আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি চন্ডীদাস ও মানবতাবাদ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

It is better to will the good than to know the truth. Francesco Petrarca. যে ক’জন কবিকে নিয়ে বাঙালি গর্ব বোধ করে চতুর্দশ শতকের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস তাদের মধ্যে অন্যতম। চন্ডীদাস বিশ্বাস করতেন : “ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ” এই রকম বিশ্বাস সে যুগে অত সহজ হয়নি।

কারণটি সহজেই অনুমেয়। চতুর্দশ শতকের বাংলায় দেবতার স্থান ছিল মানুষের উপর কাজেই, দেবতারে টেনে মানুষের নীচে নামিয়ে আনাটা চাট্টিখানি কথা না। ভাবছি, চন্ডীদাস এমন আধুনিক মানবতাবাদী বিশ্বাসের উৎস কি? সে উত্তরের খোঁজে চন্ডীদাস এর জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। চন্ডীদাস-এর সময়কাল আনুমানিক ১৪১৭-১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দ। এবং তাঁর জীবনে এক অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল।

যে রকম ঘটনা সচরাচর অনেকের জীবনে ঘটে না। চন্ডীদাস ছিলেন গ্রামের এক মন্দিরের পুরোহিত। গ্রামের এক নীচু জাতের অস্পৃশ্য মেয়েকে ভালোবেসে পুরোহিত থেকে কবিতে পরিনত হয়েছিলেন চন্ডীদাস । চৈতন্যের এমন বিপ্লব বিস্ময়কর বৈ কী। তবে চতুদর্শ শতকের বাংলার বর্ণাশ্রমিক সমাজে হই হই রই রই পড়ে গিছল।

ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজপতিরা কবিকে একঘরে করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। লাভ হয়নি। আজ একুশ শতকে সেইসব সংকীর্ণমনা সমাজপতিদের নাম কেউই জানে না-অথচ চন্ডীদাস-এর এক সামান্য ভাবশিষ্য ‘কবি চন্ডীদাস ও মানবতাবাদ’ নামে ইন্টারনেট ব্লগ-এ নিবন্ধ লিখছে। এরও অনেক আগে বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস রচয়িতা দীনেশচন্দ্র সেন কবি চন্ডীদাস কে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতি লেখক’ বলে অবহিত করেছেন। (দ্র. ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ পৃষ্ঠা, ২১১) না।

চন্ডীদাস-এর উৎপীড়ণকারী সেই গ্রামীণ সমাজপতিদের কেউই আজ মনে রাখেনি। মানচিত্রে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা। এই জেলার নান্নুর গ্রামে চন্ডীদাস-এর জন্ম । দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন,‘ কেন্দুবিল্ব ও বিস্ফী হইতে নান্নুর শ্রেষ্ঠ তীর্থ। ’ (পৃষ্ঠা, ২১১) এই কথাটি কেন বলেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন? কেন্দুবিল্ব কোথায়? বিস্ফী-ই বা কোথায়? এ দুটির শব্দে কি তাৎপর্য? কেন্দুবিল্ব পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের একটি গ্রামের নাম, যে গ্রামে ১২ শতকে কবি জয়দেবের জন্ম হয়েছিল।

ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে তথা বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে জয়দেবের স্থান চিরস্মরণীয়। কেননা, জয়দেবই প্রথম দেবতার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষের দিকে তাকিয়েছিলেন। অধ্যাপক অধ্যাপক সুনীল চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “অলৌকিক দেবতাদের মানবীকরণের ইঙ্গিত তিনিই প্রথম দেন। ” ( প্রাচীন ভারতের ইতিহাস। ২য় খন্ড; পৃষ্ঠা, ৩৫৫) ...বিস্ফী হল মিথিলার সীতামারী মহকুমার একটি গ্রাম, যে গ্রামে মৈথিলী বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির (আনুমানিক, ১৩৭৪-১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে) জন্ম হয়েছিল।

বিদ্যাপতির সঙ্গে বাংলা কাব্যসাহিত্যের সম্পর্ক ঘনিষ্ট। তিনি মৈথিলী ভাষার শব্দের সঙ্গে বাংলা ভাষার শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ব্রজবুলি নামে এক উপভাষা সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক পদাবলী রচনা করেছেন। ব্রজবুলি ভাষায় পদাবলী বাংলায় ব্যপক প্রচলন ঘটেছিল। রবীন্দ্রনাথও বজ্রবুলি ভাষায় তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী থেকে পাঠ করা যাক: বসন্ত আওল রে ! মধুকর গুন গুন , অমুয়ামঞ্জরী কানন ছাওল রে ।

শুন শুন সজনী হৃদয় প্রাণ মম হরখে আকুল ভেল , জর জর রিঝসে দুখ জ্বালা সব দূর দূর চলি গেল । বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে জয়দেব ও বিদ্যাপতি-এই দু’জনের অবদান অপরিসীম । তাহলে দীনেশচন্দ্র সেন কেন বললেন, কেন্দুবিল্ব ও বিস্ফী হইতে (কবি চন্ডীদাস এর জন্মগ্রাম) নান্নুর শ্রেষ্ঠ তীর্থ কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে মানবতাবাদ সম্বন্ধে কিছু কথা বলে নিতে হয় । মানবতাবাদ মূলত একটি নৈতিক দর্শন যা কেবলমাত্র মানুষকেই অগ্রাধিকার দেয়, মানবীয় বিষয়গুলিকে প্রাধান্য দেয়। মানবতাবাদী ধ্যানধারণায় মানুষের বিবেচনা বোধ সম্মান যোগ্যতা গুরুত্ব পায়।

অতিপ্রকৃত শক্তির কাছে নতজানু না হয়ে মানবীয় আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়াই মানবতাবাদের একটি অন্যতম মূল সুর। সমাজের অপর মানুষের প্রতি কেবল নমনীয় অনুভূতি নয়-অযৌক্তিক একচ্ছত্র স্বগীয় কর্তৃত্বের অবসান কামনা করে মানবতাবাদ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে দার্শনিক থালেস ও জোনোফানেস এর চিন্তাভাবনায় গ্রিক মানবতাবাদের প্রাথমিক স্ফরণ লক্ষ করা যায় । ‘নিজেকে জান’-এ কথা সক্রেটিস নন, থালেসই প্রথম বলেছিলেন। আর জোনোফানেস? তিনি প্রচলিত ঈশ্বরবিশ্বাস অস্বীকার করে ঈশ্বরের স্থলে মহাবিশ্বের ঐক্যের মূলনীতিকে গ্রহন করে অ্যারিস্টোটলীয় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার পথটি সুগম করেছিলেন।

পরবর্তীকালে দার্শনিক অ্যানেক্সাগোরাস- যাঁকে প্রথম মুক্তচিন্তার দার্শনিক বলে অবহিত করা হয়ে থাকে, তিনি বিশ্বজগৎকে উপলব্ধি করবার পদ্ধতি হিসেবে বিজ্ঞানের নানা শাখায় অবদান রাখেন। এই আয়োনিয় (আয়োনিয়ার অবস্থান ছিল বর্তমান তুরস্কে) দার্শনিকগনই প্রথম ঘোষণা করলেন যে, অতিপ্রাকৃতের প্রভাব এড়িয়ে বিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়। অ্যানেক্সাগোরাস এর শিষ্য পেরিক্লিস গনতন্ত্রের অগ্রগতিতে, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। দার্শনিক প্রোটাগোরাস ও ডেমোক্রিটাস অজ্ঞেয়বাদের ধারণা প্রচার করেছিলেন। এঁরা অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস ব্যাতিরেকে এক ধরনের আধ্যাত্বিক নৈতিকতার ওপর আস্থা আরোপ করেছিলেন ।

ঐতিহাসিক থুকিডিডিস ইতিহাসের অধ্যয়নে যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহন করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে গ্রিক দার্শনিক এপিকিউরিয়াস বিশ্বজগতে একজন দয়াময় ঈশ্বরের উপস্থিতি সত্ত্বেও অশুভ কী ভাবে সম্ভব-এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি পারলৌকিক জীবনে অনাস্থা ও মানবকেন্দ্রিক জ্ঞানের পক্ষপাতী ছিলেন। এমন কী দার্শনিক এপিকিউরিয়াস নারীকেও জ্ঞানের তাঁর আথেন্সের পাঠশালায় অর্ন্তভূক্ত করেছিলেন। মানবকেন্দ্রিক দর্শন প্রাচীন ভারতেও গড়ে উঠেছিল; যা লোকায়ত দর্শন নামে পরিচিত।

এই দর্শনের অন্য নাম চার্বাক দর্শন। চার্বাক দর্শন অনুযায়ী মানবচৈতন্য গড়ে উঠেছে জাগতিক বস্তুর সম্মিলন থেকে এবং জগৎ স্বয়ংউদ্ভূত বলেই জগতের ঘটনাবলীকে পরিচালননার জন্য কোনও জগৎনিরপেক্ষ সত্তার প্রয়োজন নেই। পরবর্তীকালে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে প্রাচীন ভারতে পালি ভাষায় গৌতম বুদ্ধ অলৌকিক শক্তির অস্তিত্ব বিষয়ে নীরব থেকে সংশয় প্রকাশ করেন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট শতকে চিনে লাওৎ-সে ঈশ্বরহীন চিন্তার প্রকাশ করেন। কনফুসিয়াসও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় ব্রতী হয়েছিলেন।

তিনি লোকোত্তর ঈশ্বরের চেয়ে মানবীয় আচারআচরণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। মধ্যযুগের শেষে ইউরোপে রেঁনেসাকেন্দ্রিক মানবতাবাদ ছিল মূলত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন। ইউরোপীয় চিন্তাচেতনায় ঘোর কালিমার প্রলেপ পড়েছিল মধ্যযুগে । চেতনার এরূপ অন্ধকার দূর করতে সে সময়কার সত্যসন্ধ মননশীল শিক্ষাবিদেরা গ্রিক ধ্র“পদী গ্রন্থগুলি পাঠের আহবান জানান। মানবকেন্দ্রিক পঠনপাঠনে রোমানদের রচনাও অর্ন্তভূক্ত ছিল।

বিশেষ করে রোমান দার্শনিক সিসোরো। এই রোমান দার্শনিক লিখেছেন:‘ ব্যাকরণ চর্চা করে ভাষা শেখার পর ভাষাশিক্ষার দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয়। ভাষা শিক্ষার দ্বিতীয় পর্বের বিষয় ভাষার লালিত্য ও সৌন্দর্য। ভাষাচর্চার মূল উদ্দেশ্য হল ভাষার মাধ্যমে অন্যদের প্রভাবিত করা। সমাজের প্রতিটি নারীপুরুষের জীবন যাতে সুন্দর ও মঙ্গলময় হয়ে ওঠে সে লক্ষ্যেই ভাষার চর্চা করা যেতে পারে।

’ রোমান দার্শনিক সিসোরো এই কথাগুলি বলেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ১০৬ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩ এর মধ্যে। কেননা, ঐ সময়কালে বেঁচে ছিলেন সিসেরো। সিসেরোর এই মানবিক বক্তব্যের প্রতিধ্বনি তোলা জরুরি হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় অন্ধকার মধ্যযুগে। ইউরোপের অনেক চিন্তাবিদকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন সিসেরো। তাঁর মধ্যে অন্যতম ইতালিও পন্ডিত ফ্রানসেসকো পেটরাক; এঁর সময়কাল ১৩০৪-১৩৭৪ খ্রিষ্টাব্দ।

(এই লেখাটি বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস কে নিয়ে। আমাদের মনে রাখতে হবে চন্ডীদাস -এর সময়কাল আনুমানিক ১৪১৭-১৪৭৭ খ্রিস্টাব্দ। ) ফ্রানসেসকো পেটরাককেই ইউরোপীয় রেঁনেসার প্রাণপুরুষ মনে করা হয়। কেননা ফ্রানসেসকো পেটরাক একটি যুগান্তকারী উক্তি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: ‘ ইট ইজ বেটার টু উইল দ্য গুড দ্যান টু নো দ্য ট্রুথ।

’ তার মানে, সত্যকে জানার চেয়ে অপরের মঙ্গলকামনায় ব্রতী হওয়াই উত্তম। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপে পুরনো যুগের অবসান ঘটল। এই পরম মানবিক ধারণা ইউরোপকে বদলে দিল। পঞ্চদশ শতকেই ইতালিও ‘ইউম্যানিস্টা’ শব্দটি ইউরোপময় তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করল। সেই সঙ্গে ইউরোপীয় সমাজে ইতিহাস, কাব্য, নৈতিক দর্শন, রেটোরিক ও ব্যাকরণ চর্চা বৃদ্ধি পায়।

একজন লেখকের মতে, Since the 19th century, humanism has been associated with an anti-clericalism inherited from the 18th-century Enlightenment philosophes. কবি চন্ডীদাস এর জীবনেও এই অপার মানবতাবাদ এর প্রতিফলন দেখতে পাই। আগেই একবার বলা হয়েছে যে চন্ডীদাস-এর জন্ম পশ্চিম বঙ্গের বীরভূম জেলার নান্নুর গ্রামে । সেই নান্নুর গ্রামে ছিল একটি মন্দির। সে মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বাশুলি -স্থানীয় গ্রামীণ দেবী তিনি। সেই বাশুলি দেবীর মন্দিরে চন্ডীদাস প্রথম জীবনে পুরোহিত ছিলেন ।

বাশুলি দেবীর ভজনা করতেন পুরোহিত চন্ডীদাস। তখন একবার বলেছিলাম। চন্ডীদাস এর জীবনে এক অতি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল, যে রকম ঘটনা সচরাচর অনেকের জীবনে ঘটে না। নান্নুর গ্রামের এক রজকিনী (ধোপনী) বাস করত। রজকিনীর নাম রামী।

রামীর অন্য দুটি নাম- রামমনি ও রামতারা। রামীকে শ্রদ্ধাভরে শ্রীরামীও বলা হয়ে থাকে। শ্রীরাধিকা যেমন। ১৪ শতকে ধোপারা ছিল সমাজের অন্ত্যজ শ্রেনি। আজও।

গ্রামীন বাংলায় পদদলিত। পুরোহিতগন বরাবরই উচ্চশ্রেনিজাত। তা সত্ত্বেও কোনও এক পরম মুহূর্তে দু’চোখের মিলন হল। নান্নুর গ্রামের সদবংশজাত পুরোহিত চন্ডীদাস ও অন্ত্যজ ধোপনী শ্রীরামীর ভালোবাসা বিনিময় হল। চন্ডীদাস ছিলেন বৈষ্ণব।

তাঁর জন্মের দুশো বছর আগেই কবি জয়দেব তাঁর সুবিখ্যাত গীতগোবিন্দ কাব্যে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনীশক্তি স্বরূপিনী ব্রজ গোপিকা হিসেবে রাধাকল্পনা করেছেন। রামীর মধ্যে রাধাদর্শন করলেন পুরোহিত চন্ডীদাস । এটি বাইরের দিক। আসল কথা হল পুরোহিত চন্ডীদাস এক নিুবর্গীয়া কন্যাকে মর্যাদা দিলেন, পুরোহিত পদ পরিত্যাগ করে কবি হলেন; সমাজের নিরাপদ উচ্চকোটির আসন থেকে রজকিনীর হাত ধরে ধুলোমাটির পথে নেমে এলেন, চিরন্তন প্রেমের মধুর অভিঘাতে আপন জীবনের পুর্নজাগরণ ঘটালেন। যে কারণে দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে লিখেছেন,‘ কেন্দুবিল্ব ও বিস্ফী হইতে নান্নুর শ্রেষ্ঠ তীর্থ।

’ চতুদর্শ শতকেই কবি চন্ডীদাস নান্নুর গ্রামে মানবতাবাদের প্রতিষ্ঠা করলেন। এভাবে নান্নুর গ্রাম মানবতীর্থে পরিনত হল। ইতালিও পন্ডিত ফ্রানসেসকো পেটরাক-এর এক অবিস্মরনীয় বাণী সফল করেছেন। যিনি বলেছিলেন: ‘ইট ইজ বেটার টু উইল দ্য গুড দ্যান টু নো দ্য ট্রুথ। ’ চলুন নান্নুর যাই।

এ লেখার সূচনায় বলেছিলাম: যে ক’জন কবিকে নিয়ে বাঙালি গর্ব বোধ করে চতুর্দশ শতকের বৈষ্ণব কবি চন্ডীদাস (আনুমানিক ১৪১৭-১৪৭৭) তাদের মধ্যে অন্যতম। চন্ডীদাস বিশ্বাস করতেন : “ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ” পুরোহিত চন্ডীদাস ভালোবেসে বর্ণাশ্রমভিত্তিক বংশগৌরব ও কুল বিসর্জন দিলেন -কিন্তু তিনি কবি হয়ে উঠলেন কেন? এ প্রসঙ্গে রোমান দার্শনিক সিসোরোর ভাষাবিষয়ক সেই উক্তিটি পুর্নবার স্মরণ করি। ‘ ... ভাষাশিক্ষার দ্বিতীয় পর্বের বিষয় ভাষার লালিত্য ও সৌন্দর্য। ভাষাচর্চার মূল উদ্দেশ্য হল ভাষার মাধ্যমে অন্যদের প্রভাবিত করা।

সমাজের প্রতিটি নারীপুরুষের জীবন যাতে সুন্দর ও মঙ্গলময় হয়ে ওঠে সে লক্ষ্যেই ভাষার চর্চা করা যেতে পারে। ’ পরিশেষে এই তথ্যও ফাঁক করি। কবি স্বামীর সঙ্গ লাভ করে চন্ডীদাস-এর প্রেমিকা রামীও কবি হয়ে উঠেছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন এর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ থেকে শ্রীরমীর লেখা কবিতার চারটি চরণ উদ্ধৃত করি: ‘কোথাও যাও ওহে, প্রাণ-বঁধু মোর, দাসীরে উপেক্ষা করি। না দেখিয়া মুখ, ফাটের মো বুক, ধৈরজ ধরিতে নারি।

বাল্যকাল হতে, এ দেহ সপিঁনু , মনে আন নাহি জানি, কি দোষ পাইয়া মথুরা যাইবে, বল হে সে কথা শুনি। আচ্ছুৎ এক নিুবর্গীয়া দলিত নারীর এ কাব্য ফুল হয়ে ফুটেছিল মানবতাবাদী এক কবির মানবিক স্পর্শ আবহমান বাংলায়-এ কথা ভাবলে কী রকম শিহরণ ও উত্তাপ বোধ করি। উৎসর্গ: কবি মুক্তি মন্ডল।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     বুকমার্ক হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।