আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যন্ত্রণা-৯



কখন, কতক্ষন পরে জ্ঞান ফেরে তমা জানে না। মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা আস্তে আস্তে ওকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। খুব ধীরে ধীরে চোখ খোলে তমা। আবছা অন্ধকার একটা ঘর, গুমোট, ধূলার গন্ধ নাকে লাগে। মেঝেতে পাতা একটা চাটাইয়ে শুয়ে আছে তমা।

মাথাটা এত ভারী যে তুলতেই পারছে না। বাইরে অস্পষ্ট হল্লার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক কষ্টে উঠে বসে তমা। বসেই আঁতকে ওঠে। ওর গায়ের কাপড়গুলো খুলে নিয়েছে কেউ।

একটা সূতোও নেই গায়ে। আতঙ্কে সারা শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। ভয়, লজ্জা, ক্ষোভ, ঘৃণা চেপে ধরে ওকে। নিজেকে অনুভবের চেষ্টা করে ব্যাকুলভাবে। খুব খারাপের মধ্যেও একটুখানি স্বস্তি পায় এটা দেখে যে, না ও অক্ষত আছে।

দিশেহারার মত চারদিকে তাকায় ঘরের। ঘরের এককোণে দেখতে পায় ওর জামা-কাপড় আর ব্যাগটা রাখা। ধরমর করে উঠতে যায় তমা। কিন্তু পিছনে স্তূপ করে রাখা কতগুলো তেলের খালি টিন দুমদাম শব্দ করে পড়ে যায়। সাথে সাথে থেমে যায় বাইরের চিৎকার-চেঁচামেচি।

তমার বুকের ভেতরে হাফ ধরে ওঠে। দম বন্ধ করে বসে থাকে তমা। শুনতে পায় কে যেন আসছে। তাড়াহুড়ো করে এগোতে যায় ঘরের অন্য কোণায়। এমন সময় দরজাটা খুলে যায়।

মারুফ এসে ঢোকে ঘরে। কেমন অপ্রকৃতিস্থের মত দেখাচ্ছে ওকে। মুখে বিভৎস একটা হাসি। তমা দুহাতে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করে। আতঙ্কিত চোখে পালাবার পথ খোঁজে।

মাটি ভেদ হলেই হয়তো একমাত্র মাটির নিচে ও পালাতে পারতো। আর কোন পথ খুঁজে পায় না তমা। দরজা বন্ধ করে টলতে টলতে এগিয়ে আসে মারুফ। তমা বুঝতে পারে মদ খেয়েছে। পায়ে পায়ে পিছাতে থাকে তমা, কিন্তু একটা সময় থেমে যেতে হয়।

শেষ হয়ে গেছে ছোট ঘরটার সীমানা। পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। শয়তানের মত অট্টহাসি হাসতে হাসতে তমাকে জাপটে ধরে মারুফ, ‘বলছিলাম তুমি আমার হবা। আর কারো না। কথা শুনো নাই।

এখন? এখন তুমি আমার। ’ জড়ানো কথাগুলোর সাথে সাথে একটা বোঁটকা গন্ধ এসে লাগে নাকে। দম বন্ধ করে ফেলে তমা। প্রাণপনে ছাড়ানোর চেষ্টা করে নিজেকে। কিন্তু অসুরের শক্তিতে চেপে ধরেছে মারুফ।

কাঁদতে থাকে তমা, ছেড়ে দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করতে থাকে। মারুফের কোন বিকার হয় না। ধপ করে তমাকে নিয়ে পড়ে নিচে পাতা চাটাইয়ে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠে তমা। মারুফকে সরানোর জন্য অস্থিরভাবে হাত-পা ছুড়ে তমা।

খামচি দেয় মারুফের গালে-হাতে। ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় মারুফ তমার গালে। সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে তমা। কিন্তু একসময় আর পারে না। শরীরের শক্তি ফুরিয়ে যায়, হাল ছেড়ে দেয়।

অনুভব করে ওর নরম শরীরে মারুফের হিংস্র আগ্রাসন, দাঁতে কামড়ে ধরে ঠোঁট, কেটে বসে যায়, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পানি। তমা ক্ষত বিক্ষত হয়, বিদীর্ণ হয়, নিঃশেষিত হয়। অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ জানে না তমা টের পায় মারুফ এলিয়ে পড়েছে। বহুকষ্টে ঠেলে সরায় ওকে ওপর থেকে। উঠে বসে।

সারাশরীরে ব্যথা। মারুফের অচেতন দেহটা চিত হয়ে এলিয়ে আছে, ভারী একটা ঘরঘর শব্দ আসছে গলা দিয়ে। সেদিকে তাকিয়ে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠে তমার। পুরনো ভাঙা একটা ঘর, চারদিকে তাকাতেই একটা কোণাভাঙা কাঁচের টুকরো দেখতে পায় তমা। ভীষণ আক্রোশে ওটা তুলে নেয় তমা হাতে।

উঁচু করে ধরে, বসিয়ে দেবে মারুফের বুকে। কিন্তু কিছুতেই পারে না নামিয়ে আনতে। হাত কাঁপতে থাকে। ফেলে দেয় ভাঙা কাঁচটা হাত থেকে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ওঠে।

বুক ভেঙে যেতে থাকে তমার, এত অসহ্য কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে উঠে বসে তমা। ধুকে ধুকে এগিয়ে যায় ঘরের অন্য কোণায়, যেখানে ওর কাপড়গুলো রাখা। পরে নেয় একটা একটা করে। যতটা সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নেয়, যাতে বাইরে থেকে বোঝা না যায়।

বারবার মনে হচ্ছিল এটা লুকাতে হবে, কেউ যেন টের না পায়। নিজেকে গুছিয়ে কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে আসে তমা। একটা ভাঙাচোরা খুপরি, জংলামত একটা জায়গা। চিনতে পারে তমা, ওদের এলাকারই এক মাথায় একটা খালি প্লট, কেউ থাকে না এখানে, কেউ আসে না। আশপাশে তাকায়, কাউকে দেখতে পায় না।

মারুফের দলবল ওদের একা রেখে চলে গেছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে বড় রাস্তায় ওঠে তমা। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এতক্ষণে বোধহয় কলেজের অনুষ্ঠান শেষ হল। কারো সামনে পড়তে চায় না তমা।

একটা রিকশা নেয় বাসা পর্যন্ত। ঘরে ঢুকতেই আম্মার সামনে পড়ে যায়। আম্মা আঁতকে ওঠে, ‘কিরে কি হইছে তোর? চেহারার এই অবস্থা ক্যান?’ তমা কোনরকমে পাশ কাটায়, ‘কিছু হয় নাই আম্মা, অনেক টায়ার্ড লাগতেছে। ’ আম্মা তীক্ষèদৃষ্টিতে ওকে দেখে, ‘শাড়ি কই? শাড়ি পরস নাই?’ ‘পরছিলাম। আসার সময় চেঞ্জ করে নিছি।

’ বলেই রুমে ঢুকে যায় তমা, দরজা আটকে দেয়। সারা শরীরে একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি, চোখ ফেটে পানি আসছে। বাথরুমে ঢুকে যায় তমা। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে বসে থাকে নিচে। আর কাঁদতে থাকে অঝোরে।

চোখের পানি ঝর্ণার পানিতে মিশে ধুয়ে যেতে থাকে। তমার ভেতরটা খালি হয়ে যায়। বুকের ভেতরটা ভেঙে-চুরে যেতে থাকে। তমা বসেই থাকে শাওয়ারের নিচে, ধুয়ে ফেলতে চায় পুরো দিনটাকে সমস্ত শরীর থেকে, মন থেকে। কিন্তু পারে না।

কষ্টটা বাড়তে থাকে। ‘কেন? কেন? কেন?’ কোন উত্তর পায় না তমা। শুধু থেকে থেকে বুক ভাঙা কান্না আসতে থাকে। ................ ................... ..................... অনেকক্ষণ পরে তন্ময়ের ডাকে বর্তমানে ফেরে তমা। তন্ময় অস্থির গলায় বলে, ‘কি এত ভাবতেছো তুমি? কত কথা বললাম, কিছু শুনছো?’ বুকের ভেতর থেকে খুব সাবধানে চেপে রাখা একটা নি:শ্বাস ছাড়ে তমা।

বলে, ‘হ্যাঁ শুনছি। ’ তন্ময় খুব মুরুব্বীচালে বলে, ‘শুনো, কালকে থেকেই কিন্তু সব গোছগাছ করা শুরু করতে হবে। ’ ‘হুম করবো। আচ্ছা তুমি এখন যাও। আম্মার সাথে কথা বলবো।

’ হতাশ হয়ে উঠে যায় তন্ময়। তমাও ধীরে ধীরে ওঠে। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। আম্মা রান্না করছে। তমা আস্তে করে ডাকে, ‘আম্মা।

’ ‘হুমম, কিরে? কিছু বলবি?’ ঘাড় না ঘুরিয়েই জানতে চায় আম্মা। ‘তন্ময় কি বলতেছে আম্মা?’ ‘কি?’ ‘আমরা নাকি ওই এলাকায় যাইতেছি আবার?’ সামনের সপ্তাহেই?’ আম্মা একবার তাকায়। আস্তে করে বলে, ‘হ্যাঁ, তোর আব্বা ঠিক করল। ’ ‘তুমি কিছু বললা না?’ তমার মুখ কঠিন হতে থাকে। আম্মা ওকে ঠেলতে ঠেলতে রুমে নিয়ে আসে।

বিছানায় বসিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘কি বলবো তোর আব্বাকে? এইখানে কথা বলার লোকজন নাই। তোর আব্বার ভাল লাগে না। তোরা ছোট ছিলি, যাতায়াতের সুবিধা হইতো, তাই এইখানে আসছিলাম। এখনতো আর এইরকম কোন অজুহাত নাই। ’ ‘ও তারমানে তোমারও ইচ্ছা ওইখানে ফিরে যাওয়ার? তুমি বুঝ না কেন আমি যাইতে চাই না?’ ‘তোর আব্বা খবর নিছে ওরা নাই আর ওইখানে।

মারুফ চইলা গেছে আমেরিকায়। ’ চিৎকার করে ওঠে তমা, ‘আম্মা, ওই নামটা আমার সামনে বইলো না বললাম। ’ ‘মারে, কেন তুই এখনও এইসব ধইরা বসে আছিস? এতদিন হয়ে গেল!’ আম্মার গলা করুণ হয়ে ওঠে। ‘ধইরা বইসা আছি মানে কি? তুমি কি বল আম্মা? তুমি বুঝ না আমার কেমন লাগে!’ আম্মা ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু তমা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দেয়, ‘তুমি যাওতো আম্মা। আমার কথা বলতে ভাল লাগতেছে না।

তুমি যাও আমার রুম থেকে। ’ চোখে আঁচল চেপে সরে যায় আম্মা। তমার মাথা গরম হয়ে গেছে, দপদপ করছে। বুঝতে পারছে এখনই ব্যথা শুরু হবে। উঠে গিয়ে বাথরুম থেকে মাথায় পানি দিয়ে আসে।

মোছে না আর, চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে মুখে, গলায়, গায়ে। ভিজে যায় কাপড়। তমা কাঁদে না। শুধু অসহ্য একটা কষ্ট আর রাগে ফুসতে থাকে। জ্বালা করে উঠে চোখ।

দ্বিতীয়বার তমা আর ক্ষমা করবে না। হাতের কাছে পেয়েও যে সুযোগ হারিয়েছিল, তা এবার নিশ্চয়ই কাজে লাগাবে। ছেড়ে দেবে না মারুফকে। চলবে.........

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।