আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারুণ্যের অহংকার এবং আমাদের সংস্কৃতিঃ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

তারুণ্যের অহংকার এবং আমাদের সংস্কৃতিঃ আমাদের তারুণ্যের এক বড় শক্তি নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ করার মানসিকতা। অনেকেই এ বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করলেও আশাবাদের গল্পও কিন্তু কম নয়। আমরা সবসময়ই ইতিবাচক শক্তির উপাসক। তাই আশাবাদের সেই বৃত্তে দাঁড়িয়ে আমরা নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধে রচনা করতে চাই আমাদের সাফল্যের অস্তিত্ব। তারুণ্যের সেই মানসিকতাকে ধারণ করেই এবারের লেখাটা লখিতে চাই।

তারুণ্যের বয়সটা যেমন টগবগে সময়কে ধারণ করার তেমনি তারুণ্যের সময়কেই ইচ্ছের পাখিগুলো ডানামেলে উড়তে চায় নানা অজানায়। উড়ে যাবার এই বাসনা থেকেই মনের কোণে নিজস্বতার শেঁকল ভেঙ্গে নানা নতুনত্ব বসত গড়তে থাকে। তরুণদের মন কোমল বলে এই বসতিগুলো স্থির আকার ধারণ করে খুব সহজেই। সম্ভবত নানা যুগের আবর্তে বিভিন্ন ঘূর্ণিপাকে অবস্থার যতোই পরিবর্তন ঘটুক না কেন তারুণ্যের ব্যাকরণ কখনই পরিবর্তিত হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দির তরুণরা যেমন নিজস্বতা নিয়ে হৈচৈ করতো এখনকার তরুণরাও তার চেয়ে ভিন্ন নয়।

তবে হৈচৈ এর মাত্রাটা বদলে গেছে। আগে ভাষার জন্য যে তরুণরা প্রাণ দিয়েছে এখন সেই তরুণদের স্মরণ করেই বর্তমানের তারুণ্য গায়ে ধারণ করছে নানা বর্ণমালার টি-শার্ট। বদলে যাওয়া তারুণ্যের এই ধরনে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে নিজেদের সংস্কৃতি ধারণ করার ইচ্ছা কিংবা সেই সংস্কৃতিকে অন্যের সামনে তুলে ধরার প্রেরণা কোনটাই বর্তমানের তারুণ্যের মধ্যে কম নয়। তবুও তার বর্হিঃপ্রকাশ এমন যে কারো কারো কাছে অনেক সময়ই তা দূর্বোধ্য মনে হয়। সংস্কৃতির পালাবদলে তারুণ্যের চাহিদা বদলে গেছে।

একসময় যে সিনেমা হল ছিল তরুণদের জন্য অধিকতর বিনোদনের মাধ্যম তারাই এখন দখল করে নিয়েছে ড্রয়িং রুমের কিংবা বেড রুমের টিভির রিমোটটি। আমার তারুণ্যরে বৈকালিক প্রহর যখন চায়ের আড্ডায় মেতে উঠতো তারুণ্যের বিভিন্ন ভাবনায় ঠিক তখনই বর্তমানের তরুণরা নিজেদেরকে খুঁজে ফেরেন ইন্টারনেটের নানা অলিগলিতে। ফুটবল মাঠে কিংবা নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় হয়ে উঠা ক্রিকেট প্র্যাকটিসে যে তারুণ্যকে দেখা যেত তাদেরই উত্তরসূরিদের খুঁজে পাওয়া যায় বর্তমানের জনপ্রিয় ইনডোর গেমস বিলিয়ার্ড সেন্টারে। অর্থাৎ এভাবেই বদলে গেছে তারুণ্যের প্রিয় সেই সংস্কৃতি। দেশ, মাতৃভাষা কিংবা আমাদের নিজস্বতা কোন কিছুই কিন্তু তারুণ্যের ক্ষেত্রে মুছে যায়নি।

বরং বদলে গেছে এক আধুনিক ধরনে, প্রযুক্তির মানসে, উচ্ছাসের বর্ণমালায় তারুণ্যের নিজস্বতা প্রকাশের ভঙ্গি। সেই বদলে যাওয়ার কারণেই হয়তো পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে মাঝে মাঝেই শঙ্কা জাগে এই প্রজন্ম কি নিজের সংস্কৃতিকে ভুলতে বসেছে ভেবে? সংস্কৃতির পরিমণ্ডল বদলে গেছে। বদলে গেছে সংস্কৃতির আদান-প্রদানের রীতি। শুদ্ধতার সংজ্ঞা বদলে গেছে। ভাষার ব্যাপ্তি বিকশিত হয়েছে প্রবলভাবে।

সম্ভবত এতসব বদলে যাওয়ার ধারায় নিজেকে প্রকাশ করার শব্দচয়নও বদলে গেছে তারুণ্যের। তাইতো পূর্ব প্রজন্মের কাছে যা দূর্বোধ্য বর্তমানের কাছে তাই অনেক বেশি নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম। এভাবেই সম্ভবত যুগ বদলায়, যুগের রীতিনীতি বদলায় বদলে যায় তারুণ্যের সংস্কৃতি। সংস্কৃতির এই বদল ধারায় তারুণ্যের কাছে যেমন ইংরেজি গান আরাধ্য থাকে কিংবা হিন্দি গানে যেমন নিজের ভাষা প্রকাশ করার আবেগ থাকে তেমনি আবার বাংলা গানেও আন্তর্জাতিকতা আনয়ন করতে এই তরুণদেরই অগ্রসর অংশ হিপহপ কিংবা হেভি মেটালের মতো ধারার গান বাংলা ভাষাতে রপ্ত করার চেষ্টা করে। এই আধুনিক অংশের পাশাপাশি সৃজনশীল তরুণরা নিজেদের মাটির গানও ধারণ করতে চায়।

নিজস্ব সংস্কৃতির এক বিশাল ভান্ডার যে এখনও অদেখা পড়ে আছে তা তারা জানতে চায়। শত বর্ষের জনপ্রিয় হয়ে যাওয়া লালনের গান তাই যেমন তারুণ্যের কণ্ঠে স্থান পায় তেমনি বাউল কিংবদন্তি শাহ আব্দুল করিমের গানও তরুণরা নিজের ভেতর ধারণ করে অস্তিত্বের মানসে। শুধু গানের ভান্ডার নয়- বদলে যাওয়া এই সংস্কৃতির ভান্ডার ছড়িয়ে আছে আমাদের সাহিত্য, শিল্প, পারফর্মিং আর্ট, পেইন্টিং, স্থাপত্য ইত্যাদি নানা শিল্পের বর্ণিল স্তরে। এসব কিছুর অনেক অংশই আমাদের অদেখা থেকে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা থেকে পাশ করে নিজেদের শিল্প সত্ত্বা মৃৎশিল্পে বিকাশ করার প্রয়াসে দুই টগবগে প্রাণ ঢাকা শহরের প্রাণ কেন্দ্রেই গড়ে তুলেছে মৃৎশিল্পের এক আধুনিক সংস্করণ 'ক্লে ইমেজ'।

এই দুজন টগবগে তারুণ্যের নাম মারুফ ও পুতুল। তাদের সামনে দেশ পাড়ি দেবার সোনালী হাতছানি থাকলেও দেশের মাটি আর দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে তারই উত্তরোত্তর শ্রী বৃদ্ধিতে কাজ করার ইচ্ছা এই সময়ের তরুণদের সংস্কৃতির প্রতি তীব্র ভালোবাসার প্রতিফলন বলেই মনে হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন জিয়া। তার সঙ্গে ছিলেন সমকালীন আরো কয়েকজন প্রতিভাবান বন্ধু যাদের একজন ফারহান এবং অন্যজন তুহিন। বন্ধুত্বের সুতীব্র বাসনায় স্থাপত্য বিদ্যার পাশাপাশি নিজের মনের ভেতর এক বড় স্থপতি হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন এই তরুণদের দল।

সম্ভবত সেই ইচ্ছেকে সুতীব্র করে গড়ে তুলতে গানের জগতে নিজেদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শ্রোতাদের সঙ্গে 'শিরোনামহীন' নামে। চিত্রকল্পের মতো বড় ক্যানভাসের বিষয়কেও গানের এক সুন্দর গতি ধারায় রূপান্তর করেছেন এই তরুণরা। বড় বেশি বিশ্লেষণ না করে এ কথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় তাদের এই প্রচেষ্টা আমাদের সংস্কৃতির আগামী চিন্তা ভাবনায় সংযোজন করবে নতুন ইতিহাস। মৃৎশিল্পে একটি ক্লে ইমেজ কিংবা তারুণ্যের গানে শিরোনামহীন শুধুমাত্র উদাহরণ নয় বরং এই সময়ের তরুণদের এগিয়ে চলার একেকটি মাইলফলকও। এই মাইলফলকে জড়িয়ে আছে অস্তিত্বের কথা, নিজেদের ভালোলাগার গল্প আর নিজের সংস্কৃতির গৌরবজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিনির্মাণ।

সত্যের এই প্রবল সম্ভাবনায় এই উদাহরণগুলো শুধুমাত্র গল্প কথা নয় বরং এদের প্রচেষ্টা তারুণ্যের এক প্রবল ধর্মকে ধারণ করে আছে। আমাদের সংস্কৃতির এক জোড়ালো অংশ আমাদের ফ্যাশন। আধুনিক এই সময়ে এসে উপরের উদাহরণের মতো ফ্যাশনের ক্ষেত্রেও নিজস্ব সংস্কৃতি আর আমাদের পোশাকের নিজস্বতা তুলে ধরতে অনেকগুলো তরুণ প্রাণ কাজ করে যাচ্ছেন। সংঘবদ্ধ না হলেও এদের প্রচেষ্টায় দেশীয় সংস্কৃতির আধুনিকায়নের এক প্রবল ইচ্ছা ফুটে উঠে ব্যাপকভাবে একটা সময় ছিল যখন সংস্কৃতির তীব্র বলয় মানেই ছিল মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের ভেতর প্রবলভাবে গেঁথে গেলেও আসলে আমাদের সংস্কৃতির জন্য সবচেয়ে বড় চেতনা ছিল একুশের আন্দোলন।

মজার বিষয় আধুনিক তারুণ্য এই সব চেতনাকে ধারণ করেই নির্মাণ করে যায় আগামীর স্বপ্ন। শুধু অতীত কথনে নয় বরং বর্তমানের বাস্তবতা কিংবা আগামীর ভাবনায় তারুণ্যের ইচ্ছা শক্তির প্রকাশ অনেক বেশি সাবলীল। একজন তরুণ নির্মাতা হিসেবে তাই এনামুল করিম নির্ঝর নিজের স্বপ্নের সেলুলয়েড কপি তৈরি করতে পারেন অবলীলায়। আর তাই সিনেপ্লেক্স-এর মতো আধুনিক মিলনায়তনে বসে তরুণরা যেমন উপভোগ করে তেমনি তারুণ্যের সূতিগাকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সংলগ্ন বলাকা হলেও উপভোগ করে আলোচিত ছবি'আহা'। শুধু এই ছবিটির ক্ষেত্রেই নয় বরং এক সময় মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি ছিল তরুণদের জন্য নির্মাতা হওয়ার স্বপ্নের খোরাক।

চলচ্চিত্রের পাশাপাশি আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আমাদের সংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে প্রভাব রেখে চলেছেন বেশকিছু তরুণ মুখ। একজন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কিংবা একজন অমিতাভ রেজা'র হাত ধরেই আমাদের টিভি নাটক ও বিজ্ঞাপন গল্পে দেশীয় ঐতিহ্য আর দেশীয় সংস্কৃতি এবং ৫৬ হাজার বর্গমাইলের গল্প ফুটে উঠে প্রবলভাবে। সত্যিকার সংস্কৃতিক ধারা বিনির্মাণে তারুণ্যের এই শক্তিশালী মুখগুলো বিভিন্ন স্তরে ভূমিকা রেখে চললেও এক স্বাপ্নিক বিষুব রেখা তাদের বেধে রেখেছে সমান্তরাল ধারায়। তারুণ্যের নতুন প্যাশন হচ্ছে 'ফেইস বুক' আর 'ব্লগ'। একটি ভার্সুয়াল প্লাটফরম কীভাবে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে মানব মনে এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারে-যা আমার তরুণ বয়সে কল্পনারও বাইরেছিল।

এই আমি নিজের কথাই বলছি-পেশাগত জীবনের নানান টানপোড়েনের মধ্যেও আমি এই ভার্সুয়াল জগত সামহোয়ারইনের নেশাগ্রস্থ্য নিয়মিত একজন পাঠক। মাঝে মাঝে কম-বেশী লিখিও। আমার এই লেখা লেখির প্রেরণাও এই ব্লগের মেধাবী তবুণ লেখকগন। এই প্লাটফরম আমার মতই জনাব মঞ্জুরুল হক, কালপুরুষ, ত্রিশোনকু,ধীবর, ক্যামেরাম্যান, মাহাবুব সুমন এর মত বয়জেষ্ঠ ব্লগারকে তারুণ্যের উদ্দীপনা দিয়েছে। এখানে তরুণেরা যে কত সুন্দর সুন্দর লেখা লিখে যাচ্ছেন-তা হয়ত তারুণ্যের উদ্দীপনায় ভেবে দেখারও ফুশরত পায়না-সেইসব প্রতিভাধর তরুণ ব্লগারগন।

তারা অবিরাম লিখেই যাচ্ছেন। এই ব্লগে না এলে জানতে পারতামনা, পরিচিত হতে পারতামনা ব্লগার কবি হাসান মাহাবুব, আন্দালীব, অন্তিম, সুলতানা শিরিন সাজি, সহেলী, সুনীল সমুদ্র, ফরহাদ উদ্দীন স্বপন, আইরীন সুলতানাদের মত আধুনিক মনস্ক তরুন কবি প্রতিভার সাথে। এখানে না এলে জানতে পারতামনা অত্যন্ত প্রতিভাধর রাগিব, ম্যাভেরিক,ফারহান দাউদ, তাজা কলম, মিল্টন, ইমন জুবায়ের, অমি রহমান পিয়াল, ভাস্কর চৌধুরী, রন্টি চৌধুরী, পারভেজ, তায়েফ আহমাদ, জানা, মানবী, রুখসানা তাজীন, নূশেরা, ফেরারী পাখি, একরামুল হক শামীম, নাফিস ইফতেখার, শামশীর, ইউনুস খান এবং আরো তরুণ ব্লগার ভাংগন এর মত মেধাবী সৃজনশীল লেখকদের! সাইফুর, মুহিব, কৌশিক, নিশাচর, মেহবুবা, সজীব, উজ্জ্বল, নাঈম, মুখ ও মুখোশ, সুবিদ, স্পেলবাইন্ডার, রাজীব এরা শুধু ভালো লিখেয়েই নন-এরা মানুষ হিসেবেও অসাধারন মানবিক গুনে গুণান্বিত! সত্যিকার অর্থেই আমাদের এতদিনের সংস্কৃতি ধারণ করার পাশাপাশি তাকে সামনের পথে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করতে হবে এই তারুণ্যের শক্তিকে। শুধু তাই নয়, চিরায়ত এই সংস্কৃতিকে তরুণ মনের কাছে কিভাবে উপস্থাপন করলে খুব সহজেই তাদের আকৃষ্ট করবে তাও ভাবতে হবে নীতি নির্ধারকদের। শিক্ষা জীবনের নানা স্তরে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের মাধ্যমে তরুণদের সংস্কৃতির নানা বিকাশমান ধারার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে।

আর আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্যের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। তবে এসব কিছুর পাশাপাশি স্রোতের মূল ধারা হিসেবে তারুণ্যের শক্তিকেই নিজের সংস্কৃতির নিজস্বতা ধারণ করার চেষ্টা করতে হবে। বুকের সামনে শুধু বর্ণমালা নয় কিংবা মানচিত্রে নিজ ফ্যাশনের অস্তিত্ব ঘোষণা নয় বরং তাদের চেষ্টা করতে হবে মননে ও মানসে নিজেদের প্রকাশ করা আপন সংস্কৃতির বলয়ে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।