আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২১ দিনের ছুটি-১

এডিট করুন

ব্রিটিশ আমলে যখন দেশ ভাগ হল তখন অনেক পরিবারের সাথে আমার মায়ের গোষ্ঠীও তাদের সব কিছু ফেলে অশ্রুসজল নয়নে দেশ ছাড়লেন। রয়ে গেলেন শুধু আমার মা আর তার দুই বোন। তখন ছিল রায়টের সময়। দুইদিকেই অস্থিরতা চলছে। নেতাদের প্রধানমন্ত্রী হবার উচ্চাশার বলি হয়েছে কিছু সাধারণ মানুষ, নষ্ট হয়েছে এ অঞ্চলের মানবিক বাস্তুসংস্থান।

যাই হোক সেই কাহিনী লিখতে বসিনি আজ। আজ কিছু নিম্নস্তরের স্মৃতিচারণ করতে বসলাম। ডায়েরী লেখার মত বিপদজনক কাজ আমার দ্বারা সম্ভব না। তাই ব্লগই আশ্রয়। খুব ছোটবেলায় যখন হয়তো আমার এক বছর বয়স তখন আমার দাদা আমাকে দেখতে এসেছিলেন।

দাদী মারা গিয়েছিলেন আমার বাবার দুই বছর বয়সে। আমার দাদা আবার বিয়ে করেছিলেন। দাদার সাথে আমার এই দাদিও এসেছিলেন। তাদের কোলে আমার কয়েকটা ছবিও আছে। দাদার সাথে আমার সেই একবারই দেখা।

এরপরে আর দেখা হয় নি। আসল দাদীকে তো দেখা সম্ভবই নয়। যিনি আছেন তিনিও আমাদের সাথে খুব একটা থাকতে চান না। উনার পেটের ছেলে মেয়েরাই উনার সবচেয়ে বেশী আপন। অথচ আমি পারলে উনাকে মাথায় করে রাখি।

দাদা দাদী ছারা জীবন আমার। একজন বুড়ো মানুষ নাই সন্ধ্যাবেলায় যার সাথে বসে কিছু আলাপ আলোচনা করতে পারি, যাকে নিয়ে বিকালে একটু রাস্তায় হাটতে পারি। অনেক অভাব বোধ করি দাদা দাদীর। আমার আপন দাদী যদি আজ বেচে থাকত তাহলে তিনি কখনই আমাকে ছেড়ে থাকতে পারতেন না। আসলে কপালে নাই।

মনে চায় বুকটা ফাইড়া দেখাই কত কষ্ট। আসলে আমি গোষ্ঠীতান্ত্রিক মানসিকতার ছেলে। সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালবাসি। যাই হোক দাদা দাদী না থাকলেও নানা নানী যাদেরকে আমি বলি দাদাভাই আর দিদিমা উনারা ছিলেন। কিন্তু উনারাও থাকেন আরেক দেশে।

আমি আর আমার এক খালাত বোন কাছাকাছি সময়ে মায়ের গর্ভে আসি। দুই বোনই তাদের বাবার কাছে যান আশীর্বাদের জন্য। দুই বোনই তাদের সন্তানের নাম ঠিক করে রেখেছিলেন। যার আগে ছেলে হবে সে ছেলের নাম রাখবে রাজ আর যার মেয়ে হবে সে মেয়ের নাম রাখবে নন্দিনী। দুটোই যদি ছেলে বা মেয়ে হয় তাহলে কি নাম রাখা হবে তা জানা যায় নি।

আমার দাদাভাই নাকি আমার মাকে বলেছিলেন, "যা আমি বলে দিলাম, তোর ছেলে হবে"। আর আন্টিকে বলেছিলেন, "তোর মেয়ে হবে"। দেখা গেল দাদাভাই বেশ কামেল লোক ছিলেন। উনার সাথে আমার সাক্ষাৎ জন্মের আগে। জন্মের পরে আর দেখা সাক্ষাৎ নাই।

তাই যখন মা ঠিক করলেন বহুদিন তার বাবা মাকে দেখেন না, এইবার দেখতে যাবেন তখন আমি বেশ আনন্দিত বোধ করছিলাম। তখন ক্লাস থ্রী তে পড়ি। আমার সেই আন্টিও (নন্দিনী আপুর মা) তার ছোট বোনের দেখাদেখি ঠিক করলেন উনিও যাবেন। ব্যাস কাহিনী শুরু হল। প্রথমবারের মত বাড়ী ছেড়ে অনেকদিনের জন্য অন্য কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু হল।

প্রথমেই মা পাসপোর্ট করলেন। আমি তখন যেহেতু খুব ছোট তাই পাসপোর্ট অফিসের লাইনে দাড়ানোর অভিজ্ঞতা হয় নাই। একদিন মা একটা লাল রঙের পাসপোর্ট নিয়ে আসলেন। আমি বেশ আগ্রহের সাথে সেটা নেড়েচেড়ে দেখলাম। এর আগে বাবার পাসপোর্ট দেখেছি।

সেটার বং ছিল সবুজ। আমি নিজেই মাথা খাটিয়ে বের করলাম, ছেলেদের পাসপোর্টের রঙ হয় সবুজ আর মেয়েদের পাসপোর্টের রঙ হয় লাল। আমি বাবা মাকে বললাম, আমার পাসপোর্ট কই? আমাকে বলা হল, বারো বছর না হওয়া পর্যন্ত পাসপোর্ট দেওয়া হয় না। আমি বেশ মনক্ষুন্ন হলাম এই কথা শুনে। ছোট বলে আমাকে আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হল আমি ছোট।

কি আর করা! এরপর একদিন নাকি ভিসা হল। বিশ দিনের ভিসা। মার স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া হল বিশ দিনের। আমি মহাখুশী। বেশ কিছুদিনের জন্য পড়ালেখা থেকে ফাকি দিতে পারব।

আমি খুশীতে রাস্তা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেচে নেচে দৌড়াতে লাগলাম আর গাইতে লাগলাম "আই এম এ ডিস্কো ড্যান্সার, বিড়ি খাইলে হয় ক্যান্সার, বিয়া করলে হয় সংসার......" পরবর্তীতে আমি ভারতে দাদাভাইদের পাড়ায় এই গান বেশ জনপ্রিয় করি। সেখানে পোলাপান বেশ আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আমার দ্বারা আমদানীকৃত এই গান বেশ আগ্রহ নিয়ে গাইতে থাকে। যদিও গানটা মূলত ভারত থেকেই আমদানীকৃত পরে বুঝেছিলাম কিন্তু উলটা ওদের জিনিস ওদের দেশেই রপ্তানী করলাম। চোরের উপর বাটপারী। একদিন রাতে রওয়ানা হলাম।

বাবা আমাদে সাথে যান নি। কারণ উনি না থাকলে কারখানা দেখাশোনা সম্ভব ছিল না। আমরা গাবতলীতে এসে ঈগল পরিবহনের বাসে উঠলাম। রাত এগারটা বাজে সম্ভবত। বাবা আমাদের বাসে উঠিয়ে দিয়ে ফেরত গেলেন।

তার আগে এক হোটেলে বসে বাবা আর আমি বাইন মাছেন দোপেয়াজী আর ভাত খেলাম। তখন রাত এগারটা মানে অনেক রাত। সে সময় যোগাযোগ ব্যাবস্থা এত ভাল ছিল না। এগারটার সময় ঢাকা থেকে আমাদের বাড়ি পৌছতে অনেক ঝামেলা ছিল। বাস পাওয়া যেত না, নিরাপত্তার কথা বাদই দিলাম।

শুধু পরিবারের দিকে খেয়াল রাখার জন্য উনি এত রাত পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলেন। তখন বুঝতাম না এখন বুঝি, আমার বাবা আসলেই একজন দায়িত্ববান মানুষ। যাই হোক সেই রাতের কথা মনে পড়ছে। বাসে উঠে প্রথমেই দেখলাম সামনের সিটের পিছনের দিকে একটা খোপ লাগানো আছে যেটা ঘাটাঘাটি করে বুঝলাম যে এখানে সিগারেটের ছাই ফেলা হয়। আফসোস হতে লাগল কেন আমি সিগারেত খেতে পারি না।

তাহলে এই খোপটা ব্যাবহার করতে পারতাম। বাসের মধ্যে হালকা অন্ধকার রঙের ( হ্যা তাই !!) সাদা আলো জ্বলছে। আমি বিরক্তি নিয়ে বসে আছি কখন বাস ছাড়বে। বাসটা ছিল আসলে যশোরের বেনাপোলগামি একটা সাধারণ বাস, কিন্তু আমি মনে করেছিলাম বাসটা সোজা ভারতে গিয়ে ঢুকবে। পরবর্তীতে আমার এ ভুল ভাংলে চরম বিরক্ত হই।

(অনেক পুরানো কথা, অসংলগ্ন লাগতে পারে) চলবে.........

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।