আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা মহানগরীর অধিকাংশ ভবনই রাজউকের নকশা বহির্ভূত

সত্যের চেয়ে অপ্রিয় আর কিছু নেই

রাজধানীতে রাজউকের নকশা বহির্ভূত বহুতল ভবন, বাড়ি-ঘর ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহতভাবে চলছে। রাজউকের আইন শাখার মতে রাজধানীর ৯৯ ভাগ অনুমোদিত নকশা বহির্ভূত। অপরদিকে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ হয়েছে কিনা পরে তা আর মনিটরিং করা হয় না। ফলে নির্মাণকারী কিংবা ভূমির মালিকরা নকশা বহির্ভূত ইমারত তৈরি করার সুযোগ পাচ্ছে। রাজউকের কোনরকম তদারকি না থাকায় নকশা বহির্ভূত নির্মাণ এখন যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে।

তবে এর পেছনে লেনদেন বাণিজ্য রয়েছে। রাজউকের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী ভূমির মালিক কিংবা নির্মাণকারীদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ পেয়ে থাকে। এটাই নির্মাণ কাজ তদারকি না করার অন্যতম কারণ বলে কয়েকজন কর্মকর্তা জানান। নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণকারী কিংবা ভূমির মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিগগিরই শুরু হচ্ছে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের মোবাইল কোর্ট। ইতিপূর্বে ফায়ার সার্ভিস থেকে ৬৫০টি বহুতল ভবন মালিককে নোটিস দেয়া হয়েছে।

রাজউকের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. নূরুল হুদা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি বাস্তবায়নে রাজউকের দায়িত্ব রয়েছে। নগর উন্নয়ন ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকরণ এবং রাজ-ধানীবাসীকে সুন্দর নগরী উপহার দেয়ার অন্যতম দায়িত্ব রাজউকের। এক্ষেত্রে নকশা বড় বড় ভবন, স্থাপনা ও বাড়ি-ঘর নকশা অনুযায়ী নির্মাণে বাধ্য করার জন্য শিগগিরই মোবাইল কোর্ট চালু হচ্ছে। নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মিত ভবনে অগ্নিকাণ্ড কিংবা কোন দুর্ঘটনা হলে উদ্ধারকারী দল সেখানে পৌঁছাতে পারে না। এসব ভবনের অধিকাংশের আশপাশে নকশা অনুযায়ী খালি জায়গা রাখা হয় না বা রাস্তা থাকে না।

ফলে দুর্ঘটনায় হতাহতের উদ্ধার করাও সম্ভব হয় না। রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত রাজউকের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। মোবাইল কোর্ট চালু করার আগে আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার আইনটি আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।

নকশা বহির্ভূত কিংবা রাজউকের অনুমোদনবিহীন ভবন, স্থাপনা ও বাড়ি ঘর উচ্ছেদের একদিন পর আবার সেই জায়গায় একই ধরনের ভবন নির্মাণ শুরু হয়ে যায়। একই স্থানে রাজউক কয়েক দফা উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও ভূমির মালিকদের নিয়মনীতি মেনে ভবন নির্মাণে বাধ্য করতে পারেনি। রাজউকের আইন শাখা থেকে জানানো হয়, রাজধানীতে শত শত ভবন নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মিত। ঐ সকল ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অগ্নিকাণ্ড কিংবা অন্যান্য দুর্ঘটনায় বহু লোকের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। তারপরও টনক নড়েনি।

ধনী, শিক্ষিত, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই নিয়মনীতি ভঙ্গ করে বেশি। তারা ক্ষমতার দাপটে রাজউকের নকশার তোয়াক্কা করেন না। তারা নিজের খেয়াল খুশি মত ভবন নির্মাণ করে। রাজউক কর্মকর্তারা বলেন, যেভাবে রাজধানীতে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে ভূমিকম্প হলে ঐ সকল ভবন ধসে রাজধানী মৃতপুরীতে পরিণত হবে। রাস্তাঘাট থাকবে না এবং ভবনের পর ভবন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে।

ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে উদ্ধারকারী দল যাতে দ্রুত বিনা বাধায় ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারে, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে সকলকে ভবন নির্মাণ করা উচিত বলে আইন শাখার কর্মকর্তারা জানান। রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট মো. রোকন-উদ-দৌলাহ বলেন, তিনি এই পর্যন্ত ৬৫০টির অধিক অবৈধ ও নকশা বহির্ভূত ভবন উচ্ছেদ করেছেন। রাজউকের আইন, নিয়মনীতি নগর উন্নয়নে অত্যন্ত উপযোগী। তার মতে, নির্মাণকারী কিংবা ভূমির মালিক রাজউকের অনুমোদিত নকশা কিংবা নিয়মনীতি মানতে চায় না। মোহাম্মদপুরে জাপান গার্ডেন সিটির কথা উল্লেখ করে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন পূর্বে সেখানে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

ঐ ভবনে আগুন নিভানোর জন্য প্রতিটি তলায় অগ্নিনির্বাপক গ্যাস সিলিন্ডার রয়েছে। কিন্তু সেগুলো শুধুই সিলিন্ডার। সেগুলোতে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। ঐ ভবনে একই পরিবারের সাতজনের করুণ মৃত্যু ঘটে।

সেখানে রাজউকের নকশা অনুযায়ী রাস্তা ছিল না বলে কর্মকর্তারা জানান। নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণ অব্যাহত থাকায় রাজধানী ইটের বস্তিতে পরিণত হয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত রাজউক ২১ হাজার নকশা অনুমোদন দিয়েছে। রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন) শেখ আব্দুল মান্নান বলেন, এই ২১ হাজার ভবন নির্মিত হলে রাজধানী ঘনবসতিতে পরিণত হবে। নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করতে মোবাইল কোর্ট চালু রাখার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

রাজউকের নকশা অনুমোদন পাওয়ার আগে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র অনুযায়ী ভবন নির্মাণ কাজ হচ্ছে কিনা তাও সাধারণত মনিটর করা হয় না। ৯৯ ভাগ লোক ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র অনুযায়ী নির্মাণ কাজ করে না বলেও জানান তারা। আগুন লাগলে নিরাপদে বের হওয়ার আলাদা সিঁড়ি কিংবা পথ, অভ্যন্তরে আগুন নেভানোর ব্যবস্থা ও বসবাসকারীদের কিভাবে তাৎক্ষনিক আগুন নেভাতে হবে, এই সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। ভবনের আশেপাশে রাস্তা ও পানির ব্যবস্থা রাখার কথাও ছাড়পত্রে উল্লেখ রয়েছে।

ইতিপূর্বে গাজীপুর, সাভার ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এই সব প্রাণহানির জন্য ভবন মালিক কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকই বেশির ভাগ দায়ী। কেউ কেউ ছাড়পত্র অনুযায়ী বিকল্প সিঁড়ি নির্মাণ করলেও অনেক সময় সেগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী হয় অথবা ঘটনার সময় তা ব্যবহার করার সুযোগ থাকে না। অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিপাকে পড়ে যান। প্রায়ই এই ঘটনা ঘটে বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্রে বলা হয়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মো. শহীদুল্লাহ বলেন, এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস থেকে ১৬০০ বহুতল ভবন নির্মাণে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। ছাড়পত্র অনুযায়ী ভবন নির্মাণ কাজ শেষ করার পর ফায়ার সার্ভিসকে জানানোর কথা। কেউ জানায়নি। এ কারণে ৬৫০টি বহুতল ভবন নির্মাণকারী কিংবা ভবন মালিককে নোটিস দেয়া হয়েছে। প্রথম নোটিস দেয়ার পর কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

৬৫০টি বহুতল ভবন মালিকের মধ্যে ইতিমধ্যে ২৯২ জনকে দ্বিতীয় নোটিস দেয়া হয়েছে। এই নোটিস অনুযায়ী মালিকদের পক্ষ কোন উত্তর না পেলে তৃতীয় দফা অর্থাৎ চূড়ান্ত নোটিস দেয়া হবে। এই নোটিসের পর ও মালিক পক্ষ কোন জবাব না দিলে ঐ সকল মালিকদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট চালু করা হবে। তাৎক্ষণিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জেল জরিমানা করা হবে বলে মহাপরিচালক জানান। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে অক্টোবর মাসে রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের আইন সংশোধনের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট সংযোজন করে আইন জারি করে।

আইনটি জাতীয় সংসদে অনুমোদনের পর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুমোদন দেয়া হয়। রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মতে মোবাইল কোর্ট চালু করার বিষয়টি বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। নগরবাসীর জীবন রক্ষায় ভবন মালিক কিংবা নির্মাণকারীরা আইন মেনে চলতে বাধ্য হবে বলে কর্মকর্তারা জানান। এই আইনে মোবাইল কোর্ট ভবন মালিককে তাৎক্ষণিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও দুই বছরের জেল দেয়ার বিধান রয়েছে। সর্বোচ্চ সাত বছরের জেল প্রদানের বিধান রয়েছে।

স্বয়ং রাজউকের মূল ভবনের অনমোদন নেই অনেকে দাবি করেছে। এই ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক (উন্নয়ন) বলেন, রাজউকের এনেক্স ভবনের অনুমোদন রয়েছে। মূল ভবন পাকিস্তানে আমলে নির্মিত হয়েছে। তবে এর অনুমোদন রয়েছে কিনা তা তারা বলতে পারেননি। বর্তমানে রাজউকের সকল ভবন নির্মাণের আগে অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয় বলে চেয়ারম্যান জানান।

ইত্তেফাকে প্রকাশিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।