আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: কবি ও কিশোরী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

গলির ঠিক মাথায় একটা সিডি-ক্যাসেটের দোকান। হাই-ভলিউমে একটা হিন্দি গান বাজছিল: খুদা জানে কে মেইন ফিদা হুন/ খুদা জানে মেইন মিট গয়া ... কোরাসের সুরে অত্যন্ত মেলোডিয়াস চিৎকার । তা ছাড়া গানের সুরে কেমন নিশ্চিন্ত ভাব, যেন জীবনে দুঃখকষ্ট বলে কিছু নেই, যেন জীবনে কখনোই মর্মান্তিক দূর্ঘটনা ঘটে যায় না .. যেন এ জীবন কেবলই আনন্দময়, যেন এ জীবনে ওড়না পেঁচিয়ে কোনও কিশোরীকে ফাঁস দিতে হয় না ... শান্তা দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরছিল ।

আজ শাড়ি পরেছিল বলে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল। আজ কলেজে নবীনবরণ ছিল, যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, তারপরও যেতে হল। লাল পাড় হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে, গলিটা সোনালি রোদে ভরে আছে বলে শান্তাকে অপূর্ব দেখাচ্ছিল; অথচ ওর মুখটা ফ্যাকাশে, বুকে জমাট কান্না। বারবার লাবনীর মুখটা ভেসে উঠছে, ইশ, আজ লাবনী বেঁচে থাকলে ওও শাড়ি পরত। শান্তা ফাংশানে আজ কবি মোস্তফা কামাল রচিত ‘ শ্রাবণের বৃষ্টির দিনে’ কবিতটি আবৃত্তি করেছে।

ইশ, লাবনী বেঁচে থাকলে ফাহমিদা নবীর গান গাইত। ফাহমিদা নবীর ‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানটা লাবনীর ভীষণ পছন্দ ছিল। দূর থেকে রবিনকে দেখে শান্তার বুকটা ধক করে উঠল। হলুদ টি-শার্ট, কালো প্যান্ট পরে সজীব কনফেকশনারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে রবিন, সামনে একটা টিভিএস মোটর সাইকেল । ছেলেটা এ পাড়ার মাস্তান বাদশার ঘনিষ্ট সহযোগী, লাবনীর মৃত্যুর পর থেকেই বাদশা পলাতক, লাবনীর মৃত্যুর পর পুলিশ এসেছিল, পুলিশ এখন আর আসছে না, এখন দেশে এমনই হচ্ছে, একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর খুব তোলপাড় ওঠে, তারপর ধীরে ধীরে সবাই ভুলে যায়।

কনফেকশনারীর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় শান্তার দিকে ট্যারা চোখে তাকায় রবীন । গুনগুন করে ...খুদা জানে কে মেইন ফিদা হুন/ খুদা জানে মেইন মিট গয়া ... শান্তা রক্তস্রোতে আলোরণ টের পায়। ও চলার গতি বাড়িয়ে দেয়। বাদশাও লাবনীকে দেখে এই গানটি গাইত। আত্মহত্যা করার আগের দিনও কথাটা লাবনী শান্তাকে বলেছিল ।

কবি মোস্তফা কামাল চা-স্টলে বসে চা খাচ্ছিলেন। চা-স্টলটা মতিনের, সকালের দিকে কবি এখানে একবার এসে বসেন। চা শেষ করে সিগারেট ধরিয়েছেন কবি, শান্তাকে দেখতে পেলেন, দ্রুত হাঁটছে, পিছনে রবীন ছেলেটা দাঁড়িয়ে, কবি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ... এই বখাটেদের জন্যেই ফুলের মতন একটি মেয়েকে প্রাণ দিতে হল। লাবনীকে চিনতেন কবি, কবির বন্ধু মোশারফের মেয়ে, মোশারফ হোসেন ভূইঁয়া একটা সরকারি ব্যাঙ্কে চাকরি করে, বাড়ি বিক্রমপুর। আহা, নীরবে অপমান সহে ফুলের মতন ফুটফুটে মেয়েটি ফাঁস দিল, কাউকে কিছু বললও না।

লাবনীর মৃত্যুর সময় কবি নেত্রকোনার দূর্গাপুর ছিলেন, হঠাৎই সোমেশ্বরী নদী দেখতে ইচ্ছে হল: কবির হঠাৎ হঠাৎ এমন ইচ্ছে হয়, তখন বেরিয়ে পড়েন। কবির বয়স ষাটের মতন, প্রেসের ব্যবসা আছে, সেটিই আয়ের প্রধান উৎস, ছেলেমেয়েদের বিয়েশাদী হয়ে গেছে। স্থানীয় গন্যমান্য লোক কবি মোস্তফা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা কবি হিসাবে ওয়ার্ড কমিশনার থেকে পাড়ার সব বয়েসের নারীপুরুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। কবি কবজি উলটে ঘড়ি দেখলেন; বারোটার মতন বাজে। সিগারেটের শেষ অংশটুকু চায়ের কাপে ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।

রবীন কনফেকশনারীর সামনে তখনও দাঁড়িয়ে, শান্তাকে দেখতে পেলেন না, ওপাশের সাদা রঙের পুরনো একটি চারতলা দালানের ভিতরে ঢুকে গেছে শান্তা; দালানটা রফিক শিকদারের, রফিক শিকদার শান্তার বাবা, হাইকোর্টের ল’ইয়ার। শান্তাদের বাড়ির দোতলায় ভাড়া থাকেন রাশেদা বেগম, একাই থাকেন, অনেক দিন রাশেদা বুর সঙ্গে দেখা হয় না। আজ একবার রাশেদা বুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। রবীনের হাবভাব ভালো ঠেকল না। কবি মতিনের চাস্টল থেকে বেরিয়ে ধীরেসুস্থে হাঁটতে থাকেন।

কবির ধবধবে ফরসা শরীরটি এই বয়েসেও বেশ সবল। পরনে চেক লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, মুখে দাঁড়ি, চোখে কালো রঙের ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। দোতলায় উঠতে সামান্য হাঁপ ধরল। কলিংবেল বাজালেন। দরজা খুলল মনিরা।

রাশেদাবু কইরে? কবি জিজ্ঞেস করেন। নানী আছে। আপনি বসেন মামা। আমি ডাক দিয়া দিতেছি। বলে মনিরা ভিতরে চলে যায়।

বসার ঘরটি ভারি ছিমছাম, ঘর জুড়ে আগরবাতির গন্ধ। এক কোণে পুরাতর টিভি সেট। তার ওপরে মওলানা ভাসানীর একটি সাদাকালো ছবি। সোফা সেটটিও পুরনো, একটি সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। একটু পর রাশেদা বেগম এলেন।

পরনে কালো পার সাদা শাড়ি। ষাট বছর বয়েসি বিধবা মহিলা, দেখে মনে হয় না গত উনচল্লিশ বছর এই বৃদ্ধা কি ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন । ফরসা। চোখে কালো ফ্রেমের বাইফোকাল চশমা। রাশেদা বেগম একা থাকেন।

ছেলেমেয়েরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কবি নিস্তেজ কন্ঠে বললেন, পাড়ায় এমন কান্ড হয়ে গেল, মোশারফ হোসেন ভূইঁয়ার মেয়েটা ... রাশেদা বেগম বললেন, আমি শান্তার মুখে শুনছি, আমজাদের পোলা বাদশায় লাবনীরে অপমান করছিল । লাবনীরে বিয়া করব বইলা হুমকি দিসিলো। লাবনী বিয়ায় রাজী না হইলে তুইলা নিয়া যাইব বলছিল। কবি টের পেলেন তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে।

মনিরা ট্রে নিয়ে ড্রইংরুমে ঢোকে। একটা গ্লাসে বেলের সরবত। টেবিলের ওপর ট্রে রেখে চলে যাবে -এমন সময় রাশেদা বেগম বললেন, ডাইলে আম দিস রে মনি। দিমু নানী। বলে মনিরা চলে যায়।

কবি এক চুমুকে বেলের সরবত শেষ করে বললেন, লাবনী তোমার কাছে আসত না বু? আসত, কম, শান্তার সঙ্গে আসত। শান্তাই বেশি আসত। বাড়িওলার মেয়ে। পাশাপাশি মেয়ে দুইটারে ভালো মানাইত। হ।

কবি বললেন, তোমারে না পাকিস্তানি সৈন্যরা ধইরা নিয়া গেছিল, কত অত্যাচার করছে তখন, কই তুমি কি আত্মহত্যা করছ? রাশেদা বেগম চুপ করে থাকেন। এই কথায় কত কথা যে মনে পড়ে যায়। উনিশ ’শ একাত্তর সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি। নেত্রকোণার আটপাড়ার কাছের এক গ্রামে দূর সম্পর্কের এক মামার বাড়ি আশ্রয় নিয়েছেন। মামার ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল ... স্থানীয় রাজাকার নুর আলীর যোগসাজশে পাকিস্তানি সৈন্যরা মধ্যরাত্রে বাড়ি আক্রমন করে ... উঠানে দাঁড় করিয়ে একে একে গুলি করে বাইশজন কে হত্যা করে ...তারপর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় ... সাতজন মেয়ের সঙ্গে রাশেদা বেগমকে ট্রাকে তোলে ...স্কুলঘরে নিয়ে বিভৎস নির্যাতন করে ... সেই সময়কার কথা মনে হলে শরীর আজও হিম হয়ে ওঠে ... কবি বললেন, একবার যদি লাবনীয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলত বু।

যদি লাবনীয়ে জানত তোমার উপর দিয়া কি ঝড় গেছে যুদ্ধের টাইমে। তারপরেও তুমি মরণের পথ বাইছা লও নাই, আজও বাঁইচা আছো। রাশেদা বেগম চুপ করে থাকেন। তার চোখের কোণে ভিজে যায়। লাবনী আসত মাঝে-মাঝে।

মেয়েটা বড় লক্ষ্মী ছিল। তবে কখনও বাদশার জ্বালাযন্ত্রণার কথা বলেনি । কবি বললেন, যারা বখাটেদের অত্যাচারে আত্মহত্যা করতেছে, তারা যদি জানত কত অপমানের পরও বাঁইচা থাকা যায়। আইজকাল কার অল্পবয়েসী মেয়েদের সঙ্গে তাহে মা-খালাগো সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। যোগাযোগটা বজায় থাকলে মেয়েরা আর বদমাইশ পোলাপাইনের জ্বালায় গলায় ফাঁস দিয়া মরত না।

লাবনীদের বয়েসী মেয়েদের বাঁচার জন্য দরকার বয়স্ক মহিলাদের অভিজ্ঞতা। কলিং বেল বাজল। রাশেদা বেগম উঠে দরজা খুললেন। শান্তা। শাড়ি বদলে সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছে।

হাতে একটা প্লেট । আয়। তোর হাতে কি রে? মায়ে মাছের বড়া করছে। আচ্ছা, তুই মামার কাছে বয়। আমি আসতেছি।

বলে রাশেদা বেগম প্লেট নিয়ে ভিতরে যান। কবি বলেন, আয় শান্তা। বস, তোর লগে আমার কথা আছে। শান্তার বুক ঢিপঢিপ করে। বসল।

কবি মোস্তফা কামালকে ভীষন শ্রদ্ধা করে। ছোটদের জন্য লেখা কবির ছড়াগ্রন্থ ‘পরীর হবে গায়ে হলুদ’ প্রিয়, প্রায়ই একা একা ‘হলুদ রোদের দিন’ ছড়াটা আবৃত্তি করে। এমন মানুষকে কি শ্রদ্ধা না করে উপায় আছে। কবি জিজ্ঞেস করলেন, তোরে কি সিরাজের পোলা রবীনে ডিসটার্ব করে মা? শান্তা চুপ করে থাকে। রাশেদা বেগম ফিরে এসেছিলেন।

কথাটা রাশেদা বেগমের কানে গিয়েছিল। সোফায় বসতে বসতে বললেন, ক, সত্য কথা ক। শান্তা চুপ করে থাকে। অল্প অল্প কাঁদছে। কবি বললেন, বু, তুমি ওরে খুইলা কও ... সেভেনটি ওয়ানে সেইসব নরপশুরা তোমারে নিয়া কি করছিল।

শুন শান্তা। রাশেদা বেগম বলতে থাকেন। সেই রোমহর্ষক বিভৎসকাহিনী শুনতে শুনতে শান্তার ফরসা রং নীলাভ বর্ণ ধারণ করতে থাকে। থরথর করে কাঁপতে থাকে। কবি বললেন, বুঝলি মা, কত অপমানের পরও বাঁইচা থাকা যায়।

মা, প্রাণ হইল আল্লাহতালার পবিত্র সৃষ্টি। তিনি যখন ইচ্ছা করবেন প্রাণ নিয়া নিবেন, এই পবিত্র প্রাণকে নিজ হাতে বিনাশ করতে নাই। প্রাণ নিজ হাতে বিনাশ করলে আল্লাহতালা কষ্ট পান। শান্তা মাথা নিচু করে বসে আছে। রাশেদা বেগম উঠে জানালার কাছে গিয়ে উঁিক মারলেন।

তারপর বললেন, সিরাজের পোলা রবিন এখনও কনফেকশনারীর সামনে খাড়ায়া আছে। বান্দির পুত। মনে হয় জুতা দিয়া পিটায়া মুখ থ্যাতা কইরা দেই। কবি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চল, নিচে চল।

আজ এর একটা বিহিত করুম । আমার রক্তে মুক্তিযুদ্ধের তুফান বইতেছে। চল, নিচে চল। তিনজনে নিচে নেমে এল। শান্তার শরীর ভীষন কাঁপছিল।

কত অত্যাচার সহ্য করে রাশেদা ফুপু এখনও বেঁচে আছেন। ইস্ , কেন যে লাবনী সুইসাইড করল! কবি বললেন, যা মা, তুই ওই বদমাইশটার সামনে দিয়া হাঁইটা যা। বাজে কিছু কইলে ওড়না দিয়া ওর গলা পেঁচায়া ধরবি। দেশে আইনকানুন নাই যখন, আবার হাতে আইন তুইলা নিব। শান্তা দাঁড়িয়ে থাকে।

সামান্য ইতঃস্থত করে। লাবনীর মৃত মুখ মনে পড়ে। যে ওরনায় লাবনী ফাঁস দিয়েছিল সেই ওড়নাটি ওকে সঙ্গে নিয়ে কিনেছিল। রাশেদা বেগম বলেন, তুই যা, শান্তা, আমরা আছি, যা। তোর কোনও ভয় নাই।

রবীন খারাপ কথা কইলে বটি দিয়া অর গলা আজই কাইটা ফালামু। এইভাবে লুবনার মতন মেয়েরা গলায় ফাঁস দিয়া মরলে আমার বাঁইচা থাকার কোনও দরকার নাই। শান্তা নির্ভয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে রবিনের দিকে। রবিন দাঁড়িয়ে আছে। শান্তা ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে হাসছে।

শান্তা নির্ভয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে রবিনের দিকে। ওর আর ভয় লাগছে না। একজন মহৎপ্রাণ কবি মহাকাল থেকে অনেক অভয় তরঙ্গ এনে ওর কিশোরী শরীরে লেপন করে দিয়েছেন ... ওর আর ভয় লাগছে না। ও আর কখনও ভয় করবে না ... বাতাসে কী ভাবে মৃদু উত্তেজনা ছড়িয়ে যায়। হয়তো শান্তার হাঁটার ভঙ্গিতে কিছু একটা ছিল।

জনতার ভিড় বাড়ছে গলিতে। এ দেশের বৃহত্তর জনতা আগামীকালের সংবাদপত্রে অন্যরকম একটি সংবাদ পাঠ করবে ...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.