তোকে দেখিনা, কতো হাজার বছর হয়ে গেলো...
প্রথম পর্ব
... ঘুমের কোনো সুযোগই সেখানে নেই। পুরো রুমে বাতী জ্বালানো।
রুমে রাখা পনের বিশটা চেয়ারের দুইটাতে বসে পড়ে ওরা। রাত তখন দুইটা বেজে গেছে প্রায়। এগারোটা পনের থেকে প্রায় দুইটা।
এই সময়টুকুতে ওরা দেখেছে রাতের ঢাকা। দেখেছে লোডশেডিংয়ের দেশে বিদ্যুৎ অপচয়ের হাজারটা আয়োজন।
অভ্যর্থনা কক্ষের চেয়ারে বসে এক রকম চুপ করেই থাকে ওরা দু’জন। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে মামুন। কিন্তু নিবিড়ের চোখে ঘুম নেই।
এই শহরের বিভিন্ন ভাবনারা অনেক কষ্টের অনূভুতি নিয়ে ওর মনে ভীড় করে। ও ভেবে পায়না- বাড়ীওয়ালা কীভাবে পারলো এই রাতে নিজের ভাড়াটিয়াকে ঘর থেকে বের করে দিতে? তার বিবেক কি একটু বাঁধাও তাকে দিলোনা?!
দারোয়ান খুব জোরে জোরে কথা বলছে।
নিবিড়ের ভাবনায় ছেঁদ পড়ে। ও বাইরে গেটের কাছে যায়। দেখে- এক মহিলা ভিক্ষুককে ধমকিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে দারোয়ান।
মহিলাটার কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা শিশু। দেখে মনে হচ্ছে বয়সটা বছরও পূর্ণ হয়নি।
মহিলাটার জন্য মায়া লাগে নিবিড়ের। তারপর মহিলাটা চলে যাবার পরে খুব স্বাভাবিকভাবেই সে তার কথা ভুলে যায়। ওর খুব ইচ্ছা হয় রাতের ঢাকাকে আরো কিছুক্ষণ খুব কাছে থেকে দেখতে।
ও গেটের বাইরে চলে আসে। কিন্তু ইচ্ছাটা পূরণ হয়না তার; দারোয়ান ওকে না করে বলে-
: ওই মিয়া, কোত্থেইকা আইছেন? রাইত থাকতে দিছে, ভদ্রলোকের মতো রাইতটা থাইকাই কাইটা পইড়েন। অহন বাইরে না গিয়া চুপ কইরা ভিতরে গিয়া বইসা থাকেন…
দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নিবিড়। ওর হাসিটাই দারোয়ানের কাছে ধমকে মতো লাগে। সে অবাক হয়।
ভাবে কে এ?
নিবিড় ভিতরে চলে আসে।
মামুন ঘুমুচ্ছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে নিবিড়ের অনেক দিন আগের কথা মনে পড়ে। যেই দিনগুলোতে ওরা প্রতিটি মুহুর্তে এক সাথে থাকতো। ভোর ঘুম থেকে উঠার পর এক সাথে নাস্তা, তারপর এক সাথে গোসল-ক্লাস।
বিকেলে এক সাথে আড্ড। আর রাতে এক সাথে এক বিছানায় ঘুম। আর এখন…
রিসিপশনিষ্ট দিপা হঠাৎ করেই নিবিড়ের পাশে দাঁড়ায়। বলে-
: আপনার নামটা যেনো কী বললেন..?
: নিবিড়। ছোট্ট বলে ও।
: চা-কফি কিছু খাবেন?
নিবিড় হা-না কিছু বলেনা। দিপা চলে যায় এবং ফিরেও আসে খুব তাড়াতাড়ি। সাথে নিয়ে আসে দুই কাপ চা। এক কাপ নিজের কাছে রেখে আরেক কাপ নিবিড়কে দেয় সে। তারপর নিবিড়ের পাশের চেয়ারে বসে দিপা বলে-
: নিবিড়, জানেন- জীবনটাকে মাঝে মাঝে খুব একঘেয়ে মনে হয়।
সারাটাদিন হাই-হ্যালো করা, পরিচিত-অপরিচিত সবার সাথে কেমন আছেন-ভালো আছেন বলাটা কার-ই বা বৈচিত্রপূর্ণ মনে হয়..!
এতোটুকু বলেই দিপা হাসে। একা একাই হাসে। তারপর আবার-
: হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় আমি রবোট হয়ে গেছি! এই দেখেন না, আপনাকে চিনিনা-জানিনা অথচ এমনভাবে কথা বলছি যেনো আপনি আমার খুব চেনা।
চায়ের কাপে শেষ দুইটা চুমুক দিয়ে দিপা আবার বলে-
: নিবিড়, বিরক্ত হচ্ছেন না তো!
অনেকক্ষণ পর কথা বলে নিবিড়-
: না না, বিরক্ত হবো কেনো?
: না, অনেকেই আবার বিরক্ত হয়। সাধারণ একজন রিসিপশনিষ্টের সাথে কথা বলতে আপনার দ্বিধা লাগতেও পারে।
তাই বললাম আর কি..!
দুই একবার হাঁ-হুঁ ছাড়া নিবিড় তেমন কথাই বলেনা। দিপাই শুধু বলে যায়।
এই গভীর রাতেও হঠাৎ ফোন আসে। দিপা প্রায় দৌড়ে যায়। ফোনটা না ধরেই আবার চলে আসে।
বলে-
: নিবিড় সাহেব, উপর তলা থেকে আমাদের এক ডাক্তার ফোন দিয়েছেন। আমি আর থাকতে পারছিনা…
বলেই দিপা উপরে চলে যায়।
শুরু থেকে এতকক্ষণ পর্যন্ত ভালোই লেগেছিলো মেয়েটাকে। কিছু জানতেও মন চাচ্ছিলো তার সম্পর্কে। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই নিবিড়ের ভাবনায় আর মেয়েটার অস্তিত্ব থাকেনা।
০৪
সকাল আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও দিপার দেখা মেলেনা। একটা ধন্যবাদ বা একটু কৃতজ্ঞতা তাকে না জানালে কেমন দেখা যায়! কিন্তু অপেক্ষার পরেও না পাওয়া গেলে আর কী করা!
ওরা চলেই আসে।
এতো সকালে ঢাকার রাস্তা কখনোই দেখেনি নিবিড়। সবই তাই নতুন লাগে ওর কাছে। নতুন লাগে ফুটপাথগুলোকেও।
অথচ গতকালই ও এ পথে হেঁটেছে! নতুনত্ব কী তা খুঁজে পেতে খুব বেশি সমস্যা হয়না নিবিড়ের। এখন ফুটপাথে শুয়ে আছে বাস্তুহারা- নিঃস্ব মানুষ। গতকাল যা ছিলোনা।
নিবিড় জানতো ঢাকায় এমন মানুষ অনেক। কিন্তু ও জানতো না- এই অনেকের সংখ্যাটা কতো।
মানুষগুলোর জন্য ওর হৃদয়ের ভিতরটা হাহাকার করে উঠে। কী কষ্টের জীবন এই শহরে!
হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাসায় পৌছে যায়। যে বাসা থেকে গতরাত বের হয়ে যেতে হয়েছিলো- সেই বাসায়। বাড়ীওয়ালার মেহমান মামুনের রুমটা একেবারে এলোমেলো করে গেছে। মামুনের মেজাজটা খারাপ হয় খুব।
কিন্তু এই শহরের কঠিন বাস্তবতার কাছে অসহায় হয়ে থাকে ও। কিচ্ছু করার থাকেনা।
গতকাল যে বন্ধুদের আসার কথা ছিলো আজ আবার তাদেরকে আসতে বলে নিবিড়। খুব সকালেই বলে। জ্যামের শহর ঢাকাতে আজও তারা ঠিক সময়ে আসতে পারবে কিনা, সে আশঙ্কা থেকেই যায়।
দু’জন মিলে ঘর গুছিয়ে নাস্তা করতে বেরোয় ওরা।
তিনটা করে রুটি আর অল্প একটু সবজি, এতেই নাস্তা শেষ। নিবিড় মামুনকে এবং মামুনও নিবিড়কে আরো কিছু খেতে বলে। কিন্তু কেউ-ই আর কিছু খায়না। বরং দ্রুত উঠে বিল দিতে যায়।
মামুন বলে আমি দিব, আর নিবিড় বলে-না না, বিল আমি দিবো…
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।