আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুই টাকার বিস্কুট ও ছেলেটা-শেষ পর্ব

এডিট করুন

দেখার বয়স ছেলেটার, ছেলেটা তাই শুধু দেখে। সে উপভোগ করে প্রতিটি ঘটনা। বড় রাস্তায় চলাচলকারী বাসগুলো যখন একরাশ ধুলো উড়িয়ে দিয়ে যায় ছেলেটা ধুলো থেকে বাচার জন্য নাক চেপে ধরে না। সে ঘ্রাণ নেয়, বাসের তেল পোড়া ধোয়ার ঘ্রাণ। তার ঘ্রাণ নিতে ভাল লাগে, বাসের ধোয়ার ঘ্রাণ, ধুলোর ঘ্রাণ, বৃষ্টির পরে ভিজে মাটি হতে উঠে আসা সোদা সোদা ঘ্রাণ।

ছেলেটার ফুসফুস এখন তাজা, পরিষ্কার, শক্তিশালী। জীবনের নোংরা ঘ্রাণ তখনও সেখানে খুব বেশী জমা হয়নি। তাই ধুলোবালি তার ফুসফুসকে কাবু করতে পারে না। ছেলেটা একা একা ঘোরে। ছেলেটার বাস যে এলাকায় সেখানে তার বয়সী আর কোন ছেলে নেই যার সাথে সে ঘুরতে পারে।

তাই তার পথচলা বন্ধুহীন, সরল। সেখানে কোন সম্পর্কের দায়ভার নেই, অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করার কোন বৃথা সময় নষ্ট নেই, আলোচনা করার মত কোন বাক্য খরচ নেই। আছে শুধু দুটি চোখ আর তার মস্তিষ্কের স্মৃতিকোষ। সে দেখে আর জমা করে, জমা করে আর দেখে। ছেলেটার বাবা মা প্রায়ই তাকে ভয় দেখায় ছেলেধরার।

ছেলেধরার প্রকোপ তখন খুব বেশী। ছেলেটা ভয় পায় না ছেলেধরায়। এত ঘুরবি না রাস্তায়, ছেলেধরা ধরব। না ধরব না। সরাসরি অস্বীকার করা।

ছেলেধরা তাকে ধরবে না বলে সরাসরি ঘোষনা দিয়ে দেয় সে। তর্ক শুরুর আগেই তর্ক সমাপ্ত। যেইদিন ধরবে সেইদিন বুঝবি। না ধরব না। ওরা ধইরা নিয়া যাইয়া তোরে পাচার কইরা দিব আরেক দেশে।

আর কোনদিন ফিরা আসতে পারবি না। আমি উলটা ওগোরে ধইরা মাইর দিমু। আমার গায়ে অনেক জোর। ধরলে বুঝবি কেমন লাগে, ওরা তোরে ধইরা উটের জকি বানাইব। ঊটের জকি কি? উটের পায়ের লগে বাইন্ধা দেয় উট দৌড়ানির সময় ছোট ছোট বাচ্চাগুলিরে।

বাচ্চাগুলি চিৎকার করে নির্মমভাবে আর উট সেই চিৎকার শুনে আরো জোরে দৌড়ায়, একসময় বাচ্চাগুলি মারা যায়। ছেলেটা ভেবে দেখে তেমন একটা খারাপ কিছু না উটের জকি হওয়া। সে যদি কখনও উটের জকি হয়েই যায় তবে বরং ভালোই হবে। উটের সাথে বেশ দৌড়ান যাবে। শুধু উটের পা ঠিকমত আকড়ে ধরতে হবে।

ছেলেটা চিন্তা করে সে উটের পা ধরে বসে আছে আর উট তাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। ছেলেটার রোমাঞ্চ বোধ হয়। তার খুব ইচ্ছে করতে থাকে উটের জকি হতে, পারলে সে এখনই উটের জকি হয়ে যেত। কোন নির্মমতা খুজে পায় না সে এতে, বরঞ্চ তার কাছে বিষয়টা ভালোই লাগে। সাধারণ জীবন যাপনে সে মাঝে মাঝে ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ওঠে।

রোমাঞ্চকর জীবন তাকে আকর্ষন করে খুব। সে ইচ্ছে হয় ছেলেধরাদের সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে উটের জকি হিসেবে যেন তারা সুযোগ দেয় এ ব্যাপারে অনুরোধ করতে। সন্ধ্যা বরাবরই এক গুমোট ভাব আনে। অনেকেই মসজিদের দিকে রওয়ানা দেয় ব্যাস্ত হয়ে, সকলেই এক ধরনের ব্যাস্ততার মধ্যে থাকে দিনের সন্ধিক্ষণে। আলো ও অন্ধকারের রুপান্তরের সময়টা সকলেই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যায়।

সন্ধ্যা হলেই দোকানগুলোতে জ্বালানো হয় আগরবাতি। দোকানের আগরবাতিগুলো রাখা হয় একটা পটে। পটটা তৈরী হয় কোন নারিকেল তেলের খালি ডিব্বা অথবা চায়ের দোকানের কোন ঘন দুধের ডিব্বা হতে। ডিব্বা ভরা থাকে চালে, সেই চালের মধ্যে গুজে দেওয়া হয় আগরবাতিগুলকে। একসময় দোকানে আগরবাতিগুলো পুড়ে শেষ হয়, পরিবর্তিত হয় একটুখানি নরম ছাইয়ে।

আগরবাতি পোড়া নরম ছাইগুলো পড়ে থাকে সেই চালের উপর। দিন দিন জমা হতে থাকে ছাই। কোন একদিন একটা ফু দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় ছাইগুলো, স্থান তৈরী করা হয় নতুন ছাইয়ের জন্য। ছোট ছোট অনেক দোকান যেগুলোতে খুটি হিসেবে বাশ ব্যাবহার করা হয় সেখানে মাঝে মাঝে বাশের গায়ে ছিদ্র কর থাকে আগরবাতি রাখার জন্য। আগরবাতি যেন এক অবিচ্ছেদ্য অংশ দোকানগুলর জন্য সন্ধ্যাকালীন সময়টাতে।

সন্ধ্যার গুমোট সময়টা শেষ হয়েছে কি হয়নি তা বোঝা যায় এ আগরবাতি হতেই। যখন দোকানগুল হতে আগরবাতির ধোয়ার শেষ সুবাসটাও মিলিয়ে যায় তখন বুঝতে হবে ত্রস্ত ব্যাস্ত গুমোট সন্ত্রস্ত সন্ধ্যা বিদায় নিয়েছে। সবাই এখন স্বাভাবিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে রাতের জন্য। ছেলেটা আগরবাতির শেষ সুবাসটুকু মিলিয়ে যাবার আপেক্ষায় থাকে। তার ঘ্রাণ শক্তি বড়ই কড়া।

জীবনের জটিলতায় সে ব্যাস্ত নয়। তাই সে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখে সময়ের উপর। সে জানে কখন সন্ধ্যা শেষ হয় আর পরিবর্তন হয় মানুষের মন। সে জানে কখন সবাই বিভিন্ন পাওনার হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য সন্ধ্যার দোহাই দেওয়া বন্ধ করে। ছেলেটা হাজির হয় তার বাবার কাছে।

বাবা আমার দুই টাকা দেও। নে তোর টাকা কিন্তু বিস্কুট খাইস না। ছেলেটা জানে বাবা এই কথাই বলবে। সে জানে বাবারা সবসময় চেষ্টা করে ছেলেদের চাপের মুখে রাখার জন্য। কারন বাবাদের একটাই ভয় ছেলে বার নষ্ট না হয়ে যায়।

না বিস্কুট খামু। না না। ছেলেটা দৌড় দেয় দোকানের দিকে। বিস্কুটের ডিব্বাটার দিকে তাকায়। হঠাৎ তার মনে হয় নাহ, বিস্কুট চারটা নয় দুটো কিনলে ভাল হবে।

আজকে চারটা কিনে খেয়ে ফেললে কালকে আর কিছুই খাওয়া যাবে না। কারণ বাবা প্রতিদিন তাকে বিস্কুট খাওয়ার জন্য দুই টাকা দেবে না। তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় সে এক টাকা খরচ করবে আর এক টাকা রেখে দিবে। ছেলেটা এক টাকা দিয়ে দুটো বিস্কুট কিনে। অবশিষ্ট এক টাকার নোটটা সে তার হাফ প্যান্টের পকেটে সযন্তে ঢুকিয়ে রাখে।

তারপর শুরু হয় তার বিস্কুট খাওয়ার নামে কৃচ্ছসাধন। সে একটু একটু করে একেকতা বিস্কুট খেতে থাকে। ছোট ছোট করে কামড় দেয় যাতে একবারে বেশী বিস্কুট তার মুখে না আসে। ছেলেটা বসে থাকে কোন একটা দেওয়ালের উপর পা ঝুলিয়ে। তার বা হাতের মুঠোয় যত্ন করে ধরে রাখা একটা বিস্কুট আর ডান হাতে যত্ন করে খেতে থাকা একটা বিস্কুট।

সে উপভোগ করে বিস্কুটের স্বাদ। ছেলেটার মা যখন তাকে একতা ডিম ভেজে দেয় তখনও সে এই কাজটি করে। একটু একটু করে খায় ডিমটা। ডিমও ছেলেটার খুব পছন্দের। কিন্তু একটা বেশী ডিম কখনই তার কপালে জোটে না।

তাই সে উপভোগ করে একটু একটু করে সময় নিয়ে ডিম খায়, বিস্কুট খায়। উপভোগের সময় দীর্ঘায়িত করতে চায় সে। কারণ এই বিস্কুট খাওয়া হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ বিনোদন, এ ছাড়া আর কোন বিনোদন তার নাগালের বাইরে। তাই খুব সতর্ক হয়ে সে তার বিনোদনের উপাদান খরচ করে যেন কমতি না পড়ে যায়, ফুরিয়ে না যায় খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।