তমা ভেবেছিল কখনো কাউকে জানাবে না। কিন্তু জানাতে হয়েছিল। রাত সাড়ে দশটার দিকে প্রিয়ন্তী ফোন করল। একদমই কথা বলতে ইচ্ছা না হলেও তমাকে স্বাভাবিকভাবেই ফোন ধরতে হল। প্রিয়ন্তী ফোন ধরে বলে, '‘কিরে তমা, শরীর কেমন? তুই কি বলতো, এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে তুই কিনা অনুষ্ঠানের দিন অসুস্থ হয়ে পড়লি?’'
‘'তোকে কে বলল আমি অসুস্থ?'’ সাবধানী গলায় বলল তমা।
প্রিয়ন্তী অবাক, '‘কেন? আঙ্কেল সকালে ফোন করে বলল যে তোর শরীর খুবই খারাপ, জ্বর। তুই আসবি না কলেজে। '’
‘'আব্বা বলছে?'’ তমা অবাক হয়ে যায়। আব্বাতো ঢাকাতেই নাই। অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে গেছে।
একটু ভেবে বলে, '‘আচ্ছা প্রিয়ন্তী শোন, তুই একটু বাসায় আসিস কালকে। আর শোন, বাসায় বলিস না যে আমি আজকে যাইনি। এমন ভাব করবি যে আমি গেছি। '’
‘'তমা, তুই কোথায় ছিলি আজকে?’'
‘'তুই বাসায় আয় তারপর কথা বলবো। এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।
আচ্ছা রাখি। '’ ফোন রেখে দেয় তমা। শরীর ভেঙে আসছে। রাতে কিছুই খেতে পারে নি। মুখে তুলতে পারেনি কোন খাবার।
গিয়ে শুয়ে পড়ে। আবার চোখ ভরে পানি আসতে থাকে। তমা কাঁদে, যত কান্না আছে সারাজীবনের ও বোধহয় একদিনেই শেষ করে ফেলে। মাথা ভারী হয়ে আসে কাঁদতে কাঁদতে। ঘুমাতে চেষ্টা করে তমা, কিন্তু ঘুম হয় না।
একটু চোখ লেগে আসলেও কিছুক্ষণ পর পর ঘুম ভেঙে যায়। তমা আতঙ্কিত হয়ে উঠে। এভাবেই কেটে যায় সারারাত। ভোরের দিকে একটু চোখটা লেগে আসে। দশটায় আম্মা ডেকে তোলে।
মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, ভারী হয়ে আছে, সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। তমা টের পায় জ্বর এসেছে ভীষণ। আম্মার জোরাজুরিতে শোয়া থেকে উঠে। মুখহাত ধুয়ে নাস্তা করতে বসে। আম্মা বকবক করতে থাকে, ‘একদিন একটা অনুষ্ঠান কইরাই অসুস্থ হইলে কেমনে হবে? আর রাত্রে এতক্ষণ ধইরা গোসল করলি।
কয় ঘন্টা ছিলি বাথরুমে হিসাব আছে? খাওয়া শেষ কর। ওষুধ খাইয়া নিস। ’
তমার কোন কথা সহ্য হয় না। খাওয়া শেষ না করেই উঠে আসে টেবিল থেকে। আম্মা পিছন থেকে চিৎকার করে, '‘কিরে তমা, খাওয়া শেষ করলি না?’'
তমা দরজা বন্ধ করে দেয় ঘরের।
একটা কাঁথা নিয়ে আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। বারটার দিকে প্রিয়ন্তী আসে বাসায়। আম্মা প্রিয়ন্তীর কাছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করল অনুষ্ঠান কেমন হয়েছে, সবাই শাড়ি পরেছে কিনা, ছবি তোলা হয়েছে কিনা। প্রিয়ন্তী বুদ্ধিমতী, ও খুব সহজেই পুরো ব্যাপারটা সামাল দেয়। কিছুক্ষণ পর তমা ওকে নিয়ে ঘরে চলে আসে।
প্রিয়ন্তী এইবার প্রশ্ন করে, '‘কি হইছে তমা? কই ছিলি কালকে?’'
‘'প্রিয়ন্তী'’, ফুপিয়ে উঠে প্রিয়ন্তীকে জড়িয়ে ধরে তমা। কাঁদতেই থাকে ফুলে ফুলে। প্রিয়ন্তী শক্ত করে ধরে থাকে তমাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করে, '‘কি হইছে বলবি না?'’
‘'প্রিয়ন্তী, মারুফ......’'
‘'মারুফ? কি করছে মারুফ?'’ তমা মাথা নাড়ে শুধু, কথা বলে না। প্রিয়ন্তী দুহাতে কাঁধ ধরে সোজা করে তমাকে।
তাকায় চোখের দিকে। কঠোর গলায় বলে, '‘তমা, ঠিক করে কথা বল। কি করছে মারুফ?’'
তমা ধীরে ধীরে খুলে বলে সবকিছু। শুনতে শুনতে প্রিয়ন্তীর মুখ শক্ত হয়ে উঠে। ‘'তুই আন্টিকে বলছিস?'’
তমা মাথা নাড়ে।
‘'কেন তমা? তুই চাস না ওর শাস্তি হোক? ছেড়ে দিবি?'’
‘'প্রিয়ন্তী, এখন এইভাবে বলে তো কিছু হবে না। সেইরকম একটা সালিশ হবে। দুই-একটা চড়-চাপর, তারপর আবার যে কে সেই। দেখলি না গতবার! আর আমার অবস্থা হবে ভয়াবহ। ঘর থেকে বের হওয়াই অসম্ভব হয়ে যাবে।
আর ওই সালিশটার পরে আব্বাকে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে পড়তে হইছিল। সবাই অনেক কথা শুনাইছিল। আব্বা বাসায় এসে আম্মার সাথে রাগারাগি করতো। আমি চাই না আমার জন্য আব্বা-আম্মার কোন সমস্যায় পড়তে হয়। ’'
প্রিয়ন্তীর কেমন দিশেহারা চেহারা হয়ে যায়।
'‘তাই বলে তুই ছেড়ে দিবি! এত বড় একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছুই বলবি না? আর তাছাড়া তুই না বললেই যে গোপন থাকবে এটা ভাবতেছিস কেন? ওরা তো ঠিকই বলে বেড়াবে। ’'
‘'ওরা বলে বেড়ালে অস্বীকার করলেই হবে। ঝামেলা হবে কিন্তু আমি স্বীকার করার চেয়ে কম। '’
‘'কিন্তু তুই ছেড়ে দিচ্ছিস কেন তমা? আমি তো এটাই বুঝতে পারতেছি না। ’'
‘'ছেড়ে দিচ্ছি না প্রিয়ন্তী।
আমি আমার আব্বা-আম্মাকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাইতে চাইতেছি। আমি ওকে কোনদিন ছাড়বো না। ’'
‘'তমা আমি মানতে পারতেছি না তোর কথা। অন্যায়ের শাস্তি সাথে সাথেই হওয়া দরকার। তুই এখন ওকে ঝেড়ে দিলে ও সুযোগ পেয়ে যাবে আরো অন্যায় করার, তোকে আরো জ্বালাবে।
কে বলতে পারে আবার তোকে তুলে নিয়ে যায় কিনা। ভাবতে পারে তোর যখন কোন বিকার নাই তারমানে তুই রাজী। ’'
তমা শিউড়ে উঠে প্রিয়ন্তীর কথা শুনে। আস্তে আস্তে ঘোরের মধ্যে মাথা নাড়ে, ‘'আমি মরে যাবো তাইলে, ঠিক মরে যাবো। ’' ফুপিয়ে উঠে।
‘'তমা এইটা তো কোন সমাধান না। কান্নাকাটি করিস না। শরীর খারাপ হয়ে গেছে। দেখি, আবারতো জ্বর আসছে। ’' তমার কপালে হাত দিয়ে উদ্বিগ্নভাবে বলে প্রিয়ন্তী।
তমা শুয়ে পড়ে বিছানায়। দুর্বল গলায় বলে, '‘প্রিয়ন্তী, তুই বাসায় যা। ফোনে কথা বলবো। ’'
‘'তুই কলেজে আসবি না?'’
‘'হুম, শরীরটা একটু ভাল হোক। ’'
প্রিয়ন্তী উঠে যেতে থাকে।
তমা হাত ধরে ফেরায় ওকে। অসহায় মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মত করে বলে, ‘'বান্ধবী, তুই আমার সাহস হবি?'’
প্রিয়ন্তী নিচু হয়ে তমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর মনে পড়ে যায়, '‘আচ্ছা, কালকে কে আমাকে ফোন করছিল বলতো?’'
‘'আমি জানি না প্রিয়ন্তী। ওরা জানতো আমি কখন বাসা থেকে বের হব, কোথায় যাবো। কিভাবে সম্ভব? আর তুই কি শিওর যে আব্বা ছিল? এটা কিভাবে হয়?’'
‘'আমি বুঝি নাই গলা।
ভারী ভারী। ’ থেমে একটু ভাবে, ‘আমরা ওইদিন আসার পথে ঠিক করতেছিলাম কে কই থাকবো, কি করবো। নিশ্চয়ই ওরা শুনছে এটা। আর তারপরে আমাকে ফোন করছে, যাতে আমি আর তোর বাসায় ফোন না করি। কত্তবড় হারামী!’'
‘'ঠিক আছে, তুই রেস্ট নে।
কান্নাকাটি করিস না। সুস্থ হয়ে আয়। মারুফকে কঠিন একটা শাস্তি দিতে হবে। জীবনের জন্য যেন শিক্ষা হয়ে যায়। ’' তমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় প্রিয়ন্তী।
চলবে........
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।