আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আর একজন মা-ও যেন মারা না যান

গর্ভধারণ কোনো অসুখ নয়। কিন্তু গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবজনিত জটিলতায় প্রতিদিন অনেক মা মারা যাচ্ছেন। এই মায়েরা কেন মারা যাচ্ছেন, প্রতিরোধেরই বা কী উপায়, তা-ও জানা আছে। তাই আর একজন মা-ও যেন মারা না যান, সে বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। দেশব্যাপী সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে।


আজ শনিবার ব্র্যাকের সহায়তায় ‘প্রথম আলো’ আয়োজিত ‘নিরাপদ মাতৃত্ব: আমাদের অঙ্গীকার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা এ কথা বলেন। ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসকে সামনে রেখে এ বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বৈঠকে প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সামিনা চৌধুরী চিকিত্সক হয়েও অনেক মা-কে বাঁচাতে না পারার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি একজন মায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থায় সেই মা-কে হাসপাতালে আনা হয়। মাত্র দেড় কেজি ওজনের নবজাতক রেখে সেই মা মারা যান।

দেড় কেজি ওজনের নবজাতক নানির কোলে চড়ে মায়ের লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরে।
কারওয়ান বাজারে ‘প্রথম আলো’র কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রতিটি পরিবার এবং মা-কে নিরাপদ মাতৃত্ব বিষয়ে সচেতন করতে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানান আলোচকেরা। মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৫ অর্জনে বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। তবে সন্তুষ্টি প্রকাশ করার অবকাশ নেই। কেননা এখনো যেতে হবে বহু দূর—আলোচকেরা এ বিষয়টিও মনে করিয়ে দেন।


গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি স্বাস্থ্যসচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘স্বাধীনতা অর্জনের ৪২ বছর পরও দেশে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি। এখনো বিষয়টি সেভাবে মোকাবিলা করা হয়নি। সিলেটে এখনো বছরে প্রতি লাখে ৪৬২, খুলনায় ৬০ ও ঢাকায় ১৯৬ জন মা মারা যাচ্ছেন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন মা-ও যাতে মারা না যান, সরকার এ ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। তার পরও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।


সচিব আরও বলেন, মাঠে ময়দানে সরকারের স্বাস্থ্যকর্মী আছেন। তার পরও প্রসব-পূর্ব সেবা নেওয়ার হার মাত্র ৫৫ শতাংশ। এ সেবার হার শত ভাগ করার জন্য নজরদারির ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
জনসচেতনতা তৈরিতে ‘প্রথম আলো’ এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন সচিব।
গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ‘প্রথম আলো’র সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, প্রথম আলো অ্যাসিড নিক্ষেপ বন্ধ করা, মাদক না নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করছে।

নিরাপদ মাতৃত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
গোলটেবিল বৈঠকের স্বাগত বক্তব্যে ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিভাগের পরিচালক কাওসার আফসানা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার ঘটানো, লৈঙ্গিক সমতা আনা এবং মুঠোফোনের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সব মায়ের জন্য শ্রদ্ধাশীল ও মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দেন। আলোচনায় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম আমির হোসেন বলেন, শুধু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু হচ্ছে, এটা খুবই দুঃখজনক। বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শত ভাগ প্রসব নিশ্চিত করা এবং যদি তা না করা যায়, তাহলে প্রতিটি প্রসব যাতে দক্ষ ব্যক্তির সহায়তায় হয়, তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে জোর দেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (পিএইচসি) সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ মুসা বলেন, আফ্রিকায় বেশির ভাগ প্রসব হচ্ছে হাসপাতাল ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

কিন্তু সেখানে মা-ও মারা যাচ্ছেন বেশি। তাই হাসপাতালে সেবার গুণগত মান নিশ্চিত না করে শুধু প্রসব করালেই অবস্থার উন্নতি হবে না। তিনি প্রশিক্ষিত জনবলের সংকট নিরসন এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া সেবা কতটুকু মানসম্মত, তার দিকে নজর দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান।
ব্র্যাকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিভাগের সমন্বয়কারী মোরশেদা চৌধুরী বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পাঁচ ঘণ্টা পর ৭২ শতাংশ মায়ের মৃত্যু ঘটেছে।

অর্থাত্ মায়েদের দেরিতে হাসপাতালে আসা এবং আসার পরও সেবা পাওয়ার চিত্র এখনো হতাশাজনক।
অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি লতিফা সামসুদ্দীন বলেন, একটি জেটবিমান বিধ্বস্ত হয়ে মানুষ মারা গেলে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তৈরি হয়। কিন্তু প্রতিদিন সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে যে মা মারা যাচ্ছেন, তা নিয়ে তেমন আলোড়ন হয় না। তিনি মাতৃমৃত্যু প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে উল্লেখ করেন।
এনজেন্ডার হেলথের দেশীয় পরিচালক আবু জামিল ফয়সাল বলেন, বছরে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে সাত হাজার ৩০০ মা মারা যাচ্ছেন।

অন্যদিকে বছরে ৩৬ হাজার ৫০০ মা প্রসবকালীন জটিলতায় ফিস্টুলাসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগছেন। এ ছাড়া নিরাপদ মাতৃত্বের মধ্যে নবজাতকের দিকেও নজর দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) শিশুস্বাস্থ্য প্রধান শামস-এল আরেফিন বলেন, দেশে অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কিন্তু সেসব জায়গায় পর্যাপ্ত জনবল নেই। তাই প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা না বাড়িয়ে সেবার গুণগত মান বাড়াতে হবে। এ ছাড়া বাড়িতে দক্ষ সহায়তাকারীর সহায়তায় প্রসবের সময় জটিলতা দেখা দিলে কোথায় যেতে হবে, সে রেফারাল ব্যবস্থাও শক্তিশালী করতে হবে।


সেভ দ্য চিলড্রেনের পার্টি প্রধান ইশতিয়াক মান্নান দক্ষ প্রসব সহায়তাকারীদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা, যেসব কেন্দ্রে ২৪ ঘণ্টা জরুরি প্রসূতিসেবা দেওয়া হচ্ছে সেসব কেন্দ্রে চিকিত্সক (সার্জন) এবং অ্যানেসথেসিয়াসিস্ট যাতে থাকেন, তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।
প্ল্যান বাংলাদেশের দেশীয় প্রজেক্ট ম্যানেজার সেলিনা আমিন বলেন, এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তদাতা হচ্ছে পুরুষ। তাই এই পুরুষদের নিরাপদ মাতৃত্ব কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিলের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রিয়াদ মাহমুদ প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, সরকারি হাসপাতালে ব্লাড স্ক্রিনিংসহ বিভিন্ন কাজে আড়াই শ টাকা লাগে। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এ টাকা দেওয়া সম্ভব হয় না।

সরকার গর্ভবতী মায়ের জন্য এটি বিনা মূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারে।
জাইকার সেফ মাদারহুড প্রমোশন প্রজেক্টের প্রধান উপদেষ্টা ইউকিই ইউসিমুরা মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সামাজিক আচার আচরণ পরিবর্তনের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ তৈরির সুপারিশ করেন তিনি।
বেসরকারি ল্যাম্ব হাসপাতালের (এমআইএস-রিসার্চ) স্ট্যাসি সাহা বলেন, যেসব মায়ের অস্ত্রোপচার দরকার হচ্ছে তাঁরা তা পাচ্ছেন না, আবার যাঁদের দরকার নেই, তাঁদের অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। কাদের অস্ত্রোপচার লাগবে, এ বিষয়ে চিকিৎসকদের নিয়মকানুন মানা এবং তা নজরদারির বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেন।


কেয়ার বাংলাদেশের প্রোগ্রাম পরিচালক (স্বাস্থ্য) জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, শুধু সরকার নয়, কার দায়িত্বে অবহেলা বা ভুলের জন্য মা মারা গেলেন, সেই ব্যাপারে সবার মধ্যে জবাবদিহি তৈরি করতে হবে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।