আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্জার নিধন কাব্য: ‘বাসর রাতে বিড়াল মারা’র পেছনের কথা (প্রবচনটির উৎপত্তি কাহিনী)

গণতন্ত্র হল এমন এক অস্তিত্বহীন মদ, যাতে সবাই মাতাল, কিন্তু কেউ কখনো পান করে নি।

বিড়াল আমার প্রিয় একটি প্রানী। এর আদুরে চেহারা আর হাস্যকর কাজের জন্য বরাবরই আমার প্রিয়। আর আমার বইগুলো ইদুরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিড়ালের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এই বিড়ালদের কেন মারতে হবে।

তাও আবার বাসর রাতে, সংসার যে একটা যুদ্ধক্ষেত্র তা বোঝাতে প্রথমেই রিংয়ের বাইরের লোককে খুন করে বুঝিয়ে দেয়ার প্রচেষ্ট নাকি? বহুকাল আগে থেকে আমাদের সমাজে চলে আসছে একটি কথা ‘বাসর রাতে বিড়াল মারা’। এ নিয়ে টিভিতে নাটকও হয়েছে। এই কথাটা এমন প্রসঙ্গে এমন সুরে বলা হয়ে থাকে তাতে বেশ একটা রসালো ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যার কারনে এ নিয়ে ভুল ধারণা করা অস্বাভাবিক কিছু না। এই কথাটার উৎপত্তি কোথায় এর প্রকৃত মানেই বা কি এই প্রশ্নের উত্তর ছিল অজানা।

হঠাৎ করে কাল উত্তর পেয়ে গেলাম। এবারের বইমেলা হতে সৈয়দ মুজতবা আলীর এক খণ্ড সমগ্র কিনেছি। সেটাই পড়ছিলাম। কাব্য সাহিত্যে সৈয়দ সাহেবের জ্ঞান প্রবাদতুল্য কিন্তু তিনি কবিতা লিখেছেন বলে শুনি নি, তাকে রসের কারবারী বলা চলে। তাই তার পঞ্চতন্ত্র বইয়ে একটি কবিতা দেখে অবাক হয়েছিলাম।

ইরানে প্রচলিত একটি গল্পের কাব্যরুপ। কবিতাটি তার নিজের লেখা না অনুবাদ করা এ ব্যাপারে কিছু লেখা নেই। সেই কবিতাটি গল্প আকারে বলছি- ইরান দেশেতে ছিল যমজ তরুণী ইয়া রঙ ইয়া ঢঙ, নানা গুনে গুনী। কোথায় লাইলী লাগে কোথায় শিরীন চোখেতে বিজলী খেলে ঠোঁটেঁ বাজে বীণ। ওড়না দুলায়ে যবে দুই বোন যায় কলিজা আছাড় খায় জোড়া রাঙা পায়।

এই সুন্দরীদের এমনই রুপ ফকিরেরাও বেহুশ হয়ে যায়। শুধু রুপই নয় সম্পদও ছিল অঢেল। তাদের বাপ-দাদা’র মৃত্যূতে তারা বিশাল সম্পদের মালিক হলেন। তাই তাদের ভরন পোষণের জন্য বিয়ের প্রয়োজন ছিল না। তাই তারা স্বাধীন জীবন যাপনে আগ্রহী ছিল।

কিন্তু কলঙ্কের ভয়ে তারা বিয়ে করতে রাজি হল। রুপে গুনে তারা অতুলনীয় আর সম্পদ, এমন পাত্রীর জন্য পাত্ররা লাইন লাগাবে তাতে আর সন্দেহ কি! কিন্তু দুই বোন এমন একটা শর্ত জুড়ে দিল, তাদের বিয়ে করতে হলে এই শর্ত মানতে হবে - তখন সে করিল শর্ত সে বড় অদ্ভুত সে শর্ত শুনিলে ডর পায় যমদূত। বলে কিনা প্রতি ভোরে মিঞার গর্দানে পঞ্চাশ পয়জার মারি রাখিবে শাসনে! ফার্শী '‘পয়জার’' মারার কোমল বাংলা হল পাদুকা পরশ, সোজা বাংলায় বললে জুতা মারা। এমন শর্ত কে মানবে বলুন। এতক্ষণ যে সব ‘'ওয়াটার ক্যান্ডিডেট'’ এগিয়ে এসেছিলেন তারা শর্ত শুনে পাগাড় পার।

বহু সময় গড়িয়ে গেল কেউ বিয়ে করতে রাজি হয় না। সেই নগরে বাস করত দুই ভাই, ফিরোজ মতীন। অতি দারিদ্রের সাথে তাদের দিন কাটত, কোন কাজ নেই, চাকরি নেই। অসহায় অবস্থা। একদিন ছোট ভাই বড় ভাই ফিরোজকে বলে ‘এইভাবে না খেয়ে মরার চে’ জুতার বাড়ি খাওয়া ভাল।

‘ ফিরোজ বলল, "আমিও তাই ভাবছি। " শাদীতে আয়েস আছে তবে জুতারো ভয়। তবু পেটের দায়ে তারা দুই ভাই দুই বোনকে বিয়ে করল। দুই দম্পতি দুই মহলে উঠল। চলি গেলা দুই ভাই ভিন্ন হাবেলিতে মগ্ন হইলা মত্ত হইলা রসের কেলিতে।

তিন মাস পর নগরের রাস্তায় দুই ভায়ের আচানক দেখা হল। পরষ্পরকে দেখে দুই ভাই আনন্দে কোলাকুলি করল। ফিরোজ মতিনকে জিজ্ঞাস করল, “তোমার মাথায় টাক নাই কেন ভাই?” অবাক হয়ে মতিন বলল, “টাক কেন বল তাই”? ফিরোজ, “জোরে কি মারে না চটি?” মতিন, “আরে দু্ত্তোর হিম্মত কাহার, আমি কি তেমন বটি?” তারপর মতিন বিস্তারিত বলল। বিয়ের রাতে খাবার আসরে নানান রকম খাবার আসল, আর আসল বীবীর প্রিয় বিড়ালটি। যেই না বিড়াল ‘ম্যাও’ বলেছে মতিন সাথে সাথে খাপ থেকে তলোয়ার খুলে বিড়ালের গলায় এক কোপ।

তাজ্জব বীবী আক্কেল গুড়ুম জবানে র'’টি না কাড়ে। গুসসা কৈরা কই ‘এসব না সই মেজাজ বহুত কড়া বরদাস্ত নাই বিলকুল আমার তবিয়ৎ আগুনে গড়া। তারপর আর কি, কার ঘারে দুইটা মাথা যে জুতা মারবে। ফিরোজতো শুনে মহা খুশি। আজই এই বৌয়ের উপর এই চিকিৎসা প্রয়োগ করবে।

সেই রাতে খাবার সময় সে তার বৌয়ের প্রিয় বিড়ালটির মাথা কেটে ফেলল। এবং সেও মতিনের মত ডায়লগ ঝাড়ল। হায়রে কিসমৎ, ফল ফলিল উলটা। এতদিন যা শরবৎ ছিল তা হয়ে গেল বিষ। স্ত্রী তখুনি ক্ষেপে গিয়ে জুতা মারতে আরম্ভ করল- “মেজাজ চড়েছে তব হয়েছ বজ্জাৎ? শাবুদ করিব তোমা শুনে লও বাৎ।

আজ হৈতে হৈল একশ’ পয়জার”। একি হিতে বিপরীত! এতো দিন যা ছিল পঞ্চাশ তা সেঞ্চুরীতে গিয়ে ঠেকল! মনেহয় রাগে বীবী একটু জোরেই মেরেছিল। পরদিন রক্তাক্ত ফিরোজ মতিনের কাছে গেল। তার দুরবস্থার কথা জানালে মতিন তার যত্ন নিয়ে তাকে বলল, “বিড়াল মেরেছ ঠিকই, সন্দেহ নেই, কিন্তু ভুল তো একটা করেছ। “বিলকুল বরবাদ সব গুর হইল মাটি।

আসলে এলেমে তুমি করোনি খেয়াল শাদীর পয়লা রাতে বধিবে বিড়াল”। " ফার্শীতে বলা হয় '‘গুরবে কুশতান, শব-ই আওওয়ল’', অর্থাৎ পয়লা রাতেই মারবে বিড়াল। এই বেলা তাহলে আসল ঘটনা জানতে পারলাম। যারা শিঘ্রই বিয়ের বাসনা করেছেন তারা এই গল্প হতে শিক্ষা নিয়েন, সাবধান নইলে শরবৎ হয়ে যাবে বিষ! কবিতাটি অবতারণার অর্ন্তনিহিত রহস্য: কথাটার উত্পত্তি বিড়াল মারা থেকে কিন্তু এটা আক্ষরিক অর্থেই বিড়াল মারা নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী যে প্রসঙ্গে কবিতাটির অবতারণা করেছিলেন সেটা বর্ণনা করা উচিত্ ছিল।

ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমরা কালোবাজারীদের নির্মূল করি নি, এই বিড়াল এখন আর মারলে লাভ নেই সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন। কবিতার শেষে আলাদা করে এই লাইনগুলো জুড়ে দিয়েছিলেন- স্বরাজ লাভের সাথে কালোবাজারীরে মারনি এখন তাই হাত হানো শিরে। শাদীর পয়লা রাতে মারিবে বিড়াল না হলে বর্বাদ সব, তাবৎ পয়মাল। আগের পোস্ট- ভার্চুয়াল কবিতা (যদি কবিতা বলা যায়): এই ব্লগ ছেড়ে দুরে বহু দুরে অন্য কোন ওয়েবসাইটে

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।