আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দোয়েল ও যুদ্ধদিনের উপাখ্যান [তৃতীয় পর্ব]



আমরা শুনতে পাই ওরা সিলেট শহরে ঢুকেছে। আমাদের সৈনিক ও পুলিশেরা প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু ওদের আধুনিক অস্ত্রের কাছে টিকতে পারেনি। আমরা রাতভর গুম গুম,কড় কড়াৎ শব্দ শুনতে পাই। বিছানায় মিশে গিয়ে ভয়ে কাঁপি। আমার চাচাতো ভাই মন্টু, আমাদের মন্টু ভাই তার আরো অনেক বন্ধু সহ যুদ্ধ করবে বলে বেরিয়ে যায়।

আমরা ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে তবু সকাল হলে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখি। দোয়েলদের এসব ঘটনায় সম্ভবতঃ কিছু যায় আসেনা। ওরা যথারীতি খাবার নিয়ে আসে। আমাদের বাগানে বেশ কিছু ফুল ফোটে। ফুলের সুবাসে আমাদের বাড়ি ম ম করে।

সকালের চমৎকার আলোয় নানা রঙের প্রজাপতি ও ফড়িং ওড়ে। পুকুর পারে কিছু বুনো ভাঁট ফুলের গাছ ছিল। এ গুলোও একই সাথে ফোটে। আমরা বিভোর হয়ে যাই। কোথাও কোনো সঙকট আমরা দেখতে পাইনা।

সে দিনও আমরা বাগানের ভেতর ফড়িংয়ের পেছনে ছুটছি। এ সময় আমরা টুং টুং সাইকেলের শব্দ শুনতে পাই। আমরা দেখি ছোট মামা। দ্রুত বেগে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে এসে ঢুকছেন। আমরা ফড়িং ধরা ফেলে রেখে মামাকে ঘিরে ধরি।

মামা হাফাতে হাফাতে বলেন,'পাক সেনারা বিয়ানীবাজার ঢুকেছে। ওরা বেশ কিছু বাড়-ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আজ আমাদের গ্রাম সোপাতলায় আসার কথা,তাই পালিয়ে এসেছি। ' মা বললেন,'তুই পালালি কেন?' -ছেলেদের ট্রেনিং দিলাম যে! মামা ইপিআর অর্থাৎ ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ চাকুরী করতেন। সুবেদার মেজর ছিলেন।

পালিয়ে এসেছেন এবং যুবক ছেলেদের প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দিয়েছেন। মা বললেন,'এখন কি হবে?' -ওরা চলে গেলে বাড়ি ফিরে যাব,তারপর যাব ইন্ডিয়ায়। -ইন্ডিয়ায় যাবি! -এই দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে না? মা আর কিছু বলেন না। মামা হাত মুখ ধুয়ে এসে ভেতরে মায়ের ঘরে শুয়ে পড়েন। বিকেলের দিকে আমাকে ডেকে বললেন,'তুই সাইকেল নিয়ে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আয়।

দেখে আসবি মিলিটারীরা আছে না চলে গেছে। ' মা বললেন,'কি বলিস তুই,ওর যদি কিছু হয়?' -না বুবু ,ও তো ছোট মানুষ,ওকে কিছু বলবে না ওরা। আমি মুখিয়েই ছিলাম। আসল উদ্দেশ্য সাইকেল। আমি সবে সাইকেল চালনা শিখেছি,অতএব আমাকে পায় কে।

আমি সাঁই সাঁই সাইকেল চালিয়ে নির্বিঘ্নে মামা বাড়ি এসে পৌঁছলাম। মামী আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন,'তোর মামা কোথায়? তোদের বাড়ি? ভালো আছে?' আমি মামীর এতোগুলো প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললাম,বললাম,'হ্যাঁ,মামাইতো আমাকে পাঠালেন। ' -তোর মামাকে বলিস এখন যেন না আসে। ওরা ঘোরাঘুরি করছে,বিভিন্ন বাড়িতে আগুন দিচ্ছে। -ঠিক আছে আমি এখন আসি।

মনের আনন্দে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরতে থাকি;কিন্তু কদুগঞ্জের কাছে লোলা নদীর পারে এসে থমকে দাঁড়াই। দেখি অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছেএ পারে,আর ওপারে যে পথে আমি বাড়ি ফিরবো সেই রাস্তায় ও দু'ধারের ঘাসের উপর বসে আছে বেশ কিছু খাকী পোষাকধারী সৈন্য। ওপাশে দাউ দাউ করে জ্বলছে জেলে পল্লীর কয়েকটি বাড়ি। ঐ বাড়িগুলো থেকে কয়েকজন যুবক নাকি মুক্তিযুদ্ধে গেছে। [চলবে]


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।