সচেষ্ট হন। যদিও তিনি কম্যুনিজমের মৌলিক চিন্তাধারা থেকে সরে আসেননি। ১৯৫২ সালে তিনি আমষ্টারডামে গঠিত বিশ্ব মানবতাবাদী আন্দোলনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তাঁর মানবতাবাদ ছিল কেবলই মানুষের মৌলিক চাহিদা ও তার পারিপার্শিক অবস্থা বিশ্লেষণের উপর ভিত্তিশীল।

এ মতবাদে ইন্ডিয়ার প্রচলিত রাজনীতি ও দার্শনিক ধারা পুরোপুরি না হলেও অধিকাংশই বর্জন করা হয়েছে বলে একে র‌্যাডিক্যাল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। তিনি নৈতিকতাকে একমাত্র জীবজগতের মাঝেই অনুসন্ধান করেছেন এবং মানবতার উন্নতি একমাত্র স্বাধীনতা ও সত্যের উপর নির্ভরশীল বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ১৯৩০ সালে বৃটিশ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ ৬ বছরের কারাজীবনে তিনি কয়েকটি বই লিখেন। এই সুযোগে ইসলামের উপর তাঁর পড়াশোনার সুযোগ হয় এবং The Historical role of Islam (ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান) নামের অসাধারণ পুস্তিকাটি লেখেন।

বইটি ১৯৪৮ সালে বাংলায় অনূদিত হয়। গ্রন্থ পর্যালোচনা: ৭টি অধ্যায়ে বিভক্ত তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত এই পুস্তিকায় লেখক একজন কম্যুনিস্ট হিসাবে ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইসলামের মৌলিকতার দিকে গভীর দার্শনিকতা নিয়ে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি চেয়েছেন মানবসমাজকে ইসলাম সম্পর্কে জিইয়ে রাখা ভ্রান্ত ধারণা অপনোদন করে একটি ইতিবাচক ও পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিতে, বিশেষতঃ ইন্ডিয়াবাসীকে যারা মুসলমানদেরকে বহিরাগত মনে করে অন্তরের দিক থেকে দূরত্ব অনুভব করে। হিন্দুদের এই ভ্রান্ত ধারণার কথা ভূমিকা অধ্যায়েই উল্লেখ করেছেন, ‘পৃথিবীর কোন সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মত ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এমন অজ্ঞ নয় এবং ইসলাম সম্পর্কে এমন ঘৃণার ভাবও পোষণ করে না। ’ তিনি শুরু করেছেন সমরকন্দ থেকে স্পেন পর্যন্ত বিশাল ভূখন্ডে অনধিক একশত বছরের মধ্যে সংঘটিত ইসলামের অভূতপূর্ব সামরিক ও সাংস্কৃতিক বিজয়কে অলৌকিকত্বের ভূষণ পরিয়ে।

নতুন বিশ্বাসে ঐকান্তিক আগ্রহ সম্বলিত আরব মরুভূমির অপেক্ষাকৃত ছোট, একটা বেদুঈন দলের কাছে প্রাচীনকালের বৃহৎ সাম্রাজ্য অবিশ্বাস্য দ্রুগতিতে কিভাবে ধর্মান্তর গ্রহণ ও পরাজয় বরণ করল, লেখকের কাছে তা অবোধগম্য ঠেকেছে। একে stupendous miracle (বিস্ময়কর অলৌকিক ঘটনা) আখ্যা দিয়ে এর উত্তর তিনি নিজেই খুঁজেছেন- ‘ঘুণে ধরা প্রাচীন সভ্যতাগুলো মানবসমাজকে যে নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছিল ইসলামের বৈপ্লবিক আহবান তাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। এটাই ছিল এই নিরংকুশ সাফল্যের প্রাথমিক কারণ। ’ দ্বিতীয় অধ্যায়ে পৃথিবীর বুকে ইসলামের মিশন কি ছিল তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী সমালোচকরা যারা মনে করে ইসলামের উত্থান শান্ত ও সহিষ্ণু লোকদের উপর গোড়ামির বিজয়, ইসলামের ইতিহাস সামরিক দুর্ধর্ষতার ইতিহাস, তাদের মূর্খতার প্রতি কঠোর বিদ্রুপবান হেনে তিনি জবাব দিয়েছেন, ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে ইসলাম যদি শুধু আরবীয় মুসলমানদের অপূর্ব সামরিক শক্তির দিগ্বিজয়ী ভূমিকার অভিনয়ই করে থাকে, তাহলে ইতিহাসে তার তেমন অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য রইল কোথায়? তাতার এবং সিথিয়ার অসভ্যদের ধ্বংসলীলার বিপরীতে মুসলমানরা মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে যে এক অনন্যসাধারণ ধারা সৃষ্টি করেছে তা এক অতুলনীয় অবদান।

আরবদের তলোয়ার কেবল এটাই প্রমাণ করেছে যে, তা মানবতার অগ্রগতিকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে সমর্থ। তিনি ইসলাম সম্পর্কে মূল্যায়নে মানুষের অদূরদর্শিতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, জনসাধারণের চিন্তাধারা ইসলামের বিস্ময়কর সামরিক সফলতার উপর এসেই আটকে যায়। তারা ভুলে যায় সেই মহান বিপ্লব-প্রসূত বৃহত্তর সম্পদের কথা; তা মুসলমানই হোক আর অমুসলিমই হোক। মূলতঃ মুহাম্মাদের একেশ্বরবাদ আরবীয় মুসলমানদের তলোয়ার সঞ্চালনে এমন অজেয় ক্ষমতা দান করেছিল যে, তা শুধু আরব উপজাতির দুষিত পৌত্তলিকতাকেই নষ্ট করল না বরং ধর্ম সমূহের ভ্রষ্টতা, অন্ধবিশ্বাস আর সন্ন্যাসী-সংক্রমিত ব্যাধির হাত থেকে অগণিত মানুষকে মুক্তি দেবার জন্য এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ শক্তি (Invincible instrument of history) হয়ে উঠল। খুব গভীর দৃষ্টিতে প্রসঙ্গের সমাপ্তি টেনেছেন তিনি- ‘প্রকৃতঅর্থে আল্লাহর নামে সঞ্চালিত ইসলামের এই তলোয়ার এমনই একটি নতুন সামাজিক শক্তি, এক নতুন বিদগ্ধ জীবনের উদ্ভব ঘটাল যা অন্য সকল ধর্ম ও বিশ্বাসের সমাধি রচনা করেছিল।

’ সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিকতা এবং এর সত্যাশ্রয়ী প্রভাব বিস্তারের অতুলনীয় ক্ষমতাকে লেখক বিশেষভাবে তুলে এনেছেন। দ্বিধাহীনচিত্তে দেখিয়েছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল-কুরআনের সহজ-সরল, বিবেকীয় ও কুসংস্কারমুক্ত, মানুষে মানুষে সমতাসূচক দূরদর্শী নীতিমালার বৈপ্লবিকতা। যার মাঝে তিনি সমাজ বিপ্লবের চিরনতুন এক ধারার সন্ধান পেয়েছেন। তার মতে, এ ধারারই চূড়ান্ত পরিণতি হল আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতা ও বুর্জোয়াবিপ্লব। তৃতীয় অধ্যায়ে ইসলামের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে যেয়ে তিনি ব্যাপকভাবে তাঁর মার্কসবাদী চিন্তাধারার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

ফলে মহৎ দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত থাকলেও ভূল ও স্ববিরোধিতাপূর্ণ বিশ্লেষণে সত্য ধামাচাপা পড়ে গেছে। এ অধ্যায়ে একদিকে লেখক ইসলামের অবির্ভাবকে অর্থনৈতিক বাস্তবতার ফলশ্রুতি উল্লেখ করে বলেছেন যে, ‘অর্থনৈতিক স্বার্থবুদ্ধি থেকেই মক্কাকে প্রাণকেন্দ্র করে হাশেম পরিবারের একজন মুহাম্মাদ এ নতুন ধর্মমত প্রচার করতে শুরু করেন। এ বুদ্ধিই এ ধর্মকে জাতীয় জীবনে দাড় করিয়ে দিয়েছিল’। - আবার সামান্য পরেই স্ববিরোধিতার নজীর রেখে লিখেছেন, ‘প্রথমে কুরাইশরা কাবা মন্দিরের মূর্তি সরাতে বাধা দিয়েছিল এই ভাবনাতে যে তাতে তাদের ব্যবসায় প্রভূত ক্ষতি হবে’। এছাড়া ইসলামের সহিষ্ণুতা, ভ্রাতৃত্ববোধের আদর্শে উজ্জীবিত হওয়াটা তৎকালীন ভৌগলিক ও সামাজিক অনুকূল পরিবেশের প্রতিফল বলে তাঁর কাছে মনে হয়েছে।

তাঁর মতে, আরববাসীর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কারণ ছিল তৎকালীন প্রচলিত ধর্মীয় ভক্তিহীন যাগ-যজ্ঞ, ভন্ড সাধু-সন্ন্যাসী, পীর-পয়গাম্বরদের ভিড়, পুরোহিতের নিপীড়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো। এছাড়া বিভিন্ন সময় রাজাদের নিপীড়নের শিকার হয়ে আরব ভুখন্ডে আতিথেয়তা গ্রহণ করা গ্রীক দর্শন, খৃষ্টীয় আদর্শবাদের ধারকদের জ্ঞানবত্তাই নাকি পরবর্তীতে আরব বেদুঈনদের হস্তগত হয়ে শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারে পরিণত হয়েছিল। আর এই উত্তরাধিকারকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করে তা জনগণের মাঝে প্রচার করা এবং সকলকে এর আওতাধীনে একতাবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগানোর মাঝেই তিনি কুরাইশ বংশের এই স্বার্থক পুরুষ মুহাম্মাদের অবিসংবাদিত কৃতিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। মোটকথা প্রাচ্যবিদদের মত তাঁরও মনে হয়েছে সামগ্রিক অনূকুল পরিবেশ এবং মুহাম্মাদের মত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তির আবির্ভাবে এ নতুন ধর্ম, এ নতুন আদর্শের বিজয়লাভ সম্ভব হয়েছিল। অথচ একই স্থানে নিজ ধারার বাইরে যেয়ে বলেছেন, ‘আল্লাহর একত্ববাদ’ এ শক্তিধর মহাদর্শনই ইসলামকে অনন্য বৈশিষ্ট্যে অভিষিক্ত করেছিল।

সাথে সাথে ইসলাম যে প্রকৃতঅর্থে প্রচলিত ধর্ম থেকে ভিন্ন কিছু; এটাকে বরং রাজনৈতিক আন্দোলন বলাই যে অধিক সমীচীন তা তিনি খুব জোরের সাথেই উচ্চারণ করেছেন। এভাবে এ অধ্যায়ে তাঁর বক্তব্য প্রায়ই স্ববিরোধীতাপূর্ণ হয়েছে। চতুর্থ অধ্যায়ে ইসলামের সফলতার মূল কারণ নির্ধারণ করতে যেয়ে নির্বাচন করেছেন আল্লাহর একত্ববাদকে। তিনি বলেন, এই একত্ববাদই মুসলমানদের যেমন বলিষ্ঠ চেতনা দিয়েছে তেমনি সহিষ্ণু হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে এক আল্লাহর সৃষ্টি হিসাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-নির্ধন, সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি সমতার দৃষ্টি দেওয়া।

এ কারণেই মহাসত্যের দিকে আহবান করাকে তারা সার্বজনীন কর্তব্য মনে করে। যতদিন মানুষ স্বেচ্ছায় মুক্তির পথ বেছে না নেয় ততদিন ভবিষ্যৎদৃষ্টিতে তাদেরকে সহজভাবেই ছেড়ে দেয়। সহনশীলতা, সাম্য-মৈত্রীর এই মাহাত্মই তৎকালীন দ্বন্দ্বমূখর সমাজ, শাসকদের নিপীড়নে নিষ্পিষ্ট বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। তা না হলে কোন রকমের বলপ্রয়োগে অন্ততঃ টাইগ্রীস থেকে অক্সাস পর্যন্ত বিশাল ভূখন্ডের অধিকারী পারসীরা অভাবনীয় দ্রুততায় এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করতে পারত না। ইসলামের এই বিস্ময়কর সাফল্যের হেতু তাই যেমন সামাজিক ও রাজনৈতিক, তেমনি আধ্যাত্মিক।

পঞ্চম অধ্যায়ে মুহাম্মাদের শিক্ষা কি ছিল তা নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে তিনি আবারও প্রাচ্যবিদদের ধারণারই প্রতিধ্বনি করেছেন তবে ইতিবাচক ভঙ্গিতে। প্রশ্রয়ের সুরে তিনি লেখেন, ‘ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মাদ অলৌকিকতার দাবী করেছিলেন- এটা তার ভন্ডামী ছিল না; বরং তৎকালীন পরিবেশ, যুদ্ধরত আর গোত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাকে এ জাতীয় কিছু করতে হয়েছে’। তাঁর মতে, অহী অবতরণের ঘটনা একটি ‘মানসিক ক্রিয়া’। অবশ্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বিষয়টি বুঝতে গিয়ে তার যে সন্দেহ রয়ে গিয়েছিল তা বুঝা যায় পরবর্তী কথায়- ‘আগে-পরের ‘বিশেষ ক্ষমতা’র দাবীদারদের মত তিনিও কিছু দাবী করলেন। তবে তাঁর বেলায় ‘এমন কিছু’ (there was a fact) ঘটল যা তার জন্য বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়’।

প্রসঙ্গের শেষপ্রান্তে তিনি বলেই ফেলেছেন যে, ইসলামই ধর্মের সর্বোৎকৃষ্ট রূপ; অন্য ধর্মগুলো ধর্মের নামান্তর মাত্র। এর কারণ হিসাবে তিনি আবারো একেশ্বরবাদের মাহাত্ম তুলে ধরেছেন এবং নিজস্ব চিন্তাধারা তথা মার্ক্সবাদের আলোকে তার ব্যাখ্যা করেছেন। পরের অধ্যায়ে তিনি ইসলামী দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিভিন্ন মুসলিম দার্শনিকের অবদান উল্লেখ করেছেন। মুসলিম দার্শনিকরা গ্রীক দর্শনের সাথে ইসলামী দর্শনের যে মেলবন্ধনের প্রচেষ্টা চালিয়েছেন লেখক তাতে বরং ইসলামের উদারতা ও পরমতসুহিষ্ণুতার দিকটাই বড় করে দেখেছেন।

তিনি উল্লেখ করেছেন মুসলিম বিজ্ঞানীদের বস্ত্তজাগতিক আবিষ্কারের কথা। ইসলাম কখনই বিজ্ঞানীদের উন্মুক্ত গবেষণায় বাধা দেয় না এটাই তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এভাবে বিভিন্নদিক থেকে তিনি ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বের বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। যে শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর মতে, দুনিয়ার সকল ধর্মের ভিত্তিমূল ধ্বংস করে দিয়েছে। শেষ অধ্যায়ে লেখক হিন্দু অধ্যূষিত বিশাল ভারত উপমহাদেশে একত্ববাদী ধর্ম ইসলামের স্থান করে নেওয়ার কারণ ও তাৎপর্য তুলে ধরেছেন।

এদেশে ইসলামের প্রসার এ ধর্মের দার্শনিক শ্রেষ্ঠতার চেয়ে সামাজিক কর্মতৎপরতারই ফসল ছিল বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, কুরআনের বিধি-বিধান এ দেশের মানুষের মাঝে ইনসাফের শ্যামল বাতাস বইয়ে দিয়েছিল। উদ্ভট আচার-যজ্ঞ, জীবনের প্রতি প্রতিক্রিয়াপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি, বর্ণবাদে নিষ্পিষ্ট মানুষ ইসলামকে মুক্তির দূত মনে করেছিল। ইসলামের সমাজ-বৈপ্লবিক চরিত্র, এমনকি ইসলামের বিকৃতি ও অবনতির সময়ও ভারতবর্ষের সমাজ-ব্যবস্থায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রবল মুসলিমবিদ্বেষী ঐতিহাসিক হ্যাভেলের একটি উক্তি তিনি তুলে ধরেছেন-‘ভারতবর্ষে ইসলামের বিজয় এর অন্তর্নিহিত কারণেই নিহিত ছিল।

নবীর সমাজ ব্যবস্থা প্রত্যেক মুসলমানকে দিয়েছে সমান আত্মিক মর্যাদা, ইসলামকে করেছে রাজনীতি ও সমাজনীতির মিলনভূমি আর তা-ই দিয়েছে তাকে জগৎ শাসনের ভার’। ভারতের বুকে ইসলাম কি পরিবর্তন এনেছিল সে বিষয়ে আবারও বিদ্দিষ্ট হ্যাভেলের স্বীকারোক্তি তুলে ধরেছেন- ‘ভারতীয় হিন্দুদের জীবন থেকে মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদ একদিকে জাতিভেদের গোড়ামী দূর করেছে অন্যদিকে অন্যায়ের প্রতি একটা বিদ্রোহের বীজও বপন করে দিয়েছে যা জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের, বহু মৌলিক প্রতিভার। মোটকথা বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা’। পরিশেষে তিনি ভারতবাসীরা মুসলমানদের অবদান স্বীকার না করে উল্টো যে উদ্ধতভাব পোষণ করে তাকে তিরস্কার করে বলেছেন, এটা একটা পরিহাস্য আচরণ এবং ইতিহাসের অবমাননাকারী যা ভারতের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে বিঘ্নিত করেছে। মূলতঃ প্রাচীন সভ্যতার বিশৃংখল ধ্বংসস্ত্তপ থেকে মুসলমানরাই হিন্দুদেরকে উদ্ধার করেছে।

তাদের দেখিয়েছে নবআলোকের দিকদিশা যার তুলনা ইতিহাসে বিরল। তাই এক্ষেত্রে হিন্দুদের সংকীর্ণতাবোধ তাদের সত্যকে গ্রহণ করার অযোগ্যতাকেই সুস্পষ্ট করেছে। অপরদিকে এ বিষয়ে মুসলমানদের বিরাট একটি অংশের সীমাহীন উদাসীনতাও তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। আফসোসের সুরে তিনি লিখেছেন-‘ইসলাম যে ইতিহাসের নাট্যশালায় মহিমাময় ভূমিকার অভিনয় করে গেল সে সম্পর্কে আমাদের কালের অত্যন্ত অল্পসংখ্যক মুসলমানই অবহিত’। এজন্য তিনি ‘প্রতিক্রিয়াশীল আলেম’দের দোষারোপ করেছেন।

পাঠক বইটির প্রতিটি পাতায় লেখকের সুগভীর মমতাপূর্ণ বিশ্লেষণ দক্ষতায় মুগ্ধ হবেন। নির্মোহ অথচ সত্যানুসন্ধানী মূল্যায়নধর্মী রচনাভঙ্গি লেখকের প্রতি নিমিষেই শ্রদ্ধা জাগায়। খুব নিকট থেকেই ইসলামকে দেখার চেষ্টা করেছেন বলে তার কাছে এমন অনেক সত্য প্রতিভাত হয়েছে যা সাধারণতঃ দৃষ্টিগোচর হয় না। অনেকটা দায়িত্ব নিয়েই তিনি ইসলামের সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। সব ছাপিয়ে যে সত্যটি মূর্ত হয়ে উঠেছে তা হল, একজন আপাদমস্তক কম্যুনিস্ট ও নাস্তিক হয়ে তিনি ইসলামকে যে দূরদৃষ্টি নিয়ে দেখেছেন, একত্ববাদের মূলসূত্রকে যে গভীরতায় আত্মস্থ করেছেন, ইসলামী সমাজ বিপ্লবের যে জটিলতামুক্ত, ক্লান্তিহীন, সহজ-সরল চিত্র এঁকেছেন মুসলমান হয়েও এ বিষয়গুলো আমাদের চোখে খুব কমই ধরা পড়ে।

ইসলামকে আজ আমরা এমন এক অঙ্গনে ফেলে রেখেছি যেখানে তা অন্যান্য ধর্মের মত কতিপয় বিমূর্ত বিশ্বাসের আকার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ব্যক্তিগত জীবনে কিছু আচার শিখান ও শিথিল মূল্য আরোপ ছাড়া তাতে যেন কোন শক্তিময়তা নেই। নেই তাতে সমাজ পরিশুদ্ধির সর্বব্যাপিতা। নেই তাতে সত্যের সেই অপার্থিব তূর্যঝংকার যার স্পর্শে আন্দোলিত হতো শতকোটি বুভুক্ষ প্রাণ। নেই তাতে মিথ্যা, অন্যায় আর বেইনসাফীর বিরুদ্ধে সেই বৈপ্লবিক রুদ্র হংকার, যার বিদ্যুৎতরঙ্গে পরিবাহিত হয়েছিল এককালে কল্যাণ ও প্রশান্তির অনাবিল সুবাতাস।

স্বার্থদ্বন্দ্বে মূখর মুসলিম বিশ্ব এবং নামধারী মুসলমানদের জন্য লেখকের চিন্তাধারাগুলো তাই চপেটাঘাতই। অপরদিকে ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদের গোঁড়া সমর্থক হিসাবে লেখক বইটির কোথাও নিজ গন্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ফলে চিন্তাধারায় বহু বিকৃতি রয়েছে যা আমরা আলোচনায় দেখেছি। মহাসত্যের মৌলিক উৎসের এত কাছাকাছি হয়েও এসব বরেণ্য মনীষীদের সত্যকে ধারণ করতে ব্যর্থ হওয়ার করুণতর এ দিকটিও আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে নাড়া দেয়। কেবলমাত্র বিশ্বাস নামক প্রাণশক্তির অভাবে মানুষ কিভাবে সত্য গ্রহণে বাধাগ্রস্থ হয় তা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।

তাই গ্রন্থটি পাঠে বোদ্ধা পাঠক মানবতার মূল প্রাণশক্তি তথা আসমানী সত্যের উপর বিশ্বাসের মর্যাদা উপলব্ধির ভিন্নতর তাকীদ অনুভব করবেন। সব মিলিয়ে নানা ত্রুটি সত্ত্বেও সংক্ষিপ্ত এই বইটি লেখকের মৌলিক উদ্দেশ্য প্রতিফলনে স্বার্থকতারই পরিচয় বহন করেছে। অনুবাদক আব্দুল হাই লেখকের বক্তব্যের মূলধারাকে ফুটিয়ে তুলতে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যদিও সবক্ষেত্রে সে ধারা অক্ষুণ্ণ থাকেনি। কিন্তু তার ঝরঝরে অনুবাদ পাঠককে তৃপ্তই করবে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.