আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার আশা পুতুল


আমরা যখন নাটোর থেকে ঢাকা চলে আসি আমার বয়স তখন চার। এসে উঠেছিলাম রামপুরায় একটা বাসায়। বাসাটা কেমন ছিল একদমই মনে নেই, তবে এটা মনে আছে বাড়িওয়ালী খুবই কড়া ছিল। জোরে কথা বলা যাবে না, ছাদে গিয়ে খেলা যাবে না, দৌড়ানো যাবে না, তার ঘরে যাওয়া যাবে না---এইরকম একগাদা নিয়ম করে দিয়েছিল। বাড়িওয়ালীর একটা মেয়ে ছিল।

তাকে অবশ্য আমরা দুইবোন অনেক পছন্দ করতাম। সম্ভবত কলেজে পড়তো। ওই আপুটা মাঝে মাঝে আদর করে ডেকে নিয়ে যেতো, গল্প করতো, খেলতে দিতো। ওদের বাসায় একটা বড় পুতুল ছিল। আমার চেয়েও লম্বা।

আমরা তখনও মামণির বানিয়ে দেয়া কাপড়ের পুতুল নিয়েই খেলতাম। তাই ওই পুতুলটার প্রতি আমাদের আগ্রহ একটু বেশিই ছিল। কিন্তু বাড়িওয়ালীর ভয়ে কাছে যেতাম না। একদিন মহিলা আশপাশে ছিল না বলে আমি টুকটুক করে গিয়ে পুতুলটা যেই একটু ধরেছি, অমনি উনি কোত্থেকে এসে হাজির আর রাম চিৎকার, 'এই মেয়ে পুতুল ধর কেন?' আমি ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে আসছি। মামণির খুব লেগেছিল ব্যাপারটা, তার মেয়েকে আরেকজন এভাবে ধমকাবে।

কিভাবে হয়? আব্বুরও মন খারাপ হয়েছিল। তাই ঠিক হল আমার জন্য একটা পুতুল কেনা হবে। ওমা, সত্যি সত্যি বিকালে দেখি আব্বু একটা পুতুল নিয়ে এসেছে। অত বড় না মোটেই, আমি যেন কোলে নিতে পারি ততটুকু। একদম টুকটুকে ফর্সা, গুল্টু গুল্টু গাল, পাতলা লাল ঠোঁট, ঝাকরা ঝাকরা সোনালী রঙের কোকড়া চুল, গোল গোল নীল চোখ, শোয়ালে চোখ বন্ধ করে ফেলে, উঠালে খোলে।

এই পুতুলটা আমার এত এত পছন্দ হয়ে গিয়েছিল! এখন পুতুলের নাম রাখতে হবে। ওইদিন আবার সে'চাচ্চু, বড়মামা সবাই আসছিল বেড়াতে। একেকজন একেকটা নাম বলছিল। মামণি বলল, 'যার পুতুল সেই নাম রাখুক। ' সবাই আমার দিকে তাকাল।

আর আমি বললাম, 'আমার পুতুলের নাম আশা। ' আশা নামটা ওই বয়সে কিভাবে আমার মাথায় আসছিল কে জানে! সবাই খুব অবাক হয়েছিল। কিন্তু আশা পুতুল নামটাই ঠিক হল। আশা পুতুল, আমার মেয়ে। আমি সারাদিন আমার মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।

কতরকম খেলা খেলতাম, গল্প শুনাতাম, নিজে গোসল করার সময় মেয়েকেও গোসল করাতাম, তারপর খাইয়ে দিতাম, আমার বুকে করে ঘুম পাড়াতাম, তারপর নিজেও ঘুমাতাম। পুরনো জামাগুলো ছিড়ে গেলে মামণি নতুন নতুন জামা বানিয়ে দিতো। কিছুদিন পর আমরা ঐ বাসা বদলে মিরপুরে চলে যাই। সে জায়গাটা খুব ভাল ছিল। পুরো পাড়াটা ছিল একটা পরিবারের মত।

আর বহুদিন পর্যন্ত পিচ্চিদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে ছোট। তাই সব বাসাতেই আমার আদর ছিল অনেক বেশি। সবাই আমার আশা পুতুলের কথা জানতো। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি প্রতিদিন সকালে আশা পুতুলকে কোলে নিয়ে সব বাসায় বেড়াতে যেতাম। যেদিন পুতুলটা কেনার এক বছর হল সেদিন বেশ ঘটা করে জন্মদিন পালন করলাম।

খেলার বন্ধুদের দাওয়াত দিলাম, একদম কার্ড দিয়ে। চানাচুর, কেক, শরবত দিয়ে নাস্তা দিলাম। সবাই কতকিছু উপহার দিল। একজন দিল একসেট ঝিনুকের গয়না, একজন দিল একটা লাল জামা। মোমবাতি জ্বেলে আমরা কেক কাটলাম।

অনেক মজা হয়েছিল। তখন পানির অনেক সমস্যা ছিল। ভোরের দিকে পানি আসতো আর সেটা ধরে রাখতে হতো। একদিন আশা পুতুলকে কোলে নিয়ে আমি রাস্তায় কাদার মধ্যে পড়ে গেলাম। বাসায় এসে নিজেকে পরিস্কার না করে এক বালতি পানি খরচ করে পুতুলকে গোসল করালাম।

আর মামণিতো এমন বকা! তারপর আমাদের পাশের বাসায় নতুন লোক এল। ওদের একটা মেয়ে ছিল, কাকলি। আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট। ওর এত্তগুলো খেলনা থাকলেও আমার আশা পুতুলের প্রতিই ওর লোভ বেশি ছিল। স্কুলে যাওয়ার আগে আমি মামণিকে বলতাম লুকিয়ে রাখতে, যাতে কাকলি এসে না পায়।

স্কুল থেকে এসে বের করে খেলতাম আর ওকে মাঝে মাঝে একটু দিতাম। কিছুদিন পরে দাদার অসুস্থতার জন্য আমরা বাড়ি চলে গেলাম। আব্বু শুধু রয়ে গেল অফিসের জন্য। সন্ধ্যায় কাকলি আসতো, আব্বু ওর সাথেই গল্প-টল্প করল, আর পাজি মেয়েটা ঠিকই খাতির জমিয়ে আব্বুর কাছ থেকে আশা পুতুলের দখল নিয়ে নিল। আমার ফিরে এসে দেখি ও পুতুলের চোখের ভিতর ভাত-টাত ঢুকিয়ে এক্কেবারে নষ্ট করে ফেলেছে।

আর ওটা নিয়ে খেলার উপায় ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল আমার আশা পুতুলটা মেরেই ফেলেছে। এত কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেক কেঁদেছি। সবাই সান্ত্বনা দিয়েছে আরেকটা পুতুল কিনে দিবে বলে।

পরে অবশ্য আর কেনা হয়নি। ছোটবেলায় আমার ওই একটাই পুতুল ছিল, আশা পুতুল। আমার লক্ষী মেয়ে।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।