আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যা লিখেছেন ঠিক লিখেছেন, বললেন মওদুদ

এক যুগ আগে প্রকাশিত একটি বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহের হত্যার পেছনে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় দলের ভেতরে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।
গত সোমবার লে. কর্নেল এম এ তাহের ও তাঁর সঙ্গীদের ১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে গোপন বিচার অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে বলা হয়েছে, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড আদপে হত্যাকাণ্ড। জেনারেল জিয়াউর রহমান ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড প্রদানে মনস্থির করেন। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ের এ অংশটির সমর্থনে মওদুদ আহমদের ‘এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন।


মওদুদ আহমদ প্রথম আলো ডটকমকে বলেছেন, ‘আমার বইয়ের উদ্ধৃতি এমন ডিসটর্টেডভাবে (বিকৃত) উল্লিখিত হবে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আমি কোথায় বলেছি যে এই বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান-ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করতে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার মনস্থির করেছিলেন?’ তিনি বলেন, ‘কর্নেল তাহেরের বিচারের বিষয়ে আমার বইয়ে লেখা ছিল...কর্নেল তাহেরকে সাজা দেওয়ার প্রশ্নে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা সব সময় তাঁর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে। এ ব্যাপারে জিয়া ৪৬ জন সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সকলেই একবাক্যে তাহেরের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির পক্ষে মতামত দেন। ’
কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ রায়ের ১৩-১৪ পৃষ্ঠায় বিচারপতিরা লিখেছেন, “In his book, titled, “Democracy and the Challenge of Development : A study of Political and Military Interventions in Bangladesh”, Barrister Maudud Ahmed, a close associate of General Ziaur Rahman, wrote; “Why did Zia allow Taher to be hanged, the person who freed him from captivity?...the officers who had not taken part in the liberation war, had found a new ally in Zia after the killing of Mujib and removal of Mushtaque. They needed each other to survive both as a class and a force in the Civil-Military structure of the country. When it came to sentencing of Taher, the repatriated officers wanted him hanged. Out of the forty six senior army officers, summoned by Zia to discuss the issue, all were in favour of this ultimate and final form of punishment” (page 29-30). In the foot note, Barrister Moudud mentioned, “This was disclosed to him by Zia himself”.”
মওদুদ আহমদের বইয়ের সঙ্গে রায়ের উদ্ধৃতাংশের কোনো পার্থক্য নেই। বইয়ের ২৯ ও ৩০ পৃষ্ঠায় হুবহু এ কথাই বলা হয়েছে এবং ফুটনোটটি আছে ৩৪ পৃষ্ঠায়।


মওদুদ আহমদের এই বইয়ের বাংলা সংস্করণের (গণতন্ত্র এবং উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ/প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন) অনুবাদক জগলুল আলম এবং প্রকাশক দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। এই বইয়ের ২৯ পৃষ্ঠায় মওদুদ আহমদ লিখেছেন, “প্রশ্ন থেকে যায়: যে তাহের জিয়াকে অন্তরীণাবস্থা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করলেন, জিয়া কেন তাঁর মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর হতে দিলেন? স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তাঁরা একই সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন এবং দীর্ঘদিন যাবত্ পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্বাধীনতার পরে জিয়াকে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসারদের সঙ্গে ভারসাম্য বিধান করে সেনাবাহিনীতে নিজের অবস্থান জোরদার করতে হয়েছে। যেসব অফিসার সরাসরি যুদ্ধে যাননি, শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড এবং মুশতাকের অপসারণের পর তাঁরা জিয়ার মধ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে একজন বন্ধু খুঁজে পান। দেশের সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতা কাঠামোতে একটি শ্রেণী ও শক্তি হিসেবে টিকে থাকার জন্য এঁরা পরস্পরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।

তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশের প্রশ্নে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসাররা সব সময় ইতিবাচক সায় দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জিয়া ৪৬ জন সিনিয়র সামরিক অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সকলেই একবাক্যে তাহেরের জন্য চূড়ান্ত শাস্তির পক্ষে সায় দেন। ” এই অংশের ফুটনোট হিসেবে ৩৪ পৃষ্ঠায় মওদুদ আহমদ লিখেছেন, ‘জিয়া নিজে লেখককে এ কথা বলেন। ’
গতকাল মওদুদ আহমদকে প্রকাশিত রায়ে তাঁর বই থেকে উদ্ধৃত অংশটি পড়ে শোনানো হয়। জবাবে মওদুদ আহমদ বলেছেন, তিনি যা লিখেছেন, ঠিক লিখেছেন।

সব সময় লেখার ব্যাপারে তিনি ‘অবজেকটিভ’ (বস্তুনিষ্ঠ)। তিনি কারও প্রতি ‘বায়াস’ (পক্ষপাতদুষ্ট) হয়ে কিছু লেখেন না। ঘটনাটি ১৯৭৬ সালের। সে সময় তিনি জিয়াউর রহমানকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেনও না, শুধু নামে চিনতেন। তবে কর্নেল তাহের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু বলা বা লেখার আগে সে সময়কার প্রেক্ষাপট বিবেচনার অনুরোধ জানান বিএনপির এই নেতা।


বিএনপির নেতারা যা বলছেন: বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলেছেন, মওদুদ আহমদকে তাঁর কৃতকর্মের ব্যাখ্যা দিতে হবে। অনেকে মনে করছেন মওদুদ আহমদ তাঁর অতীতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় এমন কথা লিখেছেন। যখন তিনি বইটি লেখেন, তখন তিনি জাতীয় পার্টির সদস্য ছিলেন। এ ধরনের বিষয় লেখার ফলে কী হতে পারে তা তিনি বোঝেননি। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাহের হত্যা মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে খরব ছাপা হতে থাকে।

তারপর থেকে মওদুদ আহমদ দলের নেতা-কর্মীদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে তিনি বইয়ের কোথাও উল্লেখ করেননি তাহের হত্যায় জিয়াউর রহমান যুক্ত ছিলেন।
তবে বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ প্রথম আলো ডটকমকে জানিয়েছেন, তাঁরা মওদুদ আহমদের লেখা বইটি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, বেশির ভাগ নেতা-কর্মী বিশ্বাস করেন না যে আদালত মওদুদ আহমদকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন বা মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। দলের ভেতর মওদুদ আহমদকে নিয়ে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দলের নেতা-কর্মীদের পক্ষে এ বিষয়টি বিশ্বাস করা কঠিন যে তাহের হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান জড়িত—এ সিদ্ধান্তে আসতে বিএনপিরই স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের বই থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে।


বিএনপির দায়িত্বশীল আরেকটি সূত্র বলছে, মওদুদ আহমদ পুরোপুরি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি নিজেকে বাঁচাতে যা কিছুই বলুন না কেন তাতে নেতা-কর্মীদের মনোভাবের খুব এটা পরিবর্তন হচ্ছে না। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মওদুদ আহমদকে অবশ্যই দলের সর্বোচ্চ ফোরামে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে হতে পারে বলেও তাঁরা জানান। তাঁরা আরও বলেন, কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় লেখা মওদুদ আহমদের আরেকটি বইয়েও এমন কিছু তথ্য আছে, যা সবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা বলেছেন, বইয়ে প্রকাশিত তথ্যের দায় অবশ্যই লেখককে নিতে হবে।


গত শুক্রবার যুবদলের নেতাকর্মীরা মওদুদ আহমদের কুশপুত্তলিকা দাহ করে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। বগুড়ায়ও বিক্ষোভ করেছে যুবদল। গতকাল শনিবার অবশ্য যুবদল এর দায় অস্বীকার করেছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া ও বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান বইটি না পড়ে এবং রায়ের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ না দেখে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রফিকুল ইসলাম মিয়া প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, মওদুদ আহমদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তাঁকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।

জিয়াউর রহমান লে. কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে খুবই ব্যথিত ছিলেন। দলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের কাছে তিনি এ কথা অনেকবার বলেছেন।
স্থায়ী কমিটির অপর এক সদস্য হান্নান শাহ বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না জিয়াউর রহমান আগেই লে. কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে বিশৃঙ্খলা করছিল, সবাই তাদের বিচার চেয়েছে। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।