আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল কামনা করাই ইসলামের শিক্ষা (জনৈক ব্লগারের প্রশ্নের উত্তরে লিখিত)

http://yousufsultan.com/

ব্লগার পাপ্রদজের প্রশ্নের সারাংশ হলো, অন্যান্য ধর্মের ন্যায় মুসলমানরা কি সমগ্র বিশ্বাবাসীর জন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষে মঙ্গল কামনা করতে আদিষ্ট নন, কিংবা, তাদের ধর্মগ্রন্থে কি তা নেই? যদি থাকেই, তাহলে সাধারণ মুসলমান না হোক, হুজুররাও কেন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল কামনা করেন না? তিনি এ বিষয়ে শুধু মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থের রেফারেন্সে বক্তব্য চেয়েছেন। বলেছেন, "আমি কোনো ধর্মীয় তর্কে যেতে চাই না, শুধু বিষয়টুকু কোরআন বা হাদীসের মতো মুসলিম ধর্মগ্রন্থে কি বলেছে সে বিষয়ে জানতে চাই। সাথে যদি আপনারা মুসলিম হিসেবে এ বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন সেটিও যদি বলেন, তাহলে খুশী হব। " আমাদের উত্তর: বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল কামনা করে আল্লাহর নামে শুরু করছি।

আপনার প্রশ্নের দুটো অংশ। ১. মুসলিম-অমুসলিম তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল কামনা করার ব্যাপারে মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থগুলো কী বলে? ২. ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে মঙ্গল কামনা করার কথা বলা থাকলে ধর্মীয় পণ্ডিতদের/হুজুরদের আচরণে তার প্রতিফলন নেই কেন? ইনশা'আল্লাহ আমরা আপনার প্রশ্নের উভয় অংশের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব। তবে শুরুতে ভূমিকা স্বরূপ কিছু কথা বলতে চাচ্ছি। ধরুন, আবীরের কোনো ভাই মাদকাসক্ত, কিংবা সে ধূমপান করে। আবীরের ভাইয়ের বাবা, মা এবং আবীরও -যদি সে তার ভাইয়ের কল্যাণকামী হয়ে থাকে- হবু বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার ভাইকে মাদক/সিগারেট পরিত্যাগ করতে বলবে।

সে তার ভাইয়ের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলে এই প্রার্থনা করবে যে, প্রভু, তুমি আমার ভাইকে তার এ বদঅভ্যাস পরিত্যাগ করতে সাহায্য করো। আবীর কখনোই তার ভাইয়ের দৃষ্টিতে তার মঙ্গল কোনটা- তা প্রার্থনা করবে না। কেননা, মাদকসাক্ত ব্যক্তির দৃষ্টিতে মাদকই সবচেয়ে বড় মঙ্গল। তাকে তা যত দিবেন, সে তত খুশি হবে, সুখ সে তত বেশি অনুভব করবে। তো, আবীর বা আবীরের বাবা-মা তাদের সন্তানের কল্যাণ প্রার্থনা করেন, কামনা করেন, কিন্তু তাকে মাদকাসক্ত দেখতে চাননা।

কারণ এর ভবিষ্যতে নিশ্চিত বিপদ রয়েছে, যা আবীর ও তার বাবা-মা তাদের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন। একজন মুসলমানের কাছে সবচেয়ে বড় কল্যাণ হল আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী হওয়া, মুসলমান হওয়া, হিদায়াত বা সুপথ প্রাপ্ত হওয়া। একজন মুসলমান মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, সে ছাড়া অন্য সকল ধর্মের মানুষ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পথহারা মানুষের মতো। কাজেই তাদেরকে পথ দেখিয়ে দেয়া, সুপথের প্রতি আহ্বান করাকে সে নিজের প্রধান দায়িত্ব জ্ঞান করে। সে বিশ্বাস করে, ইসলামের পথ ছাড়া অন্য সকল পথ কণ্টকময়।

আজ সে পথ ভালো দেখালেও কাল তাতে রয়েছে সমূহ বিপদ, যা সে তা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করতে পারে। পথহারা ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে বড় কল্যাণ যেমন সঠিক পথ পেয়ে যাওয়া, তেমনি অন্য ধর্মের কারো জন্য সবচেয়ে বড় কল্যাণ হলো ইসলামের ছায়াতলে আসা, সুপথ প্রাপ্ত হওয়া। একজন মুসলমানের বিশ্বাস এমনই। কাজেই, একজন মুসলমান যখন হাত তুলে অন্য ধর্মের মানুষের জন্য দোয়া করে, তখন সে তার হিদায়াতের জন্যই দোয়া করে। হিদায়াত পাওয়া বা মুসলমান হওয়াই তার দৃষ্টিতে একজন অমুসলিমের জন্য সবচেয়ে বড় কল্যাণ।

ভূমিকা ছেড়ে এবার আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিই। [এক] নবীজী স. এর জীবনী ঘাটলে এমন অনেক নজীর পাওয়া যাবে, যাতে তিনি মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও মানুষের জন্য মঙ্গল তথা হিদায়াত প্রার্থনা করেছেন। তন্মধ্যে নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করছি: ১. হযরত ওমর রা. ইসলাম গ্রহণের প্রাক্কালে নবী স. প্রার্থনা করেন, "হে আল্লাহ, তুমি ওমর কিংবা আবু জাহেল -এ দুইজনের একজনকে হিদায়াত দানের মাধ্যমে ইসলামকে সম্মানিত করো"। ( তিরমিযী: ৩৬৮১) ২. ওহুদের যুদ্ধে যখন কাফিররা নবীজীর স. দন্ত মোবার শহীদ করে দেয়, রক্ত বেয়ে পড়ে তাঁর মুখ থেকে, তখন তিনি প্রার্থনা করেন, "হে আল্লাহ! তুমি আমার জাতিকে ক্ষমা করে দাও। কেননা, তারা তো অবুঝ"।

(বুখারী: ৩২৯০) ৩. তায়েফ যুদ্ধের পর নবীজী স. কে বলা হল, আপনি সাকীফ গোত্রের জন্য বদ দোয়া করুন। নবী স. প্রার্থনা করলেন, "হে আল্লাহ! আপনি সাকীফ গোত্রকে হিদায়াত দান করুন। " (মুসনাদে আহমাদ, আর রাহীকুল মাখতুম) ৪. কুরাইশদের জন্য তিনি প্রার্থনা করেন, "হে আল্লাহ! আপনি কুরাইশদের হিদায়াত দান করুন"। (জামেয়ুল আহাদীস: ৫০৫৪) ৫. আবু হুরায়রা রা. সবসময় কামনা করতেন যেন তাঁর মা মুসলমান হয়ে যান। নবীজী স. এঁর কাছে তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

নবী স. প্রার্থনা করলেন, "হে আল্লাহ! আপনি আবু হুরায়রার মাকে হিদায়াত দান করুন। " এ প্রার্থনা শুনে আবু হুরারয়রা দ্রুত বাড়ির দিকে ছুটে গেলেন। দরজায় নক করলে মা বললেন, অপেক্ষা করো, গোসল সেরে নিই। গোসল সেরে এসে দরজা খুলে তিনি বললেন, আবু হুরায়রা, আমি ইসলাম গ্রহণ করলাম। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, এবং মুহাম্মদ স. আল্লাহর প্রেরিত রাসূল" (মুসলিম: ৬৫৫১) ৬. এক ইহুদীর কাছে নবীজী স. পানি চাইলেন।

সে পানি দিল। নবীজী স. তাঁর জন্য প্রার্থনা করলেন, "আল্লাহ তোমাকে সুন্দর রাখুন। " বলা হয়, এরপর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে লোকের কোনো চুল দাড়ি সাদা হতে দেখা যায় নি। (আযকার - নববী: ৯৬০) এসব হাদীসের প্রেক্ষিতে ওলামায়ে কিরাম বলেন, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াত প্রার্থনা করা বৈধ এবং উত্তম। ৭. ইমাম বুখারী রহ. তার বিখ্যাত হাদীস সংকলনে একটি অধ্যায়ের নাম রাখেন, "باب الدعاء للمشركين بالهدى" অর্থ: "মুশরিকদের জন্য হিদায়াতের প্রার্থনা করা"।

ইমাম বুখারী রহ. প্রতিটি অধ্যায়ের নাম সাধারণত তার মতামতের ভিত্তিতে রেখেছেন। এবং হাদীস বিশারদরা জানেন যে, তাঁর বুখারী শরীফের প্রতিটি অধ্যায়ের নাম তাঁর বক্তব্যই উপস্থাপন করে। এই অধ্যায়ের অধীনে ইমাম বুখারী যে হাদীসটি বর্ণনা করেন, তা হলো, কিছু লোক নবী স. কে বলল, হে রাসূল! আপনি দাওস গোত্রের উপর বদ দোয়া করুন। তারা আল্লাহর অবাধ্যতা করেছে। নবী স. প্রার্থনা করলেন, "اللهم اهد دوسا وأت بهم" "হে আল্লাহ! আপনি দাওস গোত্রকে হিদায়াত দিন।

" অধ্যায়ের উপরোক্ত নামকরণ এবং তাতে এই হাদীস উল্লেখকরণ এই বক্তব্যকেই সমর্থন করে যে ইমাম বুখারীও রহ. মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াত প্রার্থনার বৈধতার সমর্থক ছিলেন। ৮. প্রখ্যাত হাদীসবেত্তা, মুসলিম শরীফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যখ্যাতা, ইমাম নববী রহ. তার 'আযকার' নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, "অমুসলিমের জন্য হিদায়াত, সুস্থতা ও রোগমুক্তির জন্য দোয়া করা যাবে। (সুস্থতা ও রোগমুক্তির জন্য এ আশায় দোয়া করবে যে, আল্লাহ তাকে রোগমুক্ত করে হিদায়াতের তাওফীক দিবেন। ) তবে ক্ষমা প্রার্থনা করা যাবে না। (কেননা, যাকে সে বিশ্বাস করে না, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা তার জন্য নিরর্থক।

) " সবশেষে কথা হলো, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াতের প্রার্থনা করা শুধু বৈধই নয়, উত্তমও বটে। এবং ইসলামের শিক্ষা এটাই, যা নবী স. এর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে এ প্রার্থনা কেবল জীবিতাবস্থায়। কেননা ইসলাম গ্রহণ না করে মৃত্যুবরণ করলে তার জন্য মুসলামনের বিশ্বাসানুযায়ী জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে যায়। কাজেই, তার জন্য হিদায়াত প্রার্থনা করার কোনো প্রশ্নই আসে না।

আর ক্ষমাও চাওয়া যাবে না, কারণ যার জন্য ক্ষমা চাওয়া হবে, তার বিশ্বাসমতে ক্ষমা প্রার্থিত সত্ত্বা তো আল্লাহ নন, অন্য কেউ। কাজেই, কার কাছে কার জন্য ক্ষমা চাইবে সে?! আল্লাহ বলেন, "مَا كَانَ لِلنَّبِيِّ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَنْ يَسْتَغْفِرُوا لِلْمُشْرِكِينَ وَلَوْ كَانُوا أُولِي قُرْبَى مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُمْ أَصْحَابُ الْجَحِيمِ" "নবী এবং মুমিনদের কারো জন্য এটা শোভা পায় না যে তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যদিও তার নিকটাত্মীয় হোক না কেন। এ বিধান তখন, যখন তাদের জাহান্নামবাসী হওয়া নির্ধারিত হয়ে যাবে (অর্থাৎ, মৃত্যুর পর)। " (৯:১১৩) আয়াত থেকে বুঝা যায়, মুসলমানদের বিশ্বাসানুযায়ী জাহান্নামবাসী হিসেবে নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইসলাম বর্জনকারীর হিদায়াতের জন্য, বা, তার ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করা যাবে। কেননা, মৃত্যুর আগে যে কোনো মুহূর্তে কেউ মুসলমান হলে আল্লাহ তার যাবতীয় পাপ মোচন করে দেন।

হাদীসে আছে, "الاسلام يهدم ما كان قبله" "ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সকল পাপ মাফ হয়ে যায়। (মুসলিম: ৩৩৬) সারকথা হচ্ছে, একজন মুসলমানের দৃষ্টিতে একজন অমুসলিমের জন্য সবচেয়ে বড় কল্যাণ হল ইসলাম গ্রহণ করা। আর তার জন্য মুসলমান প্রার্থনা করতে পারবে, বরং, তা উত্তমও বটে। নবীজী স. তা করেছেন। অনুরূপভাবে একজন অমুসলিম অসুস্থ হলে তার রোগমুক্তির জন্য, বিপদে পড়লে বিপদমুক্তির জন্যও দোয়া করতে পারবে।

এ আশায় যে, সে মুক্ত হলে তা ইসলাম গ্রহণে এগিয়ে আসার পথ সুগম হবে। তবে মৃত্যুর মাধ্যমে যেহেতু ইসলাম গ্রহণের সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়, কাজেই তখন আর সেই প্রার্থনা করা যাবে না। [দুই] আপনার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশ ছিল, বিষয়টি যদি মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থে থাকেই, তাহলে মুসলমানদের মধ্যে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, হুজুররাও কেন সেটা করেন না? উত্তর হলো, হুজুরদের অনেকেই মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য দোয়া করেন। জুমার খুৎবাসহ আরবীতে বিভিন্ন নামাযের পর তারা সমগ্র বিশ্ববাসীর হিদায়াতের জন্য দোয়া করেন। যা হয়ত সাধারণের বোধগম্য না হওয়ায় বুঝা যায় না।

দেখুন, সমগ্রবিশ্ববাসীর জন্য যখন হিদায়াতের দোয়া করার অর্থ এই কামনা করা,যে, আল্লাহ যেন অমুসলিমকে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণের সাহস দেন, আর, মুসলমানকে আল্লাহ ইবাদত আরো সুচারুরূপে আদায় করার তাওফীক দেন –এই প্রার্থনা করা। তবে একটি কথা না বললেই নয়। যে কোনো ধর্মের কোনো কিছুকে সে ধর্মের অনুসারীদের আচরণ দ্বারা বিচার করা ঠিক নয়। আপনি একটি খারাপ কাজ করলেন, ফলে আপনার ধর্মকে মানুষ দোষারোপ করল, তা নিশ্চয় আপনি চাইবেন না। ধর্ম সবসময় ভালোর দিকে আহ্বান করে, খারাপকে তার সাথে সম্পৃক্ত করা উচিৎ নয়।

অন্যসব ধর্মের ন্যায় ইসলামেরও অনেক কিছু মুসলমান, বরং, মুসলিম পণ্ডিত ও স্কলারদের কাজে কর্মে পরিলক্ষিত হয় না। যা সত্যিই দুঃখজনক। তাই বলে, ইসলাম এমনটি বলে না, তা ভাবা কিন্তু বোকামী। ভালো থাকুন। আল্লাহ আমাকে, আপনাকে, সমগ্র বিশ্ববাসীকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।

আমীন। প্র.আ ব্লগে ও আইডি ফোরামে গতকাল প্রকাশিত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।