আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড় গল্প : এ্যালবাম

.

১. ঘরে পানি ঢুকবে , দাঁড়াও দাঁড়াও বলে, জহিরকে দরোজার বাইরে দাড় করিয়ে রেখে দ্রূত দৌড়ে ভেতরে ঢুকে একটা তোয়ালে এনে দেয় ইয়াসমিন। বাইরে তখনো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো বাতাস। বাইরে রাস্তায় গাছ পরেছে বেশ কয়েকটা। মিন্টু রোডেই তাই রিক্সা ছেড়ে আসতে হয়েছে।

বেইলি রোডের সরকারি কোয়ার্টারের তিন তলায় ইয়াসমিনদের বাসায় এই নিয়ে চতুর্থ বার এলো জহির। আগের তিন বার এসেছে কমপক্ষে দশ বছর আগে। এতো দিন পর যে দেখা ইয়াসমিনের মুখ দেখে বুঝার কোন উপায় নেই। মুখে উজ্জল হাসি জ্বালিয়ে জহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বলে , জুতো জোড়াও বাইরে রেখে এসো।

বাইরের ঘরে ছোট একটা বাচ্চার কথা বলা নিয়ে হাসা হাসি করছিলেন ইয়াসমিনের মা, বড় ভাইসহ অচেনা দুটি মেয়ে। জহিরকে দেখে ওরা ভেতরের ঘরে চলে যায়। পেছন থেকে ইয়াসমিন ডাকে , মা মা তুমি জহিরকে চিনতে পার নি! ইয়াসমিনের মা ডাক শুনতে পাননি মনে হয়। ভেতরে গিয়েছেতো গিয়েইছে। পনের মিনিটের মতো হলো ইয়াসমিনের দেখা নেই।

সন্ধ্যায় এক মূহুর্ত দেখলেও মেয়েটা আগের চেয়ে কত রূপসী হয়েছে সামনা সামনি না দেখলে কল্পণাও করতে পারতো না জহির। সঙ্গে ইয়াসমিনের হাসিটাও বদলেছে অনেক। আগে ওর হাসি দেখলে বিভ্রান্ত হতো জহির। হাসিতে কেমন উপেক্ষা মেশানো থাকতো। তোয়ালে এগিয়ে দেয়ার সময়ের হাসিতে গভীর আন্তরিকতা ফুটে উঠেছিল।

স্নিগ্ধ। মায়াময়। রুমে ঢুকছে ইয়াসমিন। হাতে এলবামের মতো কিছু একটা। তার পেছনে ট্রে হাতে অন্য একটি মেয়ে।

গোপনে দীর্ঘশ্বাস চাপে জহির। কত আগেই, পরিচয়ের কয়েক দিনের মধ্যে সেই সঙ্গীত সন্ধ্যায় সে নিশ্চিত হয়েছিল এই মেয়েটা তার আপন কেউ হবে না কোন দিন ! ভেতরে ঢোকার সময়ে দেখা শিশুটি নিশ্চয়ই ইয়াসমিনের! এলবামের নিচ থেকে একটা শার্ট ও পাজামা বের করে জহিরকে দেয় ইয়াসমিন। ওয়াশ রুম দেখিয়ে বলে ভেজা কাপড় ছেড়ে আসো। এগুলো শুভর। তোমার গায়ে লেগে যাবে মনে হয়।

তাড়াতাড়ি করো। চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। রাতও হয়েছে অনেক। কতো কথা বলতে হবে। এর মধ্যেই তুমি অনেক ঝামেলা করেছো ! ২. বৃদ্ধ সেঁতার বাদক আঙ্গুলের জাদুতে কী এক অচেনা মিষ্টি আবহ সৃষ্টি করলেন।

গভীর মননিবেশ তার। রেজওয়ানা চৌধুরী বণ্যার মৃদু মাথা দুলুনি তাকে বাদ্যযন্ত্রগুলোর আঁকুতি,চিৎকার আর ফুফিয়ে কান্নার মধ্যমনি করে তুললো। তার ডান হাতের ইঙ্গিত শূন্যে বাতাসের ক্যানভাসে রঙিন অদৃশ্য কালিতে এঁকে দিচ্ছিল সুরের রূপকল্প। পুরো ঘটনাটাই তিনি ঘটালেন ত্রিশ - পয়ত্রিশ সেকেন্ডে ! বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা আশার ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের ফিল্ড অফিসার জহির আহমেদ মাথা ঘুড়িয়ে চার পাশে দেখে। সঙ্গীতে মগ্ন এই দর্শক শ্রোতার মধ্যে নিজেকে তার খুব অবাঞ্ছিত মনে হয়।

এমন সুন্দর পরিবেশ এর আগে কখনো দেখেনি। খুব প্রশান্তি ছড়ানো। তাড়াহুড়ো নেই কারো মধ্যে। ইয়াসমিন মঞ্চের দিকে তাকিয়ে আছে। অফিসে অন্য একটি বিভাগে ট্রেইনার হিসেবে কাজ করে সে।

বড্ড নাক উঁচু স্বভাবের। এই মূহুর্তে তাকে সুচিত্রা সেনের মতো কোমল,আটপৌরে,রহস্যময় ও আকর্ষণীয় লাগছে। গানে ভীষণ মগ্ন হয়ে আছে । জহির তাকিয়ে আছে লক্ষ্য করে সৌজন্য করে হাসে। আবার মনযোগ দেয় গানে।

ইয়াসমিনের লম্বাটে ফর্সা মুখ হল রুমের নরোম আলোয় খুব পরিচিত ও আপন মনে হয় । সেঁতারের একটা মৃদু ঢেউ মিলিয়ে যেতে যেতে হলের নিস্তব্দতা আরো গাঢ় করে দিচ্ছিল। অকস্মাৎ স্টেজের অন্ধকার অংশের সাথে প্রায় মিলিয়ে থাকা একজন মানুষ নড়ে উঠলেন। তার কিবোর্ড থেকে চৈত্র বিকালে আনন্দ মাখা বাতাসের উচাটন আর হাতছানিসহ বাঁশির সুর ধ্বনিত হলো। বণ্যা সুর তুললেন।

তুমি খুশি থাকো আমার পানে চেয়ে চেয়ে... খোলের উদ্দীপনা ,সেঁতারের আনন্দ আর এই বণ্যার সুরের ঢেউ কোথায় ডেকে নিচ্ছে ! নাকি সে সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে অপরিচিত এই আয়োজনে, মুগ্ধতায়। পথে ঝড়া পাতা উড়ে যাওয়ার মতো স্বল্প সময় ইয়াসমিনের সামনে থাকলেও এই অল্প চেনা মেয়েটিই এখন পর্যন্ত জহিরের সবচেয়ে কাঙ্খিত মানুষ । তার কাছাকাছি থাকা সময়টুকুর প্রতিদিনের প্রতি মূহুর্ত মনে ভাসে । ৩. আজ আবার কত দিন পর ইয়াসমিনকে দেখলো জহির? নিজে নিজে হিসেব করে সে। দশ বছর হলো প্রায়।

সময় কি দ্রুত চলে যায়। আর এই সময় কি অসম্ভব সুন্দর করে দিয়েছে মেয়েটাকে ! ঝড় বর্ষার এই সন্ধ্যায় কোত্থেকে এলো সে। বৃষ্টি কনা মাখা দমকা বাতাসের সন্ধ্যাটা রাত্রির রূপ ধরেছে ইতোমধ্যে। ইয়াসমিনকে দেখতে ভুল হয়নি। বৃষ্টির ছটা থেকে রক্ষা পেতে পলিথিনের পর্দা জড়িয়ে সিটের মাঝামাজি সোজা হয়ে বসে চোখ বন্ধ করে ছিল।

জহির ভেবে কূল করতে পারে না এই সরল স্বভাবের মেয়েটা তাকে এতো কষ্ট দিতে পারে কিভাবে ! একান্ত আপন ও ঘনিষ্ট কেউ না হয়েও। আজ সন্ধ্যায় একটু কথা বললে কি হতো ! পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে মানুষ এমনি এমনি কত কথাইতো বলে। তীব্র অভিমানবোধ জাগে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া বন্ধুটির প্রতি। অবশ্য মদের দোকানের সামনে জহিরকে দেখলে খারাপ ধারনা করতো ইয়াসমিন। কি না কি ভাবতো এই ভেবে চোখাচোখি না হওয়ায় এক ধরনের স্বস্তি বোধ করলেও ইয়াসমিনের আচরনটা কিছুতেই মানতে পারছে না জহির।

অনুমান করে আজিজ মার্কেট বই কিনতে গিয়েছিল হয়তো। সেখান থেকে ভেতরের রাস্তা দিয়ে সাকুরার সামনে দিয়ে শেরাটন পর্যন্ত রিক্স্রা নিয়েছে। এদিকে রাস্তাটা একটু নির্জন। ইয়াসমিনরা এখনো বেইলি রোডে কোয়ার্টারে থাকি নাকি! ইয়াসমিন নিশ্চয়ই ওকে দেখতে পেয়েছে ! দেখেও উপেক্ষা করেছে। দূর থেকে দেখে পাশ কাটানোর সময় চোখ বন্ধ করে ছিল।

যাতে চোখাচোখি হতে না হয়। তখন জহির সবে মাত্র একটা পা দিতে যাবে সিড়িতে। দেখতে একটু মুটিয়েছে ইয়াসমিন। বিয়ে করেছে কাউকে ? বিয়ের দাওয়াত দেয়ার মতো সম্পর্ককি ছিল ওদের? এমন পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার মতো সুসম্পর্ক ছিল বলে হয়তো মনে হয়নি ইয়াসমিনের কাছে। হয়তো মনেই ছিল না ! বারে আজ অনেক ভীড়।

হৈ চিৎকার , কোলাহলে কান পাতা দায়। কোনার টেবিলে একবুড়ো খুব কাশছেন। তার গায়ে মোটা একটা সুয়েটার । গলায় মাফলার জড়ানো। সঙ্গে আরো কয়েকজন বুড়ো।

হঠাৎ বাইরে বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ বাড়ে। ইয়াসমিন নিশ্চয়ই এতোক্ষণে পৌঁছে গেছে। রাত আটটা বাজে প্রায়। লম্বা রুমটির মাঝামাঝি একটা ছোট টেবিলে একা বসে আছে জহির। কয়েকজন বন্ধু আসার কথা ছিল আজ।

বর্ষার জন্য আসতে পারবে কিনা কে জানে। ফোন না করে অপেক্ষা করতে থাকে । ঝুম বৃষ্টি বাইরে। কাঁচের জানালার ফাঁকফোকর গলে বৃষ্টির ছাট এসে পরছে কিছুটা। সোডিয়াম বাতির হলদেটে আলোয় রাস্তার ওপারের কয়েকটা গাছ নুয়ে পরেছে ।

বাইরে থেকে বাতাসের শো শো শব্দ আর রুমের ভেতর লোকজনের কান ফাটানো চিৎকার খুব আনন্দময় মনে হয় জহিরের কাছে। যেন আগের যুগের কাঠের জাহাজে করে সাগর পাড়ি দিচ্ছে সবাই। বৃষ্টি বাতাসে সাগর রুদ্ররূপ নিতে যাচ্ছে। সে দিকে ভ্রƒক্ষেপ নেই কারো। সবাই উল্লাস করছে।

ইয়াসমিনকে সন্ধ্যায় দেখার পর থেকেই মনে ভাল লাগা ছড়িয়ে আছে। যদিও ওই গান শোনার সন্ধ্যায়ই জহির জেনে যায় এই মেয়েটির মন অন্য কোথাও অন্য কারো কাছে বাঁধা পরে আছে। ইয়াসমিনই ওকে গানের আসরে নিয়ে গিয়েছিল। পাবলিক লাইব্রেরীতে রেজওয়ানা চৌধুরী বণ্যার একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। রেজওয়ানা চৌধূরী বণ্যার কাছে গান শিখে ইয়াসমিনের পরিচিত একজন।

সে দুটো টিকেট দিয়েছে। জহিরকে কী কারণে সে বলে বিকেলে গান শুনতে চলেন। কোন কাজ নেইতো ? জহিরের হোন্ডায় চড়তেও আপত্তি তার। বলে, অটো নেন। ইয়াসমিনের এই অধিকার খাটিয়ে কথা বলা এলোমেলো করে দিয়েছিল জহিরকে।

গোপনে ভাললাগা দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছিল। ৪. অফিস ট্রেনিংএ সারা দেশের ব্রাঞ্চগুলো থেকে আসা প্রায় আট হাজার তরুণ তরুণীর মধ্যে কিভাবে কিভাবে জহির ও ইয়াসমিন ব্যক্তিগত কথা বিনিময়ের পর্যায়ে পৌঁছতে পেরেছিল। পরিচয়ের পর কথায় কথায় ইয়াসমিন জানিয়েছিল, তার প্রিয় ফুল জারুল। কাঠফাটা রোদের মধ্যে জারুল ফুলের রঙ দেখতে খুব ভালো লাগে। এর বেগুনি পাপড়ির দিকে কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে চোখ বড় করে তাকিয়ে সামনে রোদের দিকে হঠাৎ দেখলে রোদের তরঙ্গও ষ্পষ্ট বেগুনি হয়ে যায়।

দেখতে ভালো লাগে। ইয়াসমিনের ছেলেমানুষি কথায় হাসিতে ভেঙ্গে পড়েছিল জহির। সেদিনও আকাশ মেঘলা ছিল। শ্যামলির অফিস থেকে আগে আগে বের হয় দুজন। অল্প চেষ্টাতে একটা অটোও জোগাড় হয়ে যায়।

শাহবাগ আসার পর পাবলিক লাইব্রেরীর সামনে থামতে না দিয়ে অটো চালককে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে নিয়ে আসে জহির। ইয়াসমিন বাঁধা দেয়না। বলে, অটো হলো মিনি আইল্যান্ড । যাত্রীদের স্বাধীন ভুমি। বলে রহস্যময় হাসে।

পুরুষ সঙ্গী এর অর্থ ভালো বুঝতে পারে না। বয়সি গাছটির নিচের দিকের একটি ডাল টেনে এক থোকা ফুল ছিড়ে এনে দেয় ইয়াসমিনকে। সে ফুলগুলো হাতে পেয়ে ঝলমলিয়ে ওঠে। কোথায় দেখি দেখি বলে অটো থেকে নেমে গাছটির দিকে তাকায়। ইয়াসমিনকে মুগ্ধ হতে দেখে জহিরের মন ভরে যায়।

ফিরতি পথে ফুলগুলো বার বার আগ্রহ নিয়ে দেখছিল ইয়াসমিন। ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে পাবলিক লাইব্রেরী পর্যন্ত খুশিতে ডগমগ সঙ্গীনি নিয়ে পথ পাড়ি জহিরের জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। জহিরকে লজ্জাহীন স্বপ্ন উচ্ছসিত করে তুলেছিল। গানের অনুষ্ঠানে ডাকা, ফুল পেয়ে খুশি হওয়া- এসবের হাজার অর্থ করে মনে মনে। অবাক হয়ে ফুল দেখার সময় জহির পাশে পাশে হেঁটে কে বেশি লম্বা মাপার চেষ্টা করছিল।

ইয়াসমিন বুঝে ফেলে । হেসে বলে আমি আপনার চেয়ে একটু বেশিই হবো ! আমি পাঁচ ফুট পাঁচ। জহির লজ্জা পেয়ে বলে, না না আমি তা দেখিনি। ফুল দেখছিলাম ! হলে রুমমেট শহিদুলের গানের প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। অনেক মুখস্তও ছিল।

তার থেকেই যা গান শোনা হয়েছে। ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল একটা । দিন রাত গানের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল দীর্ঘ দিন। শহিদকে কখনো কখনো খুব নিঃসঙ্গ ও দুঃখি মনে হতো । বন্ধু বান্ধব বিশেষ ছিল না।

কারো সাথে মিশতেও চাইতো না। এই গানটা নিয়ে শহিদুলের আলোচনা মনে পড়ে । জহিরের কাছে প্রেমের গান মনে হলেও শহিদুল বলেছে ,ওভাবে ভাবতে পারো। তবে এটা মূলত ঈশ্বর বন্ধনা। মিলিয়ে দেখ।

কিন্তু বন্ধুত্ব মনে করে শুনলে মন্দ কি। রবীন্দ্রনাথতো এসে না বলবেন না। যার যেমন ভালো লাগে। ভালো লাগলো কি না এটাই আসল কথা। ৫. বণ্যার কণ্ঠ আর তাতে সেঁতার , খোল ও বাঁশির সঙ্গত জহিরকে অচেনা দুজন মানুষের রঙিন সুখ দৃশ্যে নিয়ে যায়।

এর আগে অটো থেকে হল রুমে আসা পর্যন্ত লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে ইয়াসমিনের পোষাক না শরীর থেকে উড়ে আসা মিষ্টি ঘ্রান পাওয়ার চেষ্টা করছিল। গানে মোহিত হয়ে যায় জহির। কেউ যেন তার প্রিয় মানুষটির দিকে তাকিয়ে খুশিতে আত্মহারা। নাকি তার প্রেয়সিই বেশি খুশি প্রেমিকের আনন্দ দেখে। ভাবনার সূত্র তাকে একটা মৃদু খটকায় পৌঁছে দেয়।

ইয়াসমিন কখনো তাকে খুশি করতে কিছু করবে? তাদের সম্পর্ক এতো ভালো কখনো হবে! চিন্তার পর পর নিজের কাছেই তা অবান্তর মনে হয়। ‘তোমার পরশ আমার মাঝে সুরে সুরে বুকে বাজে’- গায়িকা অন্তরার এখানে পৌঁছতেই স্বগতোক্তির মতো আহা বলে মুগ্ধতা প্রকাশ করে ইয়াসমিন। চমকে তার দিকে তাকিয়ে জহির দেখে, হাঁটুর উপর মোবাইল ফোনটি উচিয়ে ধরে আছে ইয়াসমিন। স্টেজমুখো করে। মুহুর্তে মাথা ফাকা হয়ে যায় জহিরের।

ফোনে ইয়াসমিন কাউকে গানটি শোনাচ্ছে। যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো মাথায়। যা কোন দিন পায়নি তাই হারানোর গভীর ব্যথা অনুভব করে। পাশে বসা মেয়েটিকে অনেক দূরের ও অচেনা জগতের মানুষ মনে হয়। খুব সুন্দর না বলে গানের এক পর্যায়ে লাইন কেটে উঠে দাড়ায় ইয়াসমিন ।

বলে চলুন। অনেক রাত হয়ে গেল। জহির অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মন জুড়ে থাকা বিষাদের আস্তর , বিস্ময় কাটিয়ে বলে - চলুন। বার বার প্রয়োজন নেই বললেও ইয়াসমিনকে বাসায় পৌঁছে দিতে সঙ্গী হয় জহির।

পুরো পথ জুড়ে কোন কথা হয় না। আবার বিষণ্নতা গ্রাস করে জহিরকে। অটোতে নিজের হাঁটুতে রাখা হাত বেখেয়ালে ইয়াসমিনের হাঁটু ছুয়ে গেলে মোবাইল দিয়ে মৃদু ঠুকে সচেতন করে হাত সরিয়ে নিতে বাধ্য করে। এই দূরুত্ব আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি জহির। বা নিজেই দ্রুত দূরে পালাতে চেয়েছে।

এক সুখের সন্ধ্যা তাদের হাজার দিন রাতের দূরুত্বে ঠেলে দিয়েছিল। কোন ট্রেনিংএ ইয়াসমিনকে দু এক বার স্বভাবসুলভ আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে কথা বলতে দেখেছে জহির। কিন্তু সে অসীম ঈর্ষায় কুকড়েই গিয়েছে শুধু। এর পর ঢাকার বাইরে পোস্টিং। চাকরি ছেড়ে নতুন করে শুরু করা।

বৃষ্টি একটু কমতে বার প্রায় খালি হয়ে গেল। এ কোনায় ও কোনায় ছড়িয়ে থাকা টেবিলে কয়েক জন বসে আছেন। ওয়েটার এসে বৃষ্টি কমেছে বলে জানায়। আর জিজ্ঞেস করে কিছু খেলেন না স্যার ? জানালা খুলে নিচে তাকাতে রাস্তায় থৈ থৈ পানি চোখে পড়ে। শীতল মিষ্টি হাওয়ার ধাক্কা লাগে নাকে মুখে।

চকিতে লোভটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আঙ্গুল নিয়ন্ত্রণহীন যেন। নাম্ভার টিপে কল করে দেয়। ওপ্রান্তে ইয়াসমিনের কণ্ঠস্বর ! ৬. গোসল করার পর একটু শীত শীত লাগছে জহিরের। ইয়াসমিন এলবামটি চিন্তিতভাবে ওল্টানোর ফাঁকে দ্রুত চা শেষ করতে বলে জহিরকে।

এরপর ইয়াসমিনের কথায় ও কা-ে হতবাক হয়ে যায় জহির। হাতে ছবি রাখার মতো বড় একটি এলবাম দেখিয়ে বলে, আজ রেজাল্ট ঘোষণা করবো। এটা হলো আমার প্রেম খাতা। বুঝতে পারার পর থেকেই ছেলেদের নোংরা দৃষ্টিতে গা রি রি করে উঠতো আমার। এখনো তাই।

ঠিক করেছিলাম,কারো দৃষ্টিতে যদি এই অসস্তি না থাকে আর সে যদি বন্ধু হতে চায় তাহলে বন্ধু করে নেব। কিন্তু,খুব কম ছেলেই দেখেছি এমন। এই যে এই ভিউ কার্ডটা ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় আমাদের মালিবাগের বাসার পাশের টিটু দিয়েছিল। সাদার মধ্যে কমলা ছোঁপ দেয়া দুটো পায়ড়া ঠোঁট মিলিয়ে পাখা ঝাপটাচ্ছে এমন ছবি আঁকা একটি ভিউ কার্ড দেখিয়ে বলতে থাকে ইয়াসমিন। পরে একবার মাথা টাকলু করে বখাটেদের সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করায় ওর কিছু আর এ্যালবামে রাখিনি।

এই চিঠিটা আবীর দিয়েছিল। ওর অনেকগুলো চিঠি আছে। কিন্তু হঠাৎ করে সাহস বাড়িয়ে দেয়ায়,বাআআদ! এমন ভাবে বাদ বলে ইয়াসমিন , যেন বাদ দেয়া খুব আনন্দের। এরপর দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে মনযোগ দিয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে কয়েকটা পাতা উল্টে যায় ইয়াসমিন। কয়েকটি পাতায় ওর হাতের লেখা দেখতে পায় জহির।

মনে হয় ওর কোন ছেলের আচার ব্যবহার নিয়ে পর্যবেক্ষণ... মনে মনে ভাবে জহির। এই যে এটা হলো আপনার একাউন্ট ! চেয়ারে দু হাঁটুর উপর এলবামটি খুলে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে টোকা দেয় ইয়াসমিন। তারপর মনোযোগ দিয়ে তাকায় জহিরের দিকে। নিরবতা ভাঙ্গে ইয়াসমিনই। ফলাফল ঘোষণার নাটকীয় কণ্ঠে বলে , আপনি বিপুল ভোটে এগিয়ে রয়েছেন ! আপনাকে বেসরকারী ভাবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হলো।

আপনাকে অভিনন্দন জনাব জহির আহমেদ ! আর এই হলো আপনার সেই ঐতিহাসিক জারুল ফুলের পাপড়ি । শুকিয়ে শুটকি হয়ে গেছে ! কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না জহির। ইয়াসমিন ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। এবারও নিরবতা ভাঙ্গে ইয়াসমিন। বলে,এবার তাহলে রক্ষা করুন স্যার।

বাসায় যান। অনেক রাত হলো। আপনাকে এখন বাসায় থাকতে দিলে বুড়ো বয়সে মায়ের হাতের মার খেতে হবে। শুভর শার্ট,পাজামা কাল এসে দিয়ে যেয়ো। জহির উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু আমি প্রথম হলাম কি করে ? আমি আজ ফোন না করলেতো জীবনে এই ফলাফল জানতাম না।

সন্ধ্যায় আমাকে দেখে চোখ বুজে ছিলেন কেন! আমি ফলাফল জানানোর জন্য তোমাকে অনেক খুঁজেছি । তিন বছর আগে রাজশাহী ব্রাঞ্চে ট্যুরে গিয়েছিলাম তুমি ওখানে আছো শুনে। পরে জেনেছি তার আগেই তুমি ছেড়ে চলে গেছ। আর সন্ধ্যায় যে, চোখ বুজেছিলাম তখন তুমি আমাকে দেখেছিলে ? আমি চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির শব্দ শুনছিলাম। তুমি তখন ডাকোনি কেন ! আমাকে দেখে তুমি চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে গিয়েছ দেখে মন খারাপ হয়েছিল।

তাই ডাকিনি। বলতে বলতে দরোজা খুলে দেখে বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে আবার। আরে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছতো, বলে এগিয়ে এসে দরোজা চাপিয়ে দিয়ে ইয়াসমিন প্রশ্ন করে, আচ্ছা জহির তুমি বণ্যাদির গানের অনুষ্ঠানের পর এতো মন খারাপ করেছো কেন ? জহিরের মন আবার বিষাদে ছেয়ে যায়। বলে , আমরা দুজন গান শুনতে গিয়েছি ,কিন্তু তুমি ফোনে কাউকে গান শোনাচ্ছ ! জহির কথা শেষ করতে পারে না। হাত তুলে তাকে থামিয়ে হুবহু যেন বৃষ্টির শব্দ নকল করে হাসিতে ভেঙ্গে পরে ইয়াসমিন।

বলে, আমি সে রাতে গান শুনিয়েছি মিতু কে। আমার ছোট বোন ওকে চেন না ! তোমার নাম্বার আরো বাড়িয়ে দেব চিন্তা করো না। বোকামিতে তোমাকে কোন নাম্বারই দেয়া হয়নি,আমি খুব দুঃখিত। আচ্ছা তুমি এখন যাও। দাঁড়াও দাঁড়ায় ছাতাটা নিয়ে যাও।

বাসায় পৌঁছেই ফোন করে জানিও জহির । ইয়াসমিনের কণ্ঠের মমতা জহিরকে আরো ঘোরগ্রস্ত করে ফেলে। মুখ ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে দরোজার বাইরে পা বাড়ায় সে। বৃষ্টির ফোটা এড়ানোর জন্য ছাতাটা সামনে বাড়িয়ে একটু ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে। পেছন থেকে ইয়াসমিনের কণ্ঠ শুনতে পায় জহির।

শিগগির পাপড়িগুলো বদলে দিও কিন্তু ! পেছন ফিরে জহির দেখতে পায় ইয়াসমিন দরোজা বন্ধ করে দিচ্ছে। মেয়েটার হাসিমাখা মুখ এক মুহুর্তের জন্য দেখতে পায় সে। রচনা: ২৫ ফেব্রুয়ারি - ২৬ এপ্রিল , ২০১০ ইং উৎসর্গ : জহির রায়হান শেষ বিকেলের মেয়ে উপন্যাসের জনক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।