আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নববর্ষ-বিলাপ

বসে আছি পথ চেয়ে....

দেখতে দেখতে আরো একটি বছর পার হয়ে গেলো। মহাকালের নিয়মে আবার এলো বাংলা নববর্ষ-১৪১৭। এই নতুন বছরের আগমন আর পুরনো বছরের বিদায় অত্যন্ত স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং অনিবার্য। পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরী যদি নিবিড় আলিঙ্গনে পুরনো বছরকে ধরে রাখতে চায়, তবু তারা সফল হবে না। আবার দুনিয়ার সব মারণাস্ত্র তাক করলেও নতুন বছরের আগমনকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না।

নতুন বছরটা অনেকটা জঙ্গি সন্ত্রাসীদের মতো নাছোড়বান্দা। আইনকানুন, নীতি, গণতন্ত্র, সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেদিক থেকে বিচার করলে নতুন বছরের আগমন আর পুরনো বছরের চলে যাওয়ার মধ্যে তেমন কোনো নতুনত্ব নেই। তাৎপর্যও বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যারা এ বছর ‘ভর্তা’ হয়েছে, আসছে বছর তারা বড়জোর ‘ভাজি’ হবে।

গড়ম কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা। এর চেয়ে বেশি কিছু ঘটবে বলে মনে হয় না। তারপরও কিন্তু পুরনো বছরের শেষে একশ্রেণীর মানুষ অকারণেই হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেন। কী পেলাম আর কী পেলাম নাÑ এ নিয়ে ফালতু সময় ব্যয় করেন। ঘোড়ার আণ্ডা ছাড়া কোনো কিছু না পেলেও নতুন বছরে অনেকেই নতুন প্রত্যাশা নিয়ে শুরু করতে চান।

গেলো বছর মূল্যবৃদ্ধির যে ষাঁড়টা সবাইকে দাবড়েছে, আসছে বছর সে যেন শান্ত-শিষ্ট-ভদ্র হরিণে পরিণত হয়Ñ এমন প্রত্যাশাও করেন অনেকে। অনেকে আবার বিগত দিনের ব্যর্থতা-হাহাকার-বঞ্চনার ক্ষতে আগামী দিনের স্বপ্ন-সুখের মলম লাগিয়ে শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে পেতে চান। আমাদের নেতানেত্রী ও বুদ্ধিজীবীরা দেশবাসীকে যা জোটেনি, যা হারিয়ে গেছে, সে সব ফিরে পেতে আবার নতুন সংকল্পে বুক বাঁধার উপদেশ দেন। যদিও তা কোনো কাজে লাগে না। আর লাগবেই বা কেন? এ যুগে কে শোনে কার কথা? এ যুগে সবাই সবাইকে শিক্ষা দিতে চায়; উচিত শিক্ষা।

শিক্ষা নেয়ার মতো মানসিকতা ও যথেষ্ট সময় কার আছে ? তাছাড়া পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে বাঙালির লক্ষ্মীর আসনে ঋণখেলাপি-দালাল-ফড়েদের গিন্নিরা বসে আছেন। সরস্বতী দুর্নীতিবাজ-নকলবাজ-ঘুষখোর উচ্ছৃঙ্খলে পরিণত। কার্তিকেরা মাতাল লম্পট হয়ে গাড়ি করে ঘুরে বেড়ান। দূর্গা চারদিকে শত্র“ পরিবেষ্টিত হয়ে কর্তব্য পালনে দৃঢ় না হয়ে, ছলনা আর চাতুর্যকে পুঁজি করে দিব্যি দেশ শাসনের কাজ চালিয়ে যান। প্রতিপক্ষ অসুর বধে তিনি অসমর্থ।

আর দলের ভেতরের অসুরদের শায়েস্তা করতে অনীহ। সোনার বাংলায় আজ গণেশ উল্টে গেছেন। তাকে সোজা করার কোন উদ্যোগ নেই। মহিষাসুরের নিয়ন্ত্রণে গোটা বাজার তথা কালো বাজার। এই হচ্ছে মোটামুটি বাংলার হাল।

এমন খাপছাড়া ‘গড’হীন ‘গডফাদার’দের দেশে নতুন বছর তেমন কোনো তাৎপর্য বহন করে না। সেই একই বুলি একই গালি একই চরিত্রদোষ, তারিখটা শুধু বদলে যাচ্ছে। নতুন বছরে নতুন সন-তারিখ, বাকি সবকিছুই পুরানো। নতুন বছরে আমাদের নতুন প্রত্যাশা নেই, অঙ্গীকার নেই, নেই কোনো সংকল্প। দুর্বল যে পরাজিত যে সেও ‘দেখে নেব’ বলে তার সংকল্প ঘোষণা করে।

সংকল্প যখন দূর-দিগন্তে ডানা মেলে দেয় তখন হয় কল্পনা; অর্থাৎ শেলির স্কাইলার্ক, রবীন্দ্রনাথের বলাকাÑ হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনো খানে। কল্পনার বলাকা যখন ডানা গুটিয়ে মাটিতে নামে তখন হয় সংকল্প। আর এ সংকল্পও যখন অসুস্থ হয়ে ঝিমোয় তখন তাকে বলা হয় হতাশা। স্বপ্ন, কল্পনা, সংকল্প হারিয়ে আমরা হতাশার চোরাবালিতে আটকা পড়েছি। শত শত মৃত সংকল্প আর হতাশার মহাশ্মশানে আজ নতুন বছর আর আমাদের জন্য কোনো নতুন আশ্বাস বহন করে না।

বরং মূল্যবৃদ্ধি, অস্থিরতা, রাজনৈতিক বিদ্বেষ, বিদ্যুৎ সংকট, পানি সংকট, অর্থনৈতিক মন্দা সব মিলিয়ে ভয়াল-ভৌতিক আশঙ্কার বার্তাই বহন করছে। বর্তমানে সবকিছু থেকেও যেন আমাদের কিছু নেই। প্রত্যেক নতুন বছরে যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশার মিনার গড়ে তুলি, বছর শেষে দেখা যায় তা অনন্ত জিজ্ঞাসার চিহ্ন হয়ে আমাদের উপহাস করছে। নববর্ষ আসে নববর্ষ যায়, কিন্তু আমাদের জীবনে নেমে আসা অনিশ্চয়তার অন্ধকার যায় না। গত দুই যুগ ধরে আমরা যে নেতানেত্রীদের ভাষণ-শাসন-ত্রাসন দেখছি, নতুন বছরেও তারাই আমাদের সহযাত্রী।

আমাদের রাজনীতি পালটায় না, অর্থনীতি বদলায় না, পরিবর্তন হয় না ভাগ্যের। অভাব-অনটন-মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা দুর্যোগ সারাক্ষণ আমাদের তাড়া করে ফিরছে। শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গনÑ কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। বিভেদ, হিংসা, বিদ্বেষ আমাদের রাজনীতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলেছে। উচ্ছন্নের উপত্যকায় পৌঁছানোই যেন আমাদের লক্ষ্য।

আর সেই গন্তব্যে পৌছে দিতে সরকারি দল ও বিরোধী দল পরম আন্তরিকতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সংকীর্ণতা, দুষ্টবুদ্ধি, কূটচাল, আর খেয়োখেয়িতে কেউ কারো চেয়ে কম নয়। একেবারে সমানে সমান। বঞ্চনা আর লাঞ্ছনাকেই জীবনের একমাত্র যৌতুক মনে করে আমরাও সব কিছু মেনে নিয়েছি। গত বছরের শুঁটকিকেই এ বছরের তাজা মাছ মনে করে আবার আমরা স্বপ্ন দেখব।

অতীতের ধারাবাহিকতায় একই রকম ঘটনা ঘটতে থাকবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমন, হত্যা, সন্ত্রাস, লুটপাট, চাঁদাবাজি, দাপট, দখলসহ নানারকম অপতৎপরতার মধ্যে দিয়ে বছরটি শুরু করেছে। এর মাত্রা দিন দিন বাড়বে বলেই আশা করা যায়। এর পর হয়তো হরতাল আসবে। আসবে মারামারি, খুনোখুনি।

সন্ত্রাস, নৈরাজ্য। তারপরও নতুন বছর আসে। অভ্যাসবশে অনেকে এ নিয়ে মতোয়ারাও হয়। উঠতি মধ্যবিত্ত আর স্বপ্ন-প্রত্যাশা-সংকল্পহীন উচ্ছ্বাস ও পশ্চিমা হাওয়ায় সিক্ত শিক্ষিত যুবসমাজ নতুন বছরে উদ্দেশ্যহীন অনির্দিষ্টে ঝাঁপ দিতে চায়। তমসা এবং তামাশাঘেরা সমাজের সঙেরা ক্যালেন্ডারে, কার্ডে, ফোনে, দেখা-সাক্ষাতে দাঁত কেলিয়ে ‘শুভ নববর্ষ’ জানায়।

কিন্তু এ ‘শুভ’ কিসের শুভ, কার জন্য শুভ, কিভাবে শুভ তা কেউ জানে না। জানতে চায়ও না। শুভ নববর্ষ কার জন্য? চারদিকে শত্র“ পরিবেষ্টিত, বিশ্বাস, আস্থা আর নিরাপত্তার সংকট ও দলীয় সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত দিকভ্রান্ত শেখ হাসিনার জন্য? রাজনৈতিক সংকীর্ণতা আর উদ্দেশ্যহীনতার ঘূর্ণাবর্তে আচ্ছন্ন খালেদা জিয়ার জন্য? এদেশের চিরবঞ্চিত হত দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য? স্বার্থান্ধ ফাটকাবাজ, নানা ফিকিরে বড়লোক হওয়া আশ্চর্য মানুষগুলোর জন্য? নাকি অন্য কারো জন্য? কাকে আমরা ‘শুভ নববর্ষ’ জানাব? তাতে কী আমাদের টানাটানি কমবে? অর্থনৈতিক সংকট দূর হবে? বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হবে? বেকারত্ব ঘুচবে? মানুষের অভাব কমবে? হানাহানি মারামারি-শেষ হবে? সংকীর্ণতা দলবাজি ভুলে নেতানেত্রীরা উদার ও মহৎ হবে? আমরা শান্তি পাব? তা যদি না হয়, তো কীসের শুভ নববর্ষ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।