আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: সাধক ও সম্রাট

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের আশ্বিন মাসের এক স্নিগ্ধ ভোর। নদী পাড় থেকে ভেসে আসা অচেনা কন্ঠের গান শুনে বাংলার শেষ নবাব মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা মুগ্ধ হয়ে যেতে থাকেন। গানের কথা বাংলা, লোকজ বাংলা, লোকজ বাংলায় তত অভ্যস্থ নন নবাব, তবে সুরটাই টানল বেশি।

কেমন টানা-টানা উদাস করা সুর। ভোরবেলা বজরা নৌকার বিলাসবহুল প্রকোষ্ঠে আধো ঘুমে আধো জাগরনের ভিতর ছিলেন নবাব। নদী পাড় থেকে ভেসে আসা গানের সুরের রেষ চেতনায় মিশে যেতেই পরিপূর্ণ ভাবে সচেতন হয়ে উঠলেন। হাই তুললেন। সম্পূর্ন জাগ্রত হয়ে কিছু উদ্বেগও টের পেলেন মনের ভিতর।

কলকাতার অবস্থা ঘোলাটে, ইংরেজরা স্থানীয় দালালদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলার মসনদ দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। না, ইংরেজদের বাড়াবাড়ি আর মেনে নেয়া যায় না। একটি যুদ্ধ কি আসন্ন? দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নবাব গবাক্ষর দিকে তাকালেন। গবাক্ষর বাইরে ভোরের নবদ্বীপের অমলিন একটি আকাশ ছড়িয়ে আছে, যে আকাশে ষড়যন্ত্রের লেশমাত্র নেই, যত ষড়যন্ত্র মানুষের মনের গভীরের থিকথিকে অন্ধকারে। নবাব গতকালই কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ রওনা হয়েছেন।

বজরা নৌকাখানি যাত্রা বিরতিতে নবদ্বীপের কাছে গঙ্গার তীরে ভিড়ে আছে। নবাবেরর বাইশ বছর বয়েস। মাতামহ আলীবর্দী খানের মৃত্যুশয্যায় পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে মদ্যপান না করার শপথ করে সুরার আসক্তি ত্যাগ করলেও সুরের আসক্তি তার যায় নি- বিশেষ করে হিন্দুস্তানী রাগ সঙ্গীতের নবাবের আকর্ষন গভীর। নদী পাড় থেকে ভেসে আসা অচেনা কন্ঠের গানের সুর দেশিয় মনে হল। কেমন মন উদাস করে দেয়।

এই কে আছিস? নবাব প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন। অনতিবিলম্বে নাজির আমানুল্লা প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে। মাঝবয়েসি অভিজ্ঞ লোক সে, জাতে পাঠান। দীর্ঘ বলিষ্ট চেহারা, তবে এরই মধ্যে মাথার চুলে পাক ধরেছে। নবাবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত লোক এই নাজির আমানুল্লা।

নবাব বললেন, নদীপাড়ে বসে একজন কে গান গাইছে শুনতে পাচ্ছিস আমান? জ্বী। নবাব। যা, তাকে এখানে ডেকে নিয়ে আয়। সামনে বসে আমার এখন গান শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। নাজির আমানুল্লা ইতস্থত করে।

সে অভিজ্ঞ লোক। তার অবস্থান শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে বলেই বাংলার জনজীবনের খোঁজখবর তাকে রাখতে হয়। সে জানে নবাব যাকে ডেকে আনতে বলছেন সে লোকটা অত্যন্ত নির্ভীক আর স্বাধীনচেতা। সে নবাবের আমন্ত্রন উপেক্ষা করে নৌকায় নাও আসতে পারে। নবাব ঈষৎ রাগত স্বরে বললেন, কি হল? আমার কথা তোর কানে ঢোকেনি? এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে! অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে নাজির আমানুল্লা বলে, হজুর, আপনি যার গান শুনতে পাচ্ছেন সে অতি ত্যাড়া লোক ।

ত্যাড়া লোক মানে! হজুর, লোকটা এই অঞ্চলের একজন বিখ্যাত গায়ক। হু, তো। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাকে রাজসভায় যোগ দিতে বলেছিল। গায়ক রাজার প্রস্তাব আমলে নেয়নি। ও।

তাই নাকি? নবাবের তরুণ সুন্দর মুখে কী সব ভাবনা উঁকি দিল। হ্যাঁ। নবাব কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, যা, ওকে গিয়ে আমার কথা বল। এলে আসবে, না এলে না আসবে।

জোর করিস নে কিন্তু আমান, এ আমার হুকুম, লোকটাকে উচুঁ দড়ের সাধক বলে মনে হচ্ছে আমার। এখুনি যাচ্ছি হজুর। বলে নাজির আমানুল্লা প্রকোষ্ঠ ছেড়ে হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায়। নবাব হাত বাড়িয়ে একটি পারস্যনির্মিত রুপার পানপাত্র স্পর্শ করলেন; তিনি মদ্য পান না করলেও মাঝেমাঝে রুপার পানপাত্র স্পর্শ করেন, এতে এক ধরনের সুখ হয়। নবাব মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন অথচ এই মন্দ সময়টায় মদ খাওয়া জরুরি।

ঢাকায়, মুর্শিদাবাদে, কলকাতায় নবাবের বিরুদ্ধে অসহযোগ আর ষড়যন্ত্র -এ সময় মদ পান করা প্রয়োজন ছিল- মদ পান করলে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি হয়, সাহসী সব পদক্ষেপ নেয়া যায়। কিন্তু তা সম্ভব নয়, মদ পান করলে মাতামহ আলীবর্দী খানের রুহ কষ্ট পাবে। সিরাজ ছিল মাতামহ আলীবর্দী খানের চোখের মনি, আলীবর্দী খান সিরাজকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। না, মদ ছাড়া যতই অস্বস্তি হোক, মাতামহ আলীবর্দী খানের রুহ কষ্ট দেওয়া যাবে না। একটু পর নাজির আমানুল্লা ফিরে এল।

তার পাশে একটি গেঁয়ো ধরনের লোক । লোকটির বয়স বড় জোর পয়ত্রিশ কি ছত্রিশ হবে। কাঁধে ঝুলি, হাতে একটা কী যন্ত্র- একতারা বলে মনে হল। নবাব তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ছিলেন, এবার সিদে হয়ে বসলেন; হাজার হলেও শিল্পী, এদের শ্রদ্ধা করতেই হয়। গায়ক লোকটি এসেছে দেখে নবাব কিছু অবাকও হলেন।

নবদ্বীপের দোদন্ড প্রভাবশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রস্তাব উপেক্ষা করেছে...অথচ ...অথচ আমার ডাকে সাড়া দিল .. কেন? গায়কের গায়ের রং ময়লা, পরনে ধুতি-ফতুয়া, মাথার চুল উশকোখুশকো। একমুখ দাড়ি, তবে বড় বড় টলটলে দুটি চোখে গভীর ভাব খেলা করছে। নবাব ফারসি ভাষায় বললেন, বসুন, আপনি। নাজির আমানুল্লা লোকটাকে ফরাস দেখিয়ে দিল। লোকটা ফরাসের ওপর কাঁধে ঝুলি রেখে তার পাশে বসল।

কেমন জড়োসরো ভাব, চারিদিকে তাকাচ্ছে, এর আগে সম্ভবত নবাবী বজরার বিলাসবহুল প্রকোষ্ঠ দেখেনি । নবাব মনে মনে হাসলেন। জগতের প্রকৃত সাধকদের কাছে রাজা-বাদশাদের রংমহলে জৌলুষ অধরাই থেকে যায়, তবে তারা আরও গভীরতরো মধুর রূপরসে আচ্ছন্ন হয়ে থাকেন ... নবাব ইঙ্গিতে নাজির আমানুল্লা কে প্রকোষ্ঠ ছেড়ে চলে যেতে বলেন। তারপর গায়কের দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদুকন্ঠে জিগ্যেস করলেন, আপনার নাম? রামপ্রসাদ, রামপ্রসাদ সেন। বসতভিটে? কুমারহট্ট গ্রাম ।

কুমারহট্ট? কোথায় সেটি? চব্বিশ পরগনা হৌজুর। ওহ্ । তা এ দিকে কোথায় এসেছিলেন? রামপ্রসাদ বললেন, মায়াপুর। শ্রীচৈতন্যের আখড়ায় সংগীতের উৎসব ছিল। আমায় তারা ডেকেছিল।

আপনি কি বৈষ্ণব? না। তাহলে? আমি কালীসাধক, রাধাকৃষ্ণের গান আমি জানি নে । মহাপ্রভূর আখড়ায় মায়ের গানই গেয়ে এলাম। তেনারাও মন দিয়েই শুনল দেখলাম। আমি আর কি করতি পারি? ওহ্ ।

তা যাচ্ছেন কোথায়? একবার মুর্শিদাবাদ যাবার ইচ্ছে ছিল। শুনেছি সেখানে দিল্লি থেকে এক বড় ওস্তাদ এসেছেন, তার গান একবার নিজের কানে শুনতে ইচ্ছে হল আমার, আবার যদি কিছু শেখা যায়, সংগীত হল অকূল পাথারের মতন, কেউ বলতে পারবি নে আমি সব জানি। রামপ্রসাদ বললেন। নবাব উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে, আপনি মুর্শিদাবাদ যাবেন। আমরা তো সেখানেই যাচ্ছি, একটু পর নৌকা ছাড়বে।

আপনি আমাদের সঙ্গে যাবেন কি? সাধক চুপ করে থাকেন। নবাব টের পেলে সাধকের সান্নিধ্যে মনে বিষন্নতা কেটে যেতে শুরু করেছে। তিনি ছোট্ট করে শ্বাস টানলেন। তারপর বললেন, আপনি কিন্তু চমৎকার গান করেন। সাধক চুপ করে থাকেন।

গান কি আপনারই লেখা? আজ্ঞে হ্যাঁ। বেশ। তা সাধারনত কি বিষয় নিয়ে লেখেন আপনি? আমার গানের বিষয়াদি হৈল গিয়ে মা। মা? হ্যাঁ, মা। হুম।

নবাব কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলেন। চকিতে তার মায়ের মুখটি ভেসে উঠল। মায়ের প্রতি সিরাজের অত্যন্ত ভক্তি। তার কারণ আছে। নবাবের মা আমিনা বেগম অত্যন্ত ধর্মনিষ্ঠ ও স্নেহপ্রবণ।

হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ করেন না। আমিনা বেগমের একজন পরিচারিকা ছিল, মেয়েটি হিন্দু। সেই মেয়েটিকে আমিনা বেগম আপন কন্যার মতো স্নেহ করতেন, ডাকতেন রাজকুনোয়ার বলে । নবাবের প্রথম বিবাহ হয়েছিল ইরিজ খান নামে একজন অভিজাত ব্যক্তির কন্যার সঙ্গে, সেই মেয়ের নাম উমদাতুন্নিসা, অবশ্য তাকে সবাই বহু বেগম বলে ডাকে। উমদাতুন্নিসার কোনও সন্তানাদি হয়নি, তাছাড়া বহু বেগম আনন্দ-বিলাসে মগ্ন থাকে, নবাবের তেমন খোঁজখবর নেয় না ...এসব কথা আমিনা বেগম জানতেন ...তিনি কৌশলে পুত্রের সেবায় রাজকুনোয়ার কে নিয়োজিত করেন।

মেয়েটির ব্যবহার অত্যন্ত মধুর, দেখতে রূপসী তো বটেই, যে কারণে নবাব মুগ্ধ হয়েছিলেন। নবাব রাজকুনোয়ার কে বিবাহ করতে চায়, আমিনা বেগম হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ করতেন না, তিনি এ বিবাহে সম্মত হন, নবাব রাজকুনোয়ার কে বিয়ে করেন, ভালোবেসে রাজকুনোয়ার-এর নাম রাখেন লুৎফুন্নেসা বেগম। লুৎফুন্নেসা বেগমের গর্ভে একটি মেয়ে হয়েছে, ফুটফুটে মেয়েটির নাম জোহরা। নবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এরা সবাই মায়ের জাত ...রামপ্রসাদ মায়ের ভজনা করবে না তো কি ... নবাব বললেন, একখানা গান শোনাবেন কি? আমি ...আমি জোর করব না।

যদি আপনার ইচ্ছে হয় তো ...। সাধক একতারা টেনে নিয়ে তারে একবার টং শব্দ করলেন। সেই অলীক তরঙ্গের স্পন্দনে নবাবী বজরার প্রকোষ্ঠের পারশিক আবহে বাংলা তার শ্যামলসবুজ ভাব সম্পদ নিয়ে উঠে আসে। সাধক তারপর গান ধরেন- মন রে কৃষিকাজ জান না এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। নবাব বুদ হয়ে গান শুনছেন।

লোকজ বাংলায় তত অভ্যস্থ নন নবাব, তবে সুরটাই টানল বেশি। সাধকের সুরে কি যেন আছে, ব্যাখ্যা করা যায় না, কেমন বর্ষা মরশুমের নদীর বিস্তারের মতো ... সাধক চোখ বুজে গাইছে- কালীর নামে দাওরে বেড়া ফসলে তছরুপ হবে না সে যে মুক্তকেশী শক্ত বেড়া তার কাছে তো যম ঘেঁষে না ... তছরুপ শব্দটা যেন নবাব চিনতে পারলেন। তিনি চমৎকৃত হলেন। দেবী কালীর কথাও তিনি জানেন-সাধকের মা তাহলে কালী? বেশ বেশ ...নবাব শিহরণ বোধ করেন ...বাংলা-বিদ্বেষী শকুনেরা তাঁকে ঘিরে ধরেছে ...কালীর বিধ্বংসী রূপের কথা তিনি জানেন। হঠাৎ নবাবের মনে হল রামপ্রসাদ মায়াপুরে শ্রীচৈতন্যের আখড়ায় সংগীত উৎসব যোগ দিয়েছিল।

শ্রীচৈতন্যের অনুসারীরা তো বৈষ্ণব। আর ইনি কালীসাধক। হুমম। রামপ্রসাদকে সব রকম ভেদাভেদের উর্ধে প্রকৃত সাধক বলেই মনে হচ্ছে। সাধক গেয়ে চলেছেন।

গুরুদত্ত বীজ রোপন করে ভক্তি বারি সেচে দে না। একা যদি না-পারিস মন রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না ... মন রে কৃষিকাজ জান না এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। গান শেষ হলে নবাব গম্ভীর কন্ঠে বললেন, সাধক? বলুন হুজুর। এত ভালো ফারসি আপনি শিখলেন কোথায়? শিখেছি আমার বাবার ইচ্ছেয়। আপনার বাবা? হ্যাঁ।

আমার বাবার নাম রামরাম সেন। তিনি ভেষজ দ্রব্যাদির ব্যবসা করতেন। ওহ্, তারপর? তারপর আর কি। বাবার মৃত্যু হলি পর সংসারে অভাব অনটন দেখা দিল, বুঝলেন। তখন আমার নবীন বয়স।

কি করি, কি করি, মহা চিন্তেয় পড়ি গেলাম । কাজের খোঁজে রওনা হয়ি পৌঁছলাম কইলকাতা। সেখানে জমিদার কৈলাস সেনমজুদারের সেরেস্তায় মহুরির কাজ জুটল। তিনি কিন্তু আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন হৌজুর। নবাব মাথা নেড়ে বললেন, জানি।

কলকাতায় আমার যে ক’জন শুভাকাঙ্খী রয়েছেন মহেশতলার জমিদার কৈলাস সেনমজুদার তাদের একজন। যাক। এবার আপনার কথা বলুন শুনি। সেরেস্তায় মহুরির কাজ জুটল বটে তবে কাজে আমার মন বসে না, খালি মায়ের গায়ের ঘ্রান পাই, বুঝলেন হুজুর, খালি মায়ের গায়ের ঘ্রান পাই ...হিসাবের খাতায় মায়ের মুখ ফুটে ওঠে ... হিসাবের খাতায় মায়ের কথা লিখি। তা দেইখে একদিন কৈলাস সেনমজুমদার আমায় কলেন ... তোমার আর সেরেস্তায় মহুরির কাজ করতে হবে না রামপ্রসাদ।

শুনে আমি আর্তনাদ করে উঠলাম। জমিনদাররে কলাম তা হলে আমি ...এখন কি আমি পথে বসপ? এখন আমি খাব কি! মা কি সর্গে থেইকে আহার ঢেকে দিবে? তখন জমিদার বাবু হেসে কলেন, শুন হে রামপ্রসাদ, তোমায় আমি মাসিক তিরিশ টাকা মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি তোমার গ্রামের বাড়ি ফিরে যাও, সংগীতের সাধনা কর। তখন আমার কুড়ি বছর বয়স। কুমারহট্ট ফিরে এলাম।

মাসোহারার টাকায় বেশ চলে যায়। ইদিকে নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় আমার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে শ’বিঘে নিস্কর জমি দান করলেন। নবাব জিজ্ঞেস করলেন, শুনেছি আপনি নবদ্বীপের দোদন্ড প্রভাবশালী রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের একটি প্রস্তাব উপেক্ষা করেছেন? সাধক চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, গানের ধাতই হল নির্জনের দিকে ঝোঁকা হৌজুর । গায়েনের সভাসমিতি করে কী লাভ কন।

রাজসভায় যোগ দিলে কিছু লোক আমার পক্ষে থাকবে কিছু লোক আবার ষড় করবে -এই তো। এই করে করে মিছে কাজে দিন যাবে, তাতে কী লাভ হৌজুর । এখন এসব এড়িয়ে মুক্তপক্ষ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এই জীবনই ভালো। মা আমায় যতই সংগীতের প্রতিভা দিক, প্রত্যহ ভোরবেলা নদীপাড়ে বসে কন্ঠের সাধনা করি। এই আমার কাজ।

নবাব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, সাধক। বলুন। আপনি যে গানটি গাইলেন ...দয়া করে সেটি ফারসি ভাষায় তর্জমা করবেন? বেশ। করছি।

বলে সাধক বিখ্যাত বাংলা গানটি ফারসি ভাষায় তর্জমা করতে শুরু করেন। মন রে কৃষিকাজ জান না এমন মানব জনম রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা। গানের কথা শুনে বাইশ বছর বয়েসি নবাব কাঁদছেন। কেননা, নবাব আলীবর্দী নামে একজন ভালো মানুষের রক্ত নবাবের শরীরে বইছে- যে কারণে সাধকের গানের কথার মানে নবাব ঠিকই বুঝতে পারছেন। নবাব আবেগ মেশানো কন্ঠে বললেন, সাধক? বলুন।

আপনি ... আপনি কি আমার ভবিতব্য জানেন সাধক? সাধক চুপ করে রইলেন। তরুণ নবাব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গবাক্ষ পথে বাইরে তাকালেন। আশ্বিনের আকাশে রোদ ঝলমল করছে । একটি গাঙচিল ভয়ানক বাতাসের তোড়ে ডানা স্থির রাখার প্রাণপন চেস্টা করছে।

নবাব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর আপন মনে বললেন, সাধক, সব কিছু ভাবলে ভীষণ আশ্চর্য লাগে আমার। এই জন্ম-জীবন-মৃত্যু, এই তাশের ঘর, অসার সংসার,ভালোবাসা-প্রেম-রক্তপাত আর ষড়যন্ত্র ...জীবন কেবল গন্ধেবর্ণই সার্থক ও সত্য বলে মনে হয় আমার, যেমন আপনার গান, আপনার গান সত্য, সত্য ও সুন্দর ...কিন্তু এ গান জীবনের অন্ধকার নোংরা দিকটা কি ঢেকে রাখতে পারে ...কিংবা গোলাপ ফুলের গন্ধ ... সাধক চুপ করে রইলেন। হঠাৎই নবাবের মনে পড়ল লুৎফুন্নেসা গোলাপ ফুলের গন্ধ ভারি ভালোবাসে। সুখে -দুঃখে লুৎফুন্নেসাই পাশে থাকে।

মানুষ হিসেবে লুৎফুন্নেসা একেবারেই অন্যরকম। নবাবের প্রথমা স্ত্রী বহু বেগম আনন্দ-বিলাসে মগ্ন থাকে ...এ যাত্রায় লুৎফুন্নেসা সঙ্গী হয়নি, নইলে এই সাধকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেত। সাধক কি মুর্শিদাবাদের প্রাসাদে যাবেন। মুর্শিদাবাদের প্রাসাদে নেওয়া ঠিক হবে কি ...যখন চতুর্দিকে এত ষড়যন্ত্রের জাল ... নবাব কি জানেন ...আর ২ বছর পর পলাশীর বিপর্যয়ের পর নবাব একাকী পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন। লুৎফুন্নেসা তাঁকে সঙ্গে নেয়ার আকুল আবেদন করবেন।

১৭৫৭ সনের ২৪ জুন। রাত। একমাত্র কন্যা জোহরা, লুৎফুন্নেসা এবং একজন অনুগত খোজসহ মুর্শিদাবাদ শহর ত্যাগ করবেন। ধরা পড়ে যেতে দেরি হয়নি। সপরিবারে নবাবকে মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনা হবে।

মীরজাফরের জামাতা মীরকাসিম লুকানো সোনা-দানার সন্ধান চেয়ে লুৎফুন্নেসা ওপর অত্যাচার করবে। মীরজাফর নবাবকে হত্যার আদেশ দেবে ... নবাব বললেন, আমি আল্লাহতালার ইচ্ছের কাছে নিজেকে সমর্পন করেছি সাধক। সেই ভালো। সাধক বললেন। বলে শ্বাস টানলেন।

ততক্ষণে অস্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সেই স্নিগ্ধ সকালের ঝলমলে রোদের ভিতর গঙ্গার জলের ওপর দিয়ে উত্তরমূখি ভেসে চলেছে বজরা নৌকা ... তথ্যসূত্র: বাংলাপিডিয়ায় রামপ্রসাদ সেন সংক্রান্ত একটি নিবন্ধে খান মোঃ সাঈদ লিখেছেন, “কথিত হয় যে, কোনও এক সময় মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীর পাড়ে রামপ্রসাদের গান মুগ্ধ হন এবং তাঁকে নৌকায় এনে আরও গান শোনেন। ” ... ...এ গল্পের সূত্র এটুকুই। ...ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাবী আমলের বাংলার ইতিহাস পড়াতেন অধ্যাপক কে এম মসসিন। তিনি একবার ক্লাসে আমাদের লুৎফুন্নেসার ছবি দেখিয়েছিলেন । ফুটফুটে ...কী অদ্ভূত সুন্দর ...ফুলের মতো একটি মেয়ে রাজক্ষমতার জন্য ষড়যন্ত্রের বলি হয়েছিলেন ভেবে কী রকম কষ্ট পেয়েছিলাম ...আজও মনে পড়ে ...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.