আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিইসি কার্নিভালের মিলনমেলায়

সাধারণ মানুষ যার জানার কিছু ইচ্ছা আছে।

সিইসি কার্নিভালের মিলনমেলায় আমিনুল ইসলামবাংলাদেশকে এখন প্রযুক্তিবান্ধব দেশ বলা না গেলেও প্রযুক্তিপ্রেমী দেশ বলা যায় নিঃসন্দেহে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রযুক্তি নিয়ে আয়োজন সারা বছরই চলছে। এসব আয়োজনে দর্শনার্থীদের ভিড়ও বাড়ছে প্রতিনিয়ত। এ সপ্তাহে শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত 'মাইক্রোসফ্ট সিইসি কার্নিভাল' ছাড়িয়ে গেছে অন্যসব আয়োজনকে।

এখানে একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫টি দলের অংশগ্রহণে জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, শিক্ষার্থীদের তৈরি সফ্টওয়্যার প্রদর্শনী, ওয়ার্ল্ড সাইবার গেইমের আঞ্চলিক পর্ব আর তিন দিনের জমজমাট ল্যাপটপ মেলা। জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা সিইসি কার্নিভালের প্রধান আকর্ষণ ছিল জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা (এনসিপিসি)। এ প্রতিযোগিতা উপলক্ষে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহণকারী-সমর্থক মিলে আট শতাধিক শিক্ষার্থী একত্র হয়েছিলেন শাবির সবুজ ক্যাম্পাসে। প্রতিযোগিতার আগের দিন অনুষ্ঠিত মক টেস্টে অংশ নিতে একদিন আগেই চলে এসেছিলেন চুয়েটের রাকিব, তানভীর, তুলি ও হ্যাপি। তাঁরা জানান, খুব ভালো লাগছে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পেরে।

শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য তাঁদের ভালো লেগেছে। প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা দলের সদস্য মো. আব্দুল কাদিরকে সংক্ষেপে সবাই ডাকেন ম্যাক বলে। নিজের ক্যাম্পাসের মতোই সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। হুইল চেয়ারে করে প্রতিযোগিতায় এসেছেন শিপলু হাওলাদার। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধিত্ব তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে তাঁদের দল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন প্রোগ্রামিং বিশেষজ্ঞ নিয়ে গঠিত হয়েছিল প্রতিযোগিতার বিচারক প্যানেল। মিনি অডিটোরিয়ামে ছিল প্রতিযোগিতার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। সেখানে স্থাপিত দুটি বড় পর্দায় ল্যাবগুলোর প্রতি নজর রেখেছেন বিচারকরা। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কায়কোবাদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক মুনির হাসান, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক এনামুল মুনীর এবং কানাডার এলটিও আইবল প্রতিনিধি ড. শাহাদাত হোসেন।

ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, 'এবারকার প্রতিযোগীদের অধিকাংশই অনেক ভালো প্রোগ্রামার। তাঁদের প্রস্তুতিও যথেষ্ট ভালো। অধিকাংশ দলই ভালো ফল করেছে। এ রকম প্রস্তুতি থাকলে আন্তর্জাতিক পর্বে খুব ভালো ফল করা সম্ভব। ' উৎসবের আহ্বায়ক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল জানান, এবারকার প্রতিযোগিতা বেশ ভালো হয়েছে।

অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই ভালো প্রোগ্রামার। তাদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যতে বড় প্রোগ্রামার বের হয়ে আসবে। সফ্টওয়্যার প্রদর্শনী তরুণ সফটওয়্যারবিজ্ঞানীরা কার্নিভালের তিন দিন প্রদর্শন করেছেন তাঁদের তৈরি নতুন সফ্টওয়্যার। শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসই বিভাগের ছাত্র মহিউদ্দিন মিশু, শিবি্বর, ফয়সাল আর আলমগীর প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের দেখাচ্ছিলেন তাঁদের তৈরি সফ্টওয়্যার দিয়ে জিওগ্রাফিক্যাল শেয়ারিং নেটওয়ার্ককে কিভাবে ভার্চুয়ালি রিয়্যলিটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিশু জানান, সফ্টওয়্যারটি তৈরিতে তাঁদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সিএসই বিভাগের প্রভাষক রুহুল আমিন সজীব।

ক্যাম্পাস রেডিও সম্পর্কে আগতদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন পার্থ সারথী কর। বেশি ভিড় দেখা গেছে রুবী পালের 'মঙ্গলদ্বীপ' নামে সফ্টওয়্যার সম্পর্কে জানতে, যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কম্পিউটার ব্যবহারে সহায়তা করবে। নতুন সফ্টওয়্যারগুলো সম্পর্কে জানতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্ররা। ল্যাপটপ মেলা উৎসবের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত চলে ল্যাপটপ মেলা। এতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ প্রদর্শিত হয়।

মেলার সমন্বয়ক রাশেদ আজাদ চৌধুরী বলেন, 'মেলায় বিক্রি ভালোই হয়েছে বলা যায়। মোট ৮৫টি ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে। ' ইউনিক কম্পিউটারের মো. আক্তারুজ্জমান মিয়া বলেন, 'প্রচুর দর্শক হয়েছে, কিন্তু সেই অনুযায়ী বিক্রি হয়নি। বেশির ভাগ মানুষই ল্যাপটপ সম্পর্কে ধারণা নিতে এসেছে। অনেকে বুকিং দিয়ে গেছে।

' গ্লোবাল ব্র্যান্ডের ডেপুটি ম্যানেজার এ বি এম গোলাম কিবরিয়া বলেন, 'আমরা এখানে আসুস ব্র্যান্ডের প্রচারণা চালাতে এসেছি। বিক্রি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। ' ইন্টেলের স্টলে কোনো পণ্যই বিক্রি হয়নি। ইন্টেলের প্রতিনিধি কৌশিক বোস জানান, 'ইন্টেল পণ্য সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে; কোনো পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে না। ' এই স্টলে দর্শকদের জন্য ছিল বড় পর্দায় গেইম খেলার সুযোগ।

তাই এখানে বাচ্চাদের ভিড় লেগেই থাকত। কার আগে কে খেলবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা। এখানে রেসিং কার গেমস খেলছিল শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র কামরুজ্জামান তুষার, আর খেলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল তারই সহপাঠী আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের। গেইমস খেলছে কি না জানতে চাওয়া হলে মজা করে তার বন্ধুকে উদ্দেশ করে বলে_'এই বেটা তিন-চারবার খেলেছে, তার পরও ওঠে না। খেলতে খেলতেই তুষার জানায়, আর মাত্র একবার খেলব।

' শাবির নেপালি ছাত্র সুরেশ নর্থ-ইস্ট মেডিক্যালে পড়ুয়া তাঁর স্বদেশি সাজন ও বিবেককে নিয়ে এসেছিলেন মেলায়। অনেকে সপরিবারে মেলায় আসেন ছুটির দিনটি কাটানোর জন্য। ওয়ার্ল্ড সাইবার গেমস ওয়ার্ল্ড সাইবার গেইমে নকআউট পদ্বতিতে তিনটি গেইমসের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেমন অংশ নিয়েছিলেন, তেমনি স্কুলশিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে। প্রথম দিনের ফিফা-১০ গেইমসে অংশ নিয়েছিল ১০৫ জন।

৬ মিনিটের নকআউট ভিত্তিতে খেলা হয়। এভাবে প্রথম রাউন্ড উত্তীর্ণরা খেলার সুযোগ পায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। এনএফএস মোস্ট ওয়ান্টেড গেইমসে অংশ নিয়েছিল ব্লু-বার্ড স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র মোবাশ্বের হোসেন। খেলতে এসেছিল তার ফুফু শাবির পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্রী সালমা আক্তারের সঙ্গে। প্রথম পর্বেই বাদ পড়েছে।

রুম থেকে বের হয়েছে বিমর্ষভাবে। তার ফুফু জানান, 'ওর আশা ছিল জয়ী হয়ে বিদেশে গেইম খেলতে যাবে। কিন্তু প্রথমেই বাদ পড়েছে, তাই মন খারাপ। ' একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র জাকারিয়া এনএফএস খেলায় অংশ নিয়ে প্রথম রাউন্ড উত্তীর্ণ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন দ্বিতীয় রাউন্ড খেলার জন্য। জাকারিয়ার পুরো পরিবার চলে এসেছিল তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য।

বাবা ইকবাল হোসেন চৌধুরী জানান, ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে, এতে তার মন বড় হবে। গেইম খেলার প্রয়োজনীয় সুযোগ করে দিয়েছি; কিন্তু প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি খেলতে দেই না। ক্লান্তির মাঝেও তৃপ্তি তিন দিনের এই উৎসবের আয়োজন করতে গিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল অনেক আগে থেকে। অনুষ্ঠানের আর্থিক সংস্থান, ব্যবস্থাপনা, প্রচার_প্রতিটি বিষয় নিয়ে কাজ করেছে একেকটি কমিটি। ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দেওয়াসহ প্রতিটি বিষয়ে নিয়মিত তদারক করেছেন কম্পিউটারবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকরা।

ড. জাফর ইকবালের নেতৃত্বে ড. সেলিম রেজা, ফরহাদ রাবি্ব, রুহুল আমীন সজীব, আবু আউয়াল মোহাম্মদ শোয়েব উৎসব সফল করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সিএসই বিভাগের শিক্ষক না হয়েও উৎসবের সঙ্গে পুরোটা সময় ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। ফারসিম, রাশেদ, তৌসিফ, অভিজিৎ, ইমরান ও মাহফুজসহ বিভাগের অনেক ছাত্র ভুলে গিয়েছিলেন তাঁদের ঘর-বাড়ির কথা। কারণ, কাজের প্রয়োজনে ছুটতে হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। শেষ দিন গেইমিং ল্যাবে গিয়ে দেখা যায়, হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছেন প্রদীপ সরকার ও রেদওয়ান।

তিন দিনের খাটুনিতে ক্লান্ত তাঁরা। ক্লান্ত প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার ল্যাবে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে থাকা দ্বিতীয় বর্ষের কাইউম, সুজন, রাবি্ব, মোজাম্মেল এবং রওশনও। এত ক্লান্তির মধ্যেও সবার ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি। মুখে প্রশস্তির ছায়া। কারণ, সফলভাবেই শেষ হয়েছে এত বড় একটা আয়োজন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।