আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নক্সী-কাঁথার মাঠ - পল্লীকবি জসীমউদ্‌দীন (১)

মনের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবনাগুলোর মিলিয়ে যাওয়া দেখি। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘ হয়ে, ঐ দূর দিগন্ত পানে...

নক্সী-কাঁথার মাঠ রচয়িতা শ্রীমান্‌ জসীমউদ্‌দীন নতুন লেখক, তাতে আবার গল্পটি একেবারে নেহাৎই যাকে বলে-ছোট্ট এবং সাধারণ পল্লী-জীবনের। শহরবাসীর কাছে এই বইখানি সুন্দর কাঁথার মতো করে বোনা লেখার কতটা আদর হবে জানি না। আমি এইটিকে আদরের চোখে দেখেছি, কেন না এই লেখার মধ্য দিয়ে বাংলার পল্লী-জীবন আমার কাছে চমৎকার একটি মাধুর্য্যময় ছবির মতো দেখা দিয়েছে। এই কারণে আমি এই নক্সী-কাথাঁর কবিকে এই বইখানি সাধারণের দরবারে হাজির করে দিতে উৎসাহ দিতেছি।

জানি না, কিভাবে সাধারণ পাঠক এটিকে গ্রহণ করবে; হয়তো গেঁয়ো যোগীর মতো এই লেখার সঙ্গে এর রচয়িতা এবং এই গল্পের ভূমিকা-লেখক আমিও কতকটা প্রত্যাখান পেয়েই বিদায় হব। কিন্তু তাতেও ক্ষতি নেই বলেই আমি মনে করি, কেননা ওটা সব নতুন লেখক এবং তাঁদের বন্ধুদের অদৃষ্টে চিরদিনই ঘটে আসতে দেখেছি। শ্রী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩৬ জোড়াসাঁকো, কলিকাতা। এক *** বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ী মধ্যে ক্ষীর নদী, উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি। -রাখালী গান এই এক গাঁও, ওই এক গাঁও - মধ্যে ধু ধু মাঠ, ধান কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ।

এ-গাঁও যেন ফাঁকা ফাঁকা, হেথায় হোথায় গাছ; গেঁয়ো চাষীর ঘরগুলো সব দাঁড়ায় তারি পাছ। ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল-কায়া, ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় ঘরের মায়া। এ-গাঁও যেন ও-গাঁর দিকে, ও-গাঁও এ-গাঁর পানে, কতদিন যে কাটবে এমন, কেইবা তাহা জানে! মাঝখানেতে জলীর বিলে জ্বলে কাজল-জল, বক্ষে তাহার জল-কুমুদী মেলছে শতদল। এ-গাঁও ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে, জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে! কেউবা বলে-আদ্যিকালের এই গাঁর এক চাষী, ওই গাঁর এক মেয়ের প্রেমে গলায় পরে ফাঁসি; এ-পথ দিয়ে একলা মনে চলছিল ওই গাঁয়ে, ও-গাঁর মেয়ে আসছিল সে নূপুর-পরা পায়ে! এই খানেতে এসে তারা পথ হারায়ে হায়, জলীর বিলে ঘুমিয়ে আছে জল-কুমুদীর গায়। কেইবা জানে হয়ত তাদের মাল্য হতেই খসি, শাপলা-লতা মেলছে পরাগ জলের উপর বসি।

মাঠের মাঝে জলীর বিলের জোলো রঙের টিপ, জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ! বুকে তাহার এ-গাঁর ও-গাঁর হরেক রঙের পাখি, মিলায় সেথা নূতন জগৎ নানান সুরে ডাকি। সন্ধ্যা হলে এ-গাঁর পাখি এ-গাঁও পানে ধায়, ও-গাঁর পাখি এ-গাঁয় আসে বনের কাজল-ছায়। এ-গাঁর লোকে নাইতে আসে, ও-গাঁর লোকও আসে জলীর বিলের জলে তারা জলের খেলায় ভাসে। এ-গাঁও ও-গাঁও মধ্যে ত দূর - শুধুই জলের ডাক, তবু যেন এ-গাঁয় ও-গাঁয় নাইক কোন ফাঁক। ও-গাঁর বধূ ঘট ভরিতে সে ঢেউ জলে জাগে, কখন কখন দোলা তাহার এ-গাঁয়ে এসে লাগে।

এ-গাঁর চাষী নিঘুম রাতে বাশেঁর বাশীর সুরে, ওইনা গাঁয়ের মেয়ের সাথে গহন ব্যথায় ঝুরে! এগাঁও হতে ভাটীর সুরে কাঁদে যখন গান, ও-গাঁর মেয়ে বেড়ার ফাঁকে বাড়ায় তখন কান। এ-গাঁও ও-গাঁও মেশামেশি কেবল সুরে সুরে; অনেক কাজে এরা ওরা অনেকখানি দূরে। এ-গাঁর লোকে দল বাধিঁয়া ও-গাঁর লোকের সনে, কাইজা ফ্যাসাদ্‌ করেছে যা জানেই জনে জনে। এ-গাঁর লোকও করতে পরখ্‌ ও গাঁর লোকের বল, অনেক বারই লাল করেছে জলীর বিলের জল। তবুও ভাল, এ-গাঁও ও-গাঁও, আর যে সবুজ মাঠ, মাঝখানে তার ধুলায় দোলে দুখান দীঘল বাট; দুই পাশে তার ধান-কাউনের অথই রঙের মেলা, এ-গাঁর হাওয়ায় দোলে দেখি ও-গাঁয় যাওয়ার ভেলা।

দুই *** এক কালা দাতের কালি যা দ্যা কল লেখি আর এক কালা চক্ষের মণি, যা দ্যা দৈনা দেখি - ও কালা, ঘরে রইতে দিলি না আমারে। - মুর্শিদা গান এই গায়েঁর এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল, কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল। কাঁচা ধানের পাতার মত কচি-মুখের মায়া, তার সাথে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া। জালি লাউয়ের ডগার মত বাহু দুখান সরু, গা খানি তার শাঙন মাসের যেমন তমাল তরু। বাদল-ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল, বিজলী মেয়ে পিছলে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।

কচি ধানের তুল্‌তে চারা হয়ত কোনো চাষী, মুখে তাহার জড়িয়ে গেছে কতকটা তার হাসি। কালো চোখের তারা দিয়েই সকল ধরা দেখি, কালো দাতের কালি দিয়েই কেতাব কোরাণ লেখি। জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়; চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করছে জয়। সোনায় যে-জন সোনা বানায়, কিসের গরব তার' রঙ পেলে ভাই গড়তে পারি রামধণুকের হার। কালোয় যে-জন আলো বানায়, ভুলায় সবার মন, তারির পদ-রজের লাগি লুটায় বৃন্দাবন।

সোনা নহে, পিতল নহে, নহে সোনার মুখ, কালো-বরণ চাষীর ছেলে জুড়ায় যেন বুক। যে কালো তার মাঠেরি ধান, যে কালো তার গাঁও! সেই কালোতে সিনান্‌ করি উজল তাহার গাঁও। আখড়াতে তার বাঁশের লাঠি অনেক মানে মানী, খেলার দলে তারে নিয়েই সবার টানাটানি। জারীর গানে তাহার গলা উঠে সবার আগে, "শাল-সুন্দী-বেত" যেন ও, সকল কাজেই লাগে। বুড়োরা কয়, ছেলে নয় ও, পাগাল* লোহা যেন, রুপাই যেমন বাপের বেটা কেউ দেখেছ হেন? যদিও রুপা নয়কো রুপাই, রুপার চেয়ে দামী, এক কালেতে ওরই নামে সব গাঁ হবে নামী।

*পাগাল - ইস্পাত তিন *** চন্দনের বিন্দু বিন্দু কাজলের ফোঁটা কালিয়া মেঘের আড়ে বিজলীর ছটা - মুর্শিদা গান ওই গাঁখানি কালো কালো, তারি হেলান দিয়ে, ঘরখানি যে দাঁড়িয়ে হাসে ছোনের ছানি নিয়ে; সেইখানে এক চাষীর মেয়ে নামটি তাহার সোনা, সাজু* বলেই ডাকে সবে, নাম নিতে যে গোনা। লাল মোরগের পাখার মত ওড়ে তাহার শাড়ী, ভোরের হাওয়া যায় যেন গো প্রভাতী মেঘ নাড়ি। মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে, রাঙা ঠোটেঁর লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে। ফুল ঝর-ঝর জন্তি গাছে জড়িয়ে কেবা শাড়ী, আদর করে রেখেছে আজ চাষীদের ওই বাড়ী। যে ফুল ফোটে সোনের খেতেম ফোটে কদম গাছে, সকল ফুলের ঝলমল গা-ভরি তার নাচে।

*সাজু - পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো জেলায় বাপের বাড়িতে মুসলমান মেয়েদের নাম ধরিয়া ডাকা হয় না। বড় মেয়েকে বড়, মেঝ মেয়েকে মাজু, সেজ মেয়েকে সাজু এইভাবে ডাকে। শ্বশুরবাড়ির লোকে কিন্তু এ নামে ডাকিতে পারে না। কচি কচি হাত পা সাজুর, সোনায় সোনার খেলা, তুলসী-তলায় প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঁঝের বেলা। গাঁদাফুলের রঙ দেখেছি, আর যে চাঁপার কলি, চাষী মেয়ের রুপ দেখে আজ তাই কেমনে বলি? রামধনুকে না দেখিলে কি-ই বা ছিল ক্ষোভ, পাটের বনের বউ-টুবাণী*, নাইক দেখার লোভ।

দেখেছি এই চাষীর মেয়ের সহজ গেঁয়ো রুপ, তুলসী-ফুলের মঞ্জরী কি দেব-দেউলের ধূপ! দু-একখানা গয়না গায়ে, সোনার দেবালয়ে, জ্বলছে সোনার পঞ্চ প্রদীপ কার বা পূজা বয়ে! পড়শীরা কয় - মেয়ে ত নয়, হল্‌দে পাখির ছা, ডানা পেলেই পালিয়ে যেত ছেড়ে তাদের গাঁ। *বউ-টুবাণী - মাঠের ফুল এমন মেয়ে - বাবা ত' নেই, কেবল আছেন মা; গাঁওবাসীরা তাই বলে তায় কম জানিত না। তাহার মতন চেকন 'সেওই' কে কাটিতে পারে, নক্‌সী করা 'পাকান পিঠায়' সবাই তারে হারে। হাঁড়ির উপর চিত্র করা শিকেয় তোলা ফুল, এই গাঁয়েতে তাহার মত নাইক সমতুল। বিয়ের গানে ওরই সুরে সবারই সুর কাঁদে, "সাজু গাঁয়ের লক্ষ্মী মেয়ে" - বলে কি লোকে সাধে? চার *** কানা দেয়ারে, তুই না আমার ভাই, আরও ফুটিক ডলক* দে, চিনার ভাত খাই।

- মেঘরাজার গান *ডলক - বৃষ্টি চৈত্র গেল ভীষণ খরায়, বোশেখ রোদে ফাটে এক ফোঁটা জল মেঘ চোঁয়ায়ে নামলা না গাঁর বাটে। ডোলের বেছন* ডোলে চাষীর, বয় না গরু হালে, লাঙল জোয়াল ধুলায় লুটায় মরচা ধরে ফালে, কাঠ-ফাটা রোদ মাঠ বাটা বাটা আগুন লয়ে খেলে, বাউকুড়াণী* উড়ছে তারি ঘুর্ণী ধূলি মেলে। মাঠখানি আজ শূনো খাঁ খাঁ, পথ যেতে দম আঁটে, জন্‌-মানবের নাইক সাড়া কোথাও মাঠের বাটে; শুক্‌নো চেলা কাঠের মত শুক্‌নো মাঠের ঢেলা, আগুন পেলেই জ্বলবে সেথায় জাহান্নামের খেলা। দর্‌গা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নী আসে ভারে নৈলা গানের* ঝঙ্কারে গাঁও কান্‌ছে বারে বারে। তবুও গাঁয়ে নামলা না জল, গগনখানা ফাঁকা; নিঠুর নীলের পক্ষে আগুন করছে যেন খাঁ খাঁ।

উচ্চে ডাকে বাজপক্ষী 'আজরাইলে'র ডাক, 'খর-দরজাল' আসছে বুঝি শিঙায় দিয়ে হাঁক। *বেছন - বীজ। *বাউকুড়াণী - ঘূর্ণিবায়ু। *নৈলা গান - বৃষ্টি নামাইবার জন্য চাষীরা এই গান গাহিয়া থাকে। এমন সময় ওই গাঁ হতে বদনা-বিয়ের গানে, গুটি কয়েক আস্‌ল মেয়ে এই না গাঁইয়ের পানে।

আগে পিছে পাঁচটি মেয়ে পাঁচটি রঙে ফুল, মাঝের মেয়ে সোনার বরণ, নাই কোথা তার তুল। মাথায় তাহার কুলোর উপর বদনা-ভরা জল, তেল-হলুদে কানায় কানায় করছে ছলাৎ ছল। মেয়ের দলে বেড়িয়ে তারে চিকন সুরের গানে, গাঁয়ের পথে যায় যে বলে বদনা-বিয়ের মানে। ছেলের দলে পড়ল সাড়া, বউরা মিঠে হাসে, বদনা-বিয়ের গান শুনিতে সবাই ছুটে আসে। পাঁচটি মেয়ের মাঝের মেয়ে লাজে যে যায় মরি, বদনা হতে ছলাৎ ছলাৎ জল যেতে চায় পড়ি।

এ-বাড়ি যায় ও-বাড়ি যায়, গানে মুখর গাঁ, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে যেন রাম-শালিকে ছা। কালো মেঘা নামো নামো, ফুল-তোলা মেঘ নামো, ধুলট মেঘা, তুলট মেঘা, তোমরা সব ঘামো! কানা মেঘা, টলমল বারো মেঘার ভাই, আরও ফুটিল ডলক দিলে চিনার ভাত খাই! কাজল মেঘা নামো নামো চোখের কাজল দিয়া, তোমার ভালে টিপ আঁকিব মোদের হলে বিয়া। আড়িয়া মেঘা, হাড়িয়া মেঘা, কুড়িয়া মেঘার নাতি, নাকের নোলক বেচিয়া দিব তোমার মাথার ছাতি। কৌটা ভরা সিঁদুর দিব, সিঁদুর মেঘের গায়, আজকে যেন দেয়ার ডাকে মাঠ ডুবিয়া যায়! দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো। দেয়ারে তুমি নিষালে নিষালে নামো।

ঘরের লাঙল ঘরে রইল, হাইলা চাষা রইদি মইল; দেয়ারে তুমি অরিশাল বদনে ঢলিয়া পড়। ঘরের গরু ঘরে রইল, ডোলের বেছন ডোলে রইল; দেয়ারে তুমি অধরে অধরে নামো। ' বারো মেঘের নামে নামে এমনি ডাকি ডাকি, বাড়ি বাড়ি চল্‌ল তারা মাঙন হাঁকি হাঁকি। কেউবা দিল এক পোয়া চাল, কেউবা ছটাকখানি, কেউ দিল নুন, কেউ দিল ডাল, কেউবা দিল আনি। এমনি ভাবে সবার ঘরে মাঙন করি সারা, রূপাই মিঞার রুশাই-ঘরের* সামনে এল তারা।

রূপাই ছিল ঘর বাঁধিতে, পিছন ফিরে চায়, পাঁচটি মেয়ের রূপ বুঝি ওই একটি মেয়ের গায়! পাঁচটি মেয়ে, গান যে গায়, গানের মতই লাগে, একটি মেয়ের সুর ত নয় ও বাঁশী বাজায় আগে। ওই মেয়েটির গঠন-গাঠন চলন-চালন ভালো, পাঁচটি মেয়ের রুপ হয়েছে ওরির রুপে আলো। *রুশাই-ঘরের - রন্ধন শালার রূপাইর মা দিলেন এনে সেরেক খানেক ধান, রূপাই বলে, "এই দিলে মা থাকবে না আর মান। " ঘর হতে সে এনে দিল সেরেক পাঁচেক চাল, সেরেক খানেক দিল মেপে সোনা মুগের ডাল। মাঙন সেরে মেয়ের দল চল্‌ল এখন বাড়ি, মাঝের মেয়ের মাথার বোঝা লাগে যেন ভারি।

বোঝার ভারে চলতে নারে, পিছন ফিরে চায়; রূপার দুচোখ বিঁধিল গিয়ে সোনার চোখে হায়। (পরের পর্ব)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।