আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজা-বাদশার কিসসা

লিখে খাই, সবার ভাল চাই

রাজা-বাদশার কিসসা শামীমুল হক রাত অনেক। আকাশে তারা। সবাই খুশি। কারণ আজ দাদা কিসসা শোনাবেন। রাজা-বাদশার কিসসা।

এ কারণে বাড়ির সবাই সজাগ। বউরা চা-বিস্কুট নিয়ে ব্যস্ত। উঠানে মাদুর বিছানো হলো। দাদার সামনে হুক্কা। বাড়ির সকল ছেলে-মেয়ে হাজির।

দাদার কিসসা শুনতে গাঁয়ের আশপাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েরাও এসেছে। দাদা শুরু করলেনÑ বহুদিন আগের কথা। বাগদাদ শহরে বাস করতো এক লোক। তার নাম আমির হোসেন। বিয়ে করেছে।

বুঝেছ? কেউ কোন কথা বলে না। ক্ষেপে গেলেন দাদা। কারণ, দাদা কিসসা বলার সময় তার সঙ্গে-সঙ্গে হ্যাঁ বলতে হয়। কেউ হ্যাঁ না বলায় চটে গেছেন। আমরা সবাই একসঙ্গে বলেবলে উঠলাম, হ্যাঁ।

তারপর? আবার দাদা বলতে শুরু করলেনÑ আমির হোসেন বিয়ে করেছে। তার একটা সন্তানও হয়েছে। ছোট একটা দোকান দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে। তবে সুখী সংসার আমির হোসেনের। স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে কোনদিন ঝগড়া-ফ্যাসাদ হয় নি।

বুঝছ দাদারা? জ্বী দাদাÑ তারপর? তারপরÑ তাদের দু’জনের মধ্যে বহুত মায়া-মহব্বত। হঠাৎ আমির হোসেনের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে। কোন কিছু খেতে পারে না। এ অবস্থায় আমির হোসেন তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলোÑ তোমার কি হয়েছে? দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছো।

বলো, তুমি কি খেতে পারবে? তোমার মনে কি চায়? কি করলে তোমার ভাল লাগবে? স্ত্রী বলে, না আমার মনে কোন কিছুই চায় না। তবে মনে হয়, আনার খেলে ভাল লাগবে। কথা শুনেই আমির হোসেন আনার-এর খোঁজে বের হলো। কিন্তু কোথাও আনার পাওয়া যাচ্ছে না। গেল শহরের সবচেয়ে বড় ফলের দোকানে।

সেখানেও নেই। এরপর গেল ফলের বাগানে। সেখানেও আনার গাছগুলো ফাঁকা। বাগান মালিককে জিজ্ঞাসা করলো, আনার কোথায় পাওয়া যাবে? বাগানি বললো, ভাইলো এখন আনারের সময় নয়। বাগদাদ শহরের কোথাও আনার পাওয়া যাবে না।

তবে বার্লিন শহরে একটা খুব বড় বাগান আছে। সেখানে খোঁজ করে দেখতে পারেন। পেলে পেতেও পারেন। এ কথা শুনে আমির হোসেন ছোটে বার্লিন শহরের উদ্দেশে। সেখানে গিয়ে খুঁজে বের করল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাগান।

বাগান মালিকের কাছে গিয়ে বললো, ভাইলো আপনার বাগানে কি আনার পাওয়া যাবে? বাগান মালিক বলল, না ভাই, এখনও আনারের সময় হয় নি। তারপরও চলেন, বাগানে গিয়ে দেখি পাওয়া যায় কিনা। বাগানে গিয়ে তারা খুঁজতে থাকে আনার। খুঁজতে-খুঁজতে দেখে এক গাছে তিনটি আনার রয়েছে। দেখেই খুশিতে টগবগ সে।

তিনটি আনারই বেশি দাম দিয়ে কিনে ফেললো। বাড়ি এসে স্ত্রী’র হাতে আনারগুলো দিয়ে বললো, এগুলো খেয়ে ফেলো। স্ত্রী বললো, এখন না, রেখে দেন পরে খাবো। আমির হোসেন নিজ হাতে আনারগুলো রেখে দোকানে চলে গেল। মন দিয়ে ব্যবসা করছে।

হঠাৎ দেখে এক লোক দোকানের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হাতে একটি আনার। দেখেই চমকে ওঠে। এদেশে তো আনার পাওয়া যায় নাÑ সে কোথায় পেলো? লোকটিকে ডাকলো আমির হোসেন। জিজ্ঞেস করলÑ এগুলো কোথায় পেলেন? লোকটি বলল, আমাকে এক মেয়েলোক ভালবাসে।

সে আমাকে দিয়েছে। কথা শোনামাত্রই আমির হোসেনের মাথা গরম হয়ে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গেল। স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো, আনার খেয়েছ? স্ত্রী বলল, না, আনার খাই নি। আমির হোসেন জিজ্ঞেস করলÑ আনার কোথায়? স্ত্রী বললো, যেখানে রেখেছেন সেখানেই আছে।

আমির হোসেন সেখানে গিয়ে দেখে দু’টি আছে, একটি নেই। আবার আমির হোসেন স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলোÑ এখানে দু’টি আছে, আরেকটি কি করেছো? স্ত্রী বলল, আমি কিছুই করি নি। আমির হোসেন বলল, সত্যি কথা বলো? না হয়, অবস্থা খারাপ হবে। এ সময় স্ত্রী আবার বললো, আমি কিছুই করি নি। এমনিতেই দোকানের সামনে লোকের হাতে আনার দেখে রেগে অস্থির ছিলÑ এখন আবার স্ত্রী’র মুখে এ কথা শুনে আরও রেগে যায় আমির হোসেন।

একটি তলোয়ার দিয়ে কুপিয়ে স্ত্রীকে সে কেটে টুকরা টুকরা করে ফেললো। তারপর টুকরাগুলো কাঠের বাক্সে করে নদীতে ফেলে দিলো। বাড়ি এসে ঘরের রক্ত পরিষ্কার করছে। এ সময় তার সন্তান বাড়ি এসেছে। ছেলে কাঁদছে।

ছেলেকে কাঁদতে দেখে বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করছে, বাবা কাঁদছিস কেন? ছেলে বলে, বাবা আমার হাতে একটা আনার ছিল। এক লোক আমার হাত থেকে আনারটা নিয়ে গেছে। আমি বলছি, আমার বাবা অনেক কষ্ট করে আনার যোগাড় করেছে। সে আমার কথা শোনে নি। আনারটা নিয়ে গেছে।

কথা শুনেই আমির হোসেন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এখন কি উপায় হবে? আমি একি করলাম? একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে আমির হোসেন। এ সময় তার শ্বশুর আসে। এ অবস্থা দেখে তিনিও কাঁদতে থাকেন। এরপর আমির হোসেনকে বলেন, বাবা, চুপ করো।

কান্নাকাটি করলে কোন লাভ হবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন গোপন করার চেষ্টা করো। চুপ হয়ে গেল আমির হোসেন। ওদিকে বাগদাদ শহরের বাদশাহ হারুনুর রশীদ প্রায় রাতেই ছদ্মবেশে বের হন।

প্রজাদের পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখেন তিনি। সে রাতেও বাদশাহ হারুনুর রশীদ বের হলেন। তার সঙ্গে উজির। হঠাৎ দেখতে পান এক লোক আসছে জাল হাতে নিয়ে। বাদশাহর সামনে আসতেই জিজ্ঞেস করেন কে তুমি? এত রাতে কোথা থেকে এসেছো? লোকটি বলল, আমি একজন গরিব লোক।

মাছ ধরে বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে সংসার চালাই। আজ সন্ধ্যা থেকে এত রাত পর্যন্ত একটা মাছও পাই নি। আজ সন্তানদের নিয়া অনাহারে থাকতে হবে। বাদশাহ হারুনুর রশীদ জিজ্ঞাসা করলোÑ তোমার দৈনিক কত টাকা লাগে? জেলে বললো, প্রতিদিন মাছ বিক্রি করে যে টাকা পাই তা দিয়েই সংসার চালাই। এবার বাদশাহ বলে, তুমি আবার চলো নদীতে।

একবার জাল ফেলার জন্য আমি তোমাকে ১০০ টাকা দেবো। মাছ আসুক আর না-ই আসুক, কিংবা যা-ই আসুক তোমাকে ১০০ টাকা দেবো। বাদশাহর কথা শুনে জেলে আবার নদীতে যায়। আবার নদীতে জাল ফেলে। এবার জাল ওঠাতে খুব কষ্ট হয় তার।

জালে কি যেন আটকা পড়েছে। অনেক কৌশল করে জাল ওঠানো হলো। সেখানে দেখা গেল একটি কাঠের বাক্স। বাদশাহ জেলেকে টাকা দিয়ে বিদায় দিলেন। উজিরকে নির্দেশ দিলেন কাঠের বাক্সটি নিয়ে বাড়ি চলো।

বাড়ি নিয়ে বাক্স খুলে দেখেন মানুষের টুকরা। দেখে বাদশাহ উজিরকে বললেন, এটা কি উজির? আমার রাজ্যের মধ্যে মানুষ খুন হবে, আর উজিরের খবর থাকবে না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আজ থেকে তিন দিনের মধ্যে প্রকৃত খুনিকে বের করে আনতে হবে। অন্যথায় তোমাকে সপরিবারে ফাঁসি দেয়া হবে। রাজার নির্দেশ শুনে উজির অস্থির হয়ে গেলেন।

কিভাবে এ খুনের রহস্য উদঘাটন করবেন তা নিয়ে চিন্তিত। দেশের যত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা , সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের হুকুম দিলো তিন দিনের মধ্যে এর রহস্য ও খুনিকে উদ্ধার করতে হবে। সবাই মিলে রাজ্যের আনাচে-কানাচে খবর করতে লাগলো। কিন্তু কোন রহস্য পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের সবাই অস্থির হয়ে গেল।

ওদিকে আমির হোসেন ও তার শ্বশুর তিন দিন পর্যন্ত রাজ্যের কোন খবর রাখে নি। বাইরে কি হচ্ছে তারা কেউই তা জানে না। তিন দিন পর খবর পেলো দেশের উজিরকে কাল সপরিবারে ফাঁসি দেয়া হবে। কারণ, নদীতে টুকরা-টুকরা করা লাশ পাওয়া গেছে। এর খুনিকে বের করতে না পারায় উজিরকে বাদশাহ এ শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

এ কথা শুনে আমির হোসেন বললো, আমি উজিরকে বাঁচাব। শ্বশুর বলে তুমি গেলে বাচ্চাদের বাঁচানো যাবে না। তারচেয়ে বরং আমি যাবো। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। হঠাৎ আমির হোসেন ছুটে যায় ময়দানে।

সেখানে উজিরের মৃত্যুদণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছে জল্লাদ। এ সময় আমির হোসেন চিৎকার করে বলে ওঠে, আমিই সেই খুন করেছি। আমিই খুনি। ওদিকে শ্বশুর দৌড়ে গিয়ে বলেন, সে নয়, আমি খুন করেছি। আমিই খুনি।

এ অবস্থায় বাদশাহ দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন। আবার বিচার শুরু হলো বাদশার দরবারে। আমির হোসেনকে বাদশাহ বললেন, সত্য কথা বলো। তখন আমির হোসেন পুরো ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে বাদশাহ সেই আনার নিয়ে যাওয়া লোকটিকে তিন দিনের মধ্যে খুঁজে বের করতে উজিরকে নির্দেশ দেন।

অন্যথায় আবার তাকে সপরিবারে জল্লাদের হাওলা করে দেয়া হবে। উজির আবারও মহাবিপদে পড়লেন। সমস্ত রাজ্যে গোয়েন্দা লাগিয়ে ওই ব্যাক্তিকে খুঁজতে লাগলেন। কোথাও পাওয়া যায় না তাকে। এ চিন্তায় উজির খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন।

বাড়ির আঙিনায় বসে উজির ভাবছেন, আজই তার শেষ দিন। কাল সকালেই সপরিবারে ফাঁসিতে যেতে হবে। এ সময় উজিরের চার বছরের মেয়ে এসে বলে বাবা, তুমি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছো কেন? কি হয়েছে তোমার। এ সময় উজির মেয়েকে কাছে টেনে কোলে নেন। দেখে মেয়ের পকেটে কি একটা রয়েছে।

জিজ্ঞেস করেন, তোমার পকেটে কি, মা? মেয়ে বলে, একটা আনার। কে দিয়েছে? বললো আমাকে হাবসি এনে দিয়েছে। কোথায় সে হাবসি। এরপর হাবসিকে নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হন উজির। প্রকৃত অপরাধী প্রমাণিত হলো ওই হাবসি।

কারণ মিথ্যা বলা বড় অপরাধ। হাবসি সেই মিথ্যাই বলেছিল। আমির হোসেনকে বলেছিল, এক মহিলা তাকে আনার দিয়েছে। এত কষ্ট করে আনা আনার দিয়ে দেয়ায় আমির হোসেন ুব্ধ হয়েছিল। এ জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে তার স্ত্রীকে।

এর জন্য দায়ী হাবসিই। বুঝেছো দাদাভাইরা। না! কেউই কোন উত্তর দেয় না। রেগে যান দাদা। কি ব্যাপার? তোমরা কেউ কোন কথা বলছো না? এবার সবাই নড়েচড়ে বসে।

দাদা বলেন, অর্থের ক্ষতি সময়ের ক্ষতি স্বাস্থ্যের ক্ষতি অনেক বড় ক্ষতি। কিন্তু মিথ্যার ক্ষতি সবচেয়ে বেশি! তাই মিথ্যাবাদী হওয়ায় ত্যাগ করেছি অনেক আত্মীয় ও স্বজনকেও। দেখো, তোমাদের যেন ত্যাগ করতে হয় না আবার! না-না! হা-হা করে ওঠে কিসসা-ভক্ত সবাই। #

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।