আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রগ কাটা নিজামি অস্থির সরকার

সৎ সংগে স্বর্গবাস, অসৎ সংগে সর্বনাশ

'ছাত্রজীবনে যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে ইসলামী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলাম, এখন আল্লাহ্তায়ালা ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে সে স্বপ্ন পূরণের ব্যবস্থা করেছেন। ' - মতিউর রহমান নিজামী (দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.১.২০১০) 'যদি এক বছরের পরিকল্পনা কর তবে শস্যদানা রোপণ কর, যদি দশ বছরের পরিকল্পনা কর, তবে গাছ লাগাও, আর যদি হাজার বছরের পরিকল্পনা কর, তবে ভালো মানুষ গড়ো। ইসলামী ছাত্রশিবির সে কাজটি যথার্থভাবে সম্পন্ন করছে। ' - মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.১.২০১০) 'আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা শিবিরকে প্রতিহত করার যে ঘোষণা দিয়েছে, আমরা তাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছি। পৃথিবীর সকল অস্ত্র জড়ো করে আমাদের পরাস্ত করা যাবে না।

' - রেজাউল করিম, সভাপতি, ছাত্রশিবির (দৈনিক সংগ্রাম, ১৯.১.২০১০) বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন। এই সংগঠনের ৩৩তম কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজন করা হয় গত ১৯ জানুয়ারি ২০১০ বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী। ওই অনুষ্ঠানে অনেকের মধ্যে বক্তৃতা করেন জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, শিবির সভাপতি রেজাউল করিম। সেই অনুষ্ঠানে তারা যে বক্তব্য রাখেন তার যে অংশ জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তার মধ্য থেকে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

এবার তাদের বক্তৃতাংশগুলো লক্ষ্য করা যাক। নিজামী বলেছেন, তার ছাত্রজীবনের স্বপ্ন শিবিরের মধ্য দিয়ে পূরণ করেছেন। কি ছিল সেই স্বপ্ন? ১৯৭১ সালে জামায়াত তা পূরণ করার মওকা পায় রাজনৈতিকভাবে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরুদ্ধে তারা সশস্ত্র অবস্থান নেয়। রাজনৈতিকভাবে তারা বাংলাদেশের জন্ম চায়নি।

পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চেয়েছে। দ্বিতীয়ত : সশস্ত্র সংগঠন আলবদর, রাজাকার, আল-শামস্ তৈরি করে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর দোসর হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় সক্রিয় অংশ নেয়। পাকিস্তানের স্বপ্ন বুকে নিয়ে তারা বাংলাদেশের মানুষকে খুন, অপহরণসহ নারকীয় সব যুদ্ধাপরাধে অংশ নেয়। আজ নিজামীর সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বেড়ে উঠেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। তাহলে সংগঠন হিসেবে শিবির কি স্বপ্ন দেখছে? নিজামীর বক্তব্য মাথায় নিলে বোঝা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম কি তাহলে তাদের নতুন স্বপ্ন? জামায়াতের পক্ষে ১৯৭১ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কুখ্যাত ঘাতক হয়ে ওঠা রাজাকার মুহাম্মদ কামারুজ্জামান হাজার বছরের পরিকল্পনা নিয়ে কোনো বিষাক্ত বীজ মহীরুহে পরিণত করতে চান ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভক্ত ছাত্রলীগের একাংশের বিরুদ্ধে যে নৃশংসতা বর্বরতা আর মধ্যযুগীয় পৈশাচিক হত্যাকা-ে অংশ নিয়েছে ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা তা কি সেই বড় স্বপ্নের অংশ? এর মধ্য দিয়ে ছাত্রশিবির ছাত্রসমাজকে কি ম্যাসেজ পাঠাতে চায়? সশস্ত্র, ধর্মের উন্মাদনা ছড়িয়ে সংঘবদ্ধতা, জঙ্গিপনা আর নৃশংসতায় বেড়ে ওঠা শিবির ছাত্রসমাজের মধ্যে কোন আদর্শটি জানান দিতে চায়? ছাত্রসমাজের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের এই পুরনো কায়দায় শিবির কি তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরণের দিকে এগুচ্ছে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র খুন করে ম্যানহোলে ফেলে সেই পূর্বাভাসই কি দিচ্ছে শিবির? ছাত্রলীগ সরকারি ছাত্র সংগঠন।

বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রথায় স্বভাবতই সরকারের প্রশাসনিক এবং পুলিশি সমর্থন তাদের দিকেই থাকবে। তার পরও ছাত্র শিবির সভাপতি রেজাউল করিম কোন ভরসায় ছাত্রলীগের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বলতে পারেন, পৃথিবীর সকল অস্ত্র জড়ো করে আমাদের পরাস্ত করা যাবে না। শিবিরের এই শক্তির উৎস কি? সরকারকে খুনের মাঠে নামিয়ে আরো কোনো বড় বিপর্যয়ের রক্তখেলায় কি নামাতে চায় শিবির বা জামায়াত? ২. ছাত্রশিবিরের সেই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় জামায়াত নেতা নিজামী বলেছেন, 'ইসলামী ছাত্রশিবির আল্লাহ্র পক্ষ থেকে একটি নেয়ামতস্বরূপ, আমানত বটে...। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যখন হুমকির মুখে পড়ে, বিপদগ্রস্ত হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঈমান-আকিদার ওপর আঘাত আসে, তখন তাকে কী করতে হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ' তাহলে আওয়ামী শাসনকে রুখতে 'বলার অপেক্ষা' না রেখেই কি শিবির তলোয়ার, চাপাতিসহ মধ্যযুগীয় অস্ত্রের ব্যবহার করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিপক্ষের ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের 'রগ' কেটে প্রমাণ দিতে চায় যে 'মানুষের ঈমান-আকিদা' প্রতিষ্ঠা করতেই তারা এই বর্বরতার পথ বেছে নিয়েছে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনার পর এক প্রেস কনফারেন্সে জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেছেন, 'জামায়াতে ইসলামী কখনো হত্যা, সন্ত্রাসের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।

' মুজাহিদের এই বক্তব্য কি তার বা তাদের অতীত কর্মকান্ডের সঙ্গে মেলে? রাজশাহী মেডিকেল কলেজে জল্লাদখানার কসাইদের মতো নারকীয় উল্লাসে মেতে তারা হত্যা করেছিল ছাত্রনেতা জামিল আখতার রতনকে। ১৯৭১ সালের জামায়াত-মুজাহিদের সেই যুদ্ধাপরাধী নারকীয়তা এখনো বজায় আছে। সময় ও সুযোগ পেলেই তারা মেতে উঠছে এই হত্যাযজ্ঞে। ৩. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের যে উত্থান তার মূলে হচ্ছে তাদের ‘লাশ’ বিনিয়োগ। বিভিন্ন সময় প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে মেতে তাদের সংগঠনের ছাত্রদের যত লাশ পড়েছে, তাই তাদের রাজনীতিতে নতুন বিনিয়োগ হিসেবে জামায়াত কাজে লাগিয়েছে।

গত তিন দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংঘর্ষে নিহত ২৪ ছাত্রের মধ্যে ১৬ জন শিবিরের। এই সংখ্যাধিক্যকেই তারা কাজে লাগিয়ে ‘লাশের রাজনীতি’ এবং ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠার হীন কৌশল’ দুটোকে এক করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দলে টানবার চেষ্টা করেছে। যে কোনো অন্যায্য বা অন্যায় হত্যার পর ছাত্রসমাজের মধ্যে যে সমবেদনা জাগে তাকেই কৌশলে কাজে লাগিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গোটা রাজশাহী মহানগরজুড়ে প্রগতিশীল বাম সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা, অদক্ষতা, কর্মক্ষমহীনতা, অসততা যত বেড়েছে শিবির বিপুল উদ্যোগে সেই ফাঁকা জায়গায় তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। মহানগরীজুড়ে কোচিং সেন্টার, মেস, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ নানারকম ক্ষুদ্র ব্যবসায় তারা লগ্নি করেছে।

এই অর্থলগ্নির একটা বড় অংশ শিবির সংগঠনের পেছনে খরচ করা হয়েছে। এই আর্থিক প্রণোদনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা গ্রামের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা লাঘব করেছে। টিউশনি, লজিং ইত্যাদি জুগিয়ে ছাত্রজীবনে আর্থিক সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরির নিশ্চয়তার ধারাবাহিক পথ তৈরি করে জামায়াত তাদের ছাত্র সংগঠনকে মজবুত করার কাজে লাগিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে যে আর্থিক কর্মকা- তার প্রায় পুরোটাই এখন জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারসহ সকল রকমের স্টেশনারি, পরিবহন বাণিজ্যের মূল অংশের নিয়ন্ত্রক এখন শিবির-জামায়াত।

শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন দোকান, বাজার, পার্শ্ববর্তী গ্রামে দীর্ঘদিনের শ্রমে শিবির সমর্থকদের জুটিয়ে জামায়াত তাদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝেনি তখন জামায়াত রাজশাহী মহানগরী এবং বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে সংগঠনের স্বার্থকে পরিপুষ্ট করেছে। জামায়াত বিশ্বাস করেছে এই এলাকায় জামায়াতের অবস্থান শক্ত হলে, এখানকার প্রশাসন এবং সকল আর্থিক ব্যবস্থাপনাও তারাই নিয়ন্ত্রণ করবে। তাদের এই বিশ্বাসকে তারা কর্মে পরিণত করেছে। এই পরিকল্পনা রাজশাহী সমগ্র জেলা এবং পার্শ্ববর্তী নাটোরের একাংশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে তারা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

গত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে বিএনপির দুই মন্ত্রী রাজশাহীর ব্যারিস্টার আমিনুল হক, নাটোরের রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, জামায়াতের সাংগঠনিক-আর্থিক সক্ষমতা বাড়াতে মুক্তহস্তে সমর্থন জুগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে তারাও আর্থিক এবং সাংগঠনিক লাভ পেয়েছে। এই দেয়া নেয়ার রাজনীতি থেকে রাজশাহীতে মহাজোটের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মেয়র, এই দুই প্রভাবশালী নেতাও মুক্ত নন বলে অনেকের অভিযোগ আছে। ওপরে ওপরে জামায়াতবিরোধিতার ভাব দেখালেও ভেতরে ভেতরে নানান লেনদেনের অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধেও আছে। যে কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এককালের শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রীকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে বড় নেতারা খুব একটা সচেষ্ট নন।

আওয়ামী ছাত্রলীগের বিভাজন টিকিয়ে রাখতে স্থানীয় মেয়রের পক্ষপাতের পেছনেও এ রকম নানা কারণকে চিহ্নিত করেন অনেকে। শিবির এবং জামায়াত যে এই কাজে অনেকটা সফল তার বড় প্রমাণ চাঁপাইনবাবগঞ্জের পৌরসভার মেয়র, শিবগঞ্জ, পবা, নাচোল উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় জামায়াত নেতারা। ৪. কেন এই ‘লাশ’? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছিল। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর আত্মবিশ্বাসী আওয়ামী লীগকেও কিছুটা ভয় পেয়ে যায় জামায়াত। তারা বুঝতে পারে এই আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে না পারলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরকার সত্যিকার পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব জামায়াতকে কিছুটা এড়িয়ে চলতে থাকে। সে ক্ষেত্রেও এমন একটা ইস্যু দরকার ছিল যাতে সরকারকে অস্থির করে তাদের প্রতিহিংসাপ্রবণ চেহারা উন্মোচন করতে পারলে বিএনপির রাজনৈতিক নৈকট্য এমনিতেই এসে যাবে। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের সমর্থক উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্প্রতি বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োগ দেয় যেখানে আপাতত আওয়ামী লীগ সমর্থকরাই এগিয়ে থাকে। সে কারণে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেও বড় ধরনের চাপের মুখে রাখতে চায় তারা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত।

সম্প্রতি তাদের যে সম্মেলন হয় সেখানে মূল ছাত্রদের চাইতে চাপিয়ে দেয়া নেতারা পদ পায়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় মেয়র এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাজনৈতিক পদ পাওয়া সাবেক এক ছাত্রনেতার যোগসাজশকে দায়ী করে অভিমানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে স্থানীয় ছাত্রলীগের একটা বড় অংশ। ছাত্রলীগের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগায় জামায়াত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংঘাত ঘটে ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০ রাজশাহীতে বিশাল জনসমাবেশ করে জামায়াত।

সেখানে তাদের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এ রকম সমাবেশের নিরাপত্তার জন্য সাধারণত সারাদেশের শিবির বা জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডার এবং বিশেষায়িত ক্যাডারদের আনা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি রাতে এই ঘটনা ঘটানোর জন্য ছাত্রশিবিরের সব রকম সমর এবং জনবল প্রস্তুতি তৈরি ছিল। মধ্যরাতের পর এই বিশেষায়িত বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝটিকা আক্রমণ করে হত্যা এবং রগ কাটার কাজটি সুসম্পন্ন করে। সে ক্ষেত্রে পুলিশ, র‌্যাব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ফাঁকি দিতে কিংবা ম্যানেজ করতে তারা সকল প্রস্তুতি সেরে রাখে।

ভূ-কৌশলগতভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে শিবির সমর্থক এবং নেতাকর্মীদের দ্বারা এমনভাবে পরিবেষ্টন করতে তারা সমর্থ হয়েছে যে, এই হামলার পর নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়া তাদের জন্য মোটেই কঠিন নয়। সুতরাং 'লাশ' এবং বিভীষিকা তৈরি করে তারা সরকারকে অস্থির, ক্রোধান্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে বিতর্কিত করতে চেয়েছে। অন্যদিকে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী হত্যার বদলা নেয়ার কাজটিও এই সুযোগে সেরে ফেলে। মনে রাখতে হবে, ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে পিলখানার হত্যাকান্ডের বছরপূর্তি ঘটতে যাচ্ছে।

সরকারকে দিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ পর্যন্ত যদি দেশজুড়ে হত্যা, খুন, হামলা-মামলা, গ্রেপ্তার, ভাঙচুর অব্যাহত রাখা যায় তবে, পিলখানার হত্যার বিচারের বিষয়ে সরকারের অক্ষমতা এবং নানাবিধ প্রশ্ন তোলার কাজটি অনেক সহজ হয়। পুরো ঘটনাটি সফল হলে আপাতত কিছু ঝড়-ঝাপটা এলেও জামায়াতের জন্য সেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেক সুযোগ এনে দেবে বলেই লাশের দরকার ছিল। আপাতত সেই ক্ষেত্রে জামায়াত তার পরিকল্পনায় সফল হয়েছে এবং জামায়াতের পাতা ফাঁদে সরকার পা ফেলেছে। ৫. ক্রুদ্ধতায় সরকার সরকার যে ক্রুদ্ধ এবং ক্ষিপ্ত তা বোঝা যাচ্ছে সরকারের দায়িত্বশীল তিন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্যে। সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ও সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাম্প্রতিক যে দুটি মন্তব্য করেছেন তাতে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।

তিনি বিরোধী দলের নেত্রী বেগম জিয়াকে ‘সাম্প্রদায়িক’ এবং ‘অমানুষ’ হিসেবে চিহ্নিত করে তার ভাষায় ‘মানুষ’ শেখ হাসিনার সঙ্গে ঐক্য বা সুসম্পর্কের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ আয়োজিত সন্ত্রাসে নিহত ছাত্র আবু বকরের হত্যা বিষয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘ছাত্রলীগে ছাত্র শিবিরের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ’ বিরোধী দল সম্পর্কে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বিদ্বেষপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে সময়, সুযোগ এবং শক্তির সমন্বয় ঘটলে সরকারের হাতে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্র জিঘাংসাপ্রবণ হয়ে উঠবে। ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ, জিঘাংসাপ্রবণ ব্যক্তিবর্গের দ্বারা সেই রাষ্ট্র পরিচালিত হলে প্রতিটি সরকারের সকল কাজে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য হবে এবং আমজনতার অধিকারের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে। ইতোমধ্যে দেশব্যাপী তার বাস্তব প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

সৈয়দ আশরাফের ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির তত্ত্ব দেশের গোটা প্রশাসনে নতুন ঝড় তুলেছে। ইতোমধ্যেই আবিষ্কৃত হয়েছে পুলিশের মধ্যে শিবিরের অনুচর থাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নারকীয় হত্যাকা- ঘটাতে পেরেছে শিবির। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১০০ শিক্ষকের মধ্যে ৩২৫ জন আওয়ামী বা ১৪ দলীয় জোটের সমর্থক। বাকিরা জামায়াত ও বিএনপিপন্থী। সংবাদপত্রে আবিষ্কৃত হয়েছে বর্তমান সরকার কর্তৃক মনোনীত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ পুরো প্রশাসন শিবিরপন্থী।

শোনা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এই অনুপ্রবেশের ঘটনা অত্যন্ত ব্যাপক। সরকার এবং সরকারি দলের এই ‘তত্ত্ব-বিকাশ’ অব্যাহত থাকলে অচিরেই হয়ত সশস্ত্র বাহিনী, বিচার বিভাগ, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রে এই বিশেষ গোষ্ঠীর সমর্থন মিলবে। আত্মীয়তা-পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাকে বিবেচনায় নিলে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ এবং আওয়ামী লীগ কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে অনেককেই পাওয়া যাবে যারা স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকায় সরাসরি লিপ্ত জামায়াত-শিবির, মুসলিম লীগের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনেও আবদ্ধ। এখন, সৈয়দ আশরাফ এবং তার সরকার কি করবেন? সর্বত্র কি শুদ্ধি অভিযান চালাবেন? দেশের সকল প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনে এই অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে তাদের সরিয়ে আওয়ামীপন্থী নতুনদের জায়গা দেবেন? কাকে ধরবেন, কাকে ছাড়বেন? কিংবা এই ধরা বা ছাড়ার মাপকাঠি কি হবে? আত্মীয়তা-পরিচয়-অর্থবিনিময় দ্বারা কি প্রভাবিত হবে এই অভিযান? নাকি পক্ষপাতশূন্য রাজনৈতিক বিবেচনায় এই কাজে একাগ্রচিত্তে এগিয়ে যাবে সরকার? প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্র পরিচালনার এই ‘নিউ থিওরি’ বা শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখতে চাইলে সরকারের যে যোগ্যতা, সততা, দেশপ্রেম দরকার তা নিশ্চিত করার ক্ষমতা কি এই সরকার ধারণ করে? এসব প্রশ্ন উঠলে বোঝা যাবে সরকার দারুণতর ঘোলাজলে পা দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটবার পর চিহ্নিত ব্যক্তিদের ধরে, ন্যায্য শাস্তি দেয়ার চেষ্টার বদলে গণগ্রেপ্তার এবং ছাত্রশিবিরকে নির্মূল ও প্রতিহত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে সরকার পুরো বিষয়টি লেজেগোবরে করে ফেলেছে।

ইতোমধ্যে হত্যা-পাল্টা হত্যা নিরন্তরভাবে অব্যাহত আছে। গণধরপাকড়ের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি নির্মম লাঠিপেটার চেহারা যত বেশি দেখা যাচ্ছে মানুষ ততই সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছে। ৬. গত এক বছরে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনে সরকার যে পরিবর্তন এনেছে, তার সুফল ঘরে ওঠেনি সরকারের। ওএসডি, পদচ্যুতি, পুরস্কার, পদোন্নতি, তিরস্কার, পদাবনতি, অপছন্দের পোস্টিং ইত্যাকার নানা কাজ করেও সরকার প্রশাসনে গতি আনতে ব্যর্থ হয়েছে।

বরং বিভাগে বিভাগে বিরোধ বেড়েছে। বিচার বিভাগ বা প্রশাসনের দূরত্ব কমানো যায়নি। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স বিষয়ে আদালতের সাম্প্রতিক এক রায় সরকারকে দারুণ বিপত্তিতে ফেলেছে। আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে আপাতত তা সামলালেও গোদের উপর তা বিষফোড়া হয়েই আছে সরকারের জন্য। সুতরাং নতুন করে সরকারের সর্বত্র অনুপ্রবেশকারী খোঁজার তত্ত্ব শেষতক বুমেরাং হবার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিশেষত এর ফলে সমগ্র প্রশাসনে যে বিদ্বেষ এবং বিভাজনের সম্ভাবনা তৈরি হবে তা কার্যত সরকারকেই অচল করবে। সুযোগ সন্ধানীরা এ বিষয়ে পরস্পর পরস্পরকে শিবির-জামায়াত অভিধা দিয়ে সকল অপকর্ম করে পার পাবার চেষ্টা করবে। তার ওপর অযোগ্য, অসৎ, কর্মদক্ষহীন সুবিধাবাদীরা এই নতুন তত্ত্বের সুযোগ নিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রতিষ্ঠার যে সুযোগ নেবে তাও সরকারকে শেষতক বিপথেই নিয়ে যাবে। ৭. সরকারের দায়িত্বশীল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্য ও কাজ দিয়ে ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন তিনি রাষ্ট্রযন্ত্রের দায়িত্বশীল ব্যক্তির বদলে দলের মেঠোকর্মী হিসেবে নিজেকে দেখতেই বেশি পছন্দ করেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছাত্র হত্যার পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বলেছেন, শিবির প্রতিরোধ ও নির্মূল করা হবে।

শিবির নিধন বা নির্মূলের ইচ্ছা অন্তরে থাকলেও একজন মন্ত্রী দায়িত্বশীল পদে থেকে প্রকাশ্যে এ রকম বক্তব্য কি দিতে পারেন? দিলে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? প্রথমত : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মন্ত্রীর এই লাইসেন্স পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে। তাতে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে। লাশের সংখ্যা বাড়তে পারে। আপাতত এই ক’দিনে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলেছে। যে সংঘাত রাজশাহীতে নিবদ্ধ ছিল, তা সারাদেশে ছড়িয়েছে।

হত্যা এবং খুনের সংখ্যা বেড়েছে। সংঘাত আরো তীব্র হয়েছে। দ্বিতীয়ত : একজন মন্ত্রী কোনো সংগঠনকে প্রতিরোধ ও নির্মূল করার কথা বলার আগে সেই সংগঠনকে আইনসিদ্ধভাবে নিষিদ্ধ করার কাজটি করতে হয়। সরকার কি সত্যি সত্যিই স্বাধীনতাবিরোধী এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ করবে? ইতোমধ্যে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে হিজবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ করে তাদের বিষয়ে সরকার যে নমনীয়তা দেখিয়েছে তাও যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু হয়ত নিজেও জানেন না, তিনি একজন মন্ত্রী, সাঁথিয়ার আওয়ামী লীগের একজন কর্মী নন।

রাষ্ট্র এবং দলীয় কর্মীর মধ্যে পার্থক্য থাকতে হয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর যে কোনো উস্কানি বা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অনেক প্রাণহানির জন্ম দিতে পারে। সরকারকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায় তাদের হাতে অহেতুক অনেক সুযোগ তুলে দিতে পারে। সরকার গত ক’দিনে যে আচরণ করছে, তা দেখে মনে হচ্ছে সরকার ইতোমধ্যে তার মেয়াদের সাড়ে চার বছর অতিক্রম করেছে। শেষ সময়ে এসে আমাদের বেসামরিক রাজনৈতিক সরকারগুলো যে ভাষা, আচরণ এবং অস্থিরতা নিয়ে কাজ করে সোয়া বছর বয়সী সরকারের মাথায় এখন সেই ভূত।

সৈয়দ আশরাফের তত্ত্ব মাথায় নিলে প্রশ্ন জাগে, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টুকু সত্যি সত্যিই কি সরকারের মঙ্গল ও সাফল্য চান, নাকি তিনিও একজন 'অনুপ্রবেশকারীর' ভূমিকা রেখে সরকারকে বিপদে ফেলতে চান। ৮. এবার আসি সরকারি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কথায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকা-ের পর ছাত্রলীগের বিষয়ে সরকার এখনো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। ঢাকা কলেজে ভর্তি বাণিজ্য এবং শিক্ষক লাঞ্ছনার সঙ্গে জড়িত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের কারো বিরুদ্ধে কোনো আইনসম্মত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ সব ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসী কারো বিরুদ্ধে মামলা বা গ্রেফতার করা হয়নি।

শুধুমাত্র এই কলেজের ছাত্রলীগের কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। ঢাকার বাইরে দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহসহ অনেক জায়গায় ছাত্রলীগ ভর্তি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, শিক্ষক লাঞ্ছিতকরণসহ নানারকম আইনবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত। গত ক’দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনাও ঘটেছে। সরকার এ ক্ষেত্রে কোনো সুস্পষ্ট, দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে পারেনি। কিংবা নেয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যাসহ টেন্ডার, চাঁদাবাজি এবং অর্থের বিনিময়ে ছাত্রদলকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার অভিযোগ যে সব ছাত্রনেতা নামধারী ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে আছে, সরকার এখনো পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যা দেখে মনে হয়, সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক সরকার তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের এই অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অন্যদের ওপর চড়াও হওয়ার এই নীতি অব্যাহত থাকলে সরকার সম্পর্কে জনগণের নেতিবাচক ধারণা বাড়তে থাকবে। সবাই মনে করবে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস করে যে নেতারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ঘোরে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর যমুনায় অবাধে যাতায়াত করতে পারে। তাদের টিকিটি ছোঁয়ার কেউ নেই। সুতরাং এ রকম দুষ্কর্মকারী ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হওয়াটাই লাভজনক বিষয়।

সরকারের জন্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যা আদৌ স্বস্তিকর বিষয় নয়। ৯. সরকারের ভুল পুরো পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বুঝতে হবে সরকার নানারকম স্ট্রাটেজিক ভুল করছে। প্রথমত : সংসদে এবং সংসদের বাইরে সরকার তার কাজ দিয়ে সরকারবিরোধী পক্ষকে এক হওয়ার সুযোগ দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে সরকার দোদুল্যমানতা এবং প্রস্তুতিহীনতায় ভুগছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংঘর্ষকে পুঁজি করে পুলিশ ব্যবহার করে জামায়াত-শিবির নির্মূল প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে সরকার কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা দেখাচ্ছে না।

তৃতীয়ত : এক বছর পার করার পর পরই সরকারের মধ্যে অজানা কারণে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা কথা ও কাজ দিয়ে সেই অস্থিরতা প্রকাশ করছে। প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ছাত্রলীগে ছাত্র শিবিরের অনুপ্রবেশ নিয়ে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী প্রতিপক্ষ নির্মূল ও প্রতিরোধ বিষয়ে যে জেহাদি ঘোষণা দিচ্ছেন তাতে তাদের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা এবং অস্থিরতা প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। চতুর্থত : জনগণের মৌলিক দাবিগুলোর প্রতিশ্রুতি পূরণে মূল বিষয় থেকে সরকার সরে আসছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো যাচ্ছে না।

যানজট কমছে না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি বাড়ছে। বিপক্ষ মতকে সরকার সহ্য করতে অপারগ হয়ে উঠছে। বিদ্যুৎ বিষয়ে সরকার এখনো দৃশ্যমান কোনো সাফল্য আনতে পারেনি। পঞ্চমত : ছাত্রলীগের দুষ্কৃতকারীদের সরকার প্রশ্রয় দিচ্ছে।

অন্যদিকে প্রশাসনে অস্থিরতা এবং আত্মবিশ্বাসহীনতার জন্ম দিচ্ছে। যমুনা গ্রুপের অবৈধ বিল্ডিং ভাঙার বিষয়ে সরকারের যে আইনি ক্ষিপ্রতা, মাহামুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে সমগ্র আওয়ামী লীগের যে তৎপরতা সেই ক্ষিপ্রতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না সরকার সমর্থক সন্ত্রাসীদের নির্মূলের ক্ষেত্রে। ১০. সরকার যা করতে পারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যা ও নৃশংসতার সঙ্গে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, যারা মদদদাতা, যারা পরিকল্পনাকারী, রগ কাটা- লাশ ম্যানহোলে ফেলাসহ সকল পৈশাচিক বর্বরতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করা খুব জরুরি। এই চিহ্নিত হত্যাকারীদের বিচার যাতে হয়, আইনের ফাঁক গলে, আত্মীয়তা কিংবা টাকার জোরে খুনিরা যাতে রেহাই না পায় সেই ব্যবস্থা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে প্রশাসনের দুর্বলতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাহের হত্যার আসামি শিবির নেতা সালেহী খালাস পেয়েছে।

এবারো সেই অবস্থার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। জামায়াতের বিরুদ্ধে সরকার যে সত্যি সত্যিই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে চায় তা প্রমাণের জন্য সরকারকে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নেয়া দরকার। যোগ্যতর কৌশলীদের মাধ্যমে তথ্য, প্রমাণের বিষয়ে যারা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে তাদের সবার সাহায্য নেয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে একটি সুসমন্বয় থাকতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজে সাফল্য আনতে আইনজীবী নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষুদ্র দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে।

এই সরকারের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম সহ বিভিন্ন স্থানে যে ছাত্রহত্যা হয়েছে সে বিষয়ে সরকারকে নিরপেক্ষ আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। সকল হত্যার খুনিদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগরীতে বেশ ক’টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে সরকার নিস্পৃহ হলে তা আরো বাড়তে থাকবে। সময় থাকতে তাই এ ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

শিক্ষাঙ্গনে সাম্প্রতিক হত্যা ও সন্ত্রাসকে উপলক্ষ করে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেষ্টা চলতে পারে। সকল অগণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই চেষ্টা চলেছে। বর্তমানেও একটি মহল তা চাইবে। এ কারণে সরকার শিক্ষাঙ্গনে সংঘটিত সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। প্রতিটি হত্যাকা-, সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে সরকার যে নিরপেক্ষ এবং সত্যি সত্যিই যে খুনিদের বিচার চায় সেই আলামত সরকারকে রাখতে হবে।

ছাত্রলীগের বর্তমান কর্মকা- সম্পর্কে সরকারের সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা, অপকর্ম থেকে দূরে রাখার ব্যাপারে সরকার যে আন্তরিক সেই বিষয়টি জনমানুষ যাতে দেখতে পায় তার প্রামাণ্য কার্যক্রম নেয়া দরকার। সরকারের কাজে গোয়েন্দা নির্ভরতা বাড়ছে। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার। কেননা শুধু ওই চ্যানেলেই নির্ভরতা ১৯৭০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো ভালো ফল আনেনি।

শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় এসেছে। সরকারের দলীয় ও রাজনৈতিক চ্যানেলকেও কাজে লাগানো দরকার। সে ক্ষেত্রে দল ও সরকারের দূরত্ব কমানো উচিত। দলের নেতাদের অধিকতর দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। জনগণের কাছে দেয়া সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের বড় দায় এখন সরকারের কাঁধে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কথিত চুক্তি ও সমঝোতা বাস্তবায়ন কাজটিও বেশ কঠিন। সে ক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিঘিœত হলে বিরোধী দলকে সংসদে এবং সংসদের বাইরে সঙ্গী না করতে পারলে সরকারের একার পক্ষে এই কাজগুলো করা দুরূহ হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য সরকারের আরো সুস্থির, স্থিতধী, বুদ্ধিপ্রবণ, দূরদৃষ্টিভঙ্গিময় নেতৃত্ব দরকার। একটি লিবারেল মডারেট মুসলমান দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তৈরি করা এবং তা ধরে রাখার কাজটিকে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বর্তমান সরকার যত সহজ ভাবছেন আদৌ তা তত সহজ কিনা সেই প্রশ্ন থাকছেই। লেখাটি শেষ করছি, ভারতের বিখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার 'গালফ নিউজ'-এ India must not Bangladesh down' শীর্ষক যে নিবন্ধটি লিখেছেন (প্রকাশিত ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০) তার শেষ প্যারাটি দিয়ে, 'I am keeping my fingers crossed because Hasina's style of governance has a touch of authoritarianism. Indira Gandhi had the same trait and India had to pay the price during the two-year-rule of emergency. Hasina appears at times too impatient, too impressionable and too impetuous. She has more to fear from herself, rather than the hapless opposition.' সুত্র: http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=2681


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।