আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মত প্রকাশে স্বেচ্ছাচার ও বাতিলদের ঐক্য



মত প্রকাশে স্বেচ্ছাচার ও বাতিলদের ঐক্য ফকির ইলিয়াস ======================================= মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে আমরা সবাই কথা বলি। কিন্তু কেউ যদি মত প্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নেয়, তাকে কী বলা যাবে? সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অবশ্যই চাই। কিন্তু এই স্বাধীনতার অপব্যবহার কাম্য নয় কোন মতেই। কোন মিথ্যা সংবাদ, মিথ্যা প্রতিবেদন যদি সমাজ, রাষ্ট্র, মানবতার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে তো মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলা যাবে না। কেউ দুর্নীতি করলে তার বিরুদ্ধে লেখা উচিত।

প্রতিবাদ করা উচিত। কিন্তু তা হতে হবে সত্যনির্ভর। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে অথবা কারও জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন করার জন্য কখনওই সংবাদ মাধ্যম ব্যবহৃত হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক অঙ্গন একটি সংবাদকে কেন্দ্র করে কেঁপে উঠেছে।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে সংবাদটি প্রকাশ করেছে 'দৈনিক আমার দেশ' পত্রিকা বেশ নেতিবাচকভাবে। তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এরই মধ্যে এর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি আইনি ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছেন। এ লেখাটি যখন লিখছি তখন পর্যন্ত জয়ের পক্ষ থেকে সরাসরি কোন প্রতিবাদ পাওয়া যায়নি।

'আমার দেশ' পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী এবং সজীব ওয়াজেদ জয় বিদেশী খনিজ উত্তোলন কোম্পানি শেভরনের কাছ থেকে ৫ মিলিয়ন ডলার উৎকোচ নিয়েছেন! তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর ভাষ্যমতে এ সংবাদ ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। তিনি এর সূত্র-প্রমাণ জানানোর জন্যও সংশ্লিষ্ট পত্রিকার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু বিষয় খোলাসা করা দরকার। 'দৈনিক আমার দেশ' কাগজটির অন্যতম মালিক মোসাদ্দেক আলী ফালু, বেগম জিয়া পরিবারের ঘনিষ্ঠজন। তা কারও অজানা নয়।

সেই কাগজের বর্তমান সম্পাদক যিনি রয়েছেন তিনিও একজন অতি ডানপন্থী বলে খ্যাত। মাহমুদুর রহমান বেগম জিয়ার শাসনামলে জ্বালানি উপদেষ্টা ছিলেন। এই সেই মাহমুদুর রহমান যিনি 'উত্তরা ষড়ন্ত্রের'ও অন্যতম নায়ক। বেগম জিয়ার পরিবার এবং ডানপন্থী তমদ্দুনের আশীর্বাদ পেয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত সাংবাদিক হিসেবে নাজেল হন। দায়িত্ব নেন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী হিসেবে মাঠে নামার।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই আমার দেশ পত্রিকাটি নানাভাবে নেতিবাচক রিপোর্ট ছাপা শুরু করে। এবং সেটা তারা অব্যাহত রেখেছে। সম্প্রতি তারা এর ধরনে যুক্ত করেছে নতুন মিথ্যাচার। তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই চরিত্র হননের নানা প্রকল্প। এখানে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখা দরকার, তা হচ্ছে ৫ মিলিয়ন ডলার অঙ্কটি কী খুব বড় অঙ্ক? তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

যিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে এই দেশের স্বাধীনতা এনেছেন। আর সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পুত্র। একজন কৃতী প্রযুক্তিবিদ। রাষ্ট্রকোষ থেকে অবৈধভাবে 'পাঁচ মিলিয়ন ডলার'ক্ষমতাবানদের জন্য নেয়া কোন বিষয়ই নয় যদি কেউ অবৈধভাবে নিতে চান। জয় যেহেতু এখনও ক্ষমতার ধারে কাছেও নেই, তাই তার নাম জড়িয়ে এমন মিথ্যাচারের হেতু কী? আর যদি প্রমাণ থেকেই থাকে তবে প্রমাণাদিসহই অবস্থার মোকাবেলা করা উচিত নয় কী? দুই 'আমার দেশ' পত্রিকায় রিপোর্টটি ছাপার পর দেশে-বিদেশে তোলপাড় হচ্ছে।

এর সূত্র ধরে 'আমার দেশ' অফিসে মত প্রকাশে স্বাধীনতায় বিশ্বাসীদের একটি সমাবেশের ছবি দেশবাসী দেখেছেন। ইন্টারনেটের কল্যাণে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালিরাও দেখেছেন। সেখানে একাত্তরের রাজাকারপ্রধান মতিউর রহমান নিজামী বেশ জোশ বক্তব্য দিয়েছেন। তারা সরকারকে দেখে নেয়ার হুমকি-ধমকিও দিয়েছেন। গত নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত এসব বাতিলের ঐক্য নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

হঠাৎ করে 'সব শিয়ালের এক রা' হওয়ার কারণ কী? আমরা জানি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল রায় পুনর্বহালের পর জাতি নব উদ্দীপনা ফিরে পেয়েছে। ঘাতক দালালদের বিচারের প্রত্যয়ে মহান বিজয় দিবস সম্প্রতি পালিত হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের ডানপন্থি মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী তথাকথিত জাতীয়তাবাদীরা নানাভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ খুঁজছে। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরকে দলে ফিরিয়ে নিয়েছে বিএনপি। এটি দেশবাসীর অজানা নয়, এই লুৎফুজ্জামান বাবর কুখ্যাত 'হাওয়া ভবনের' অনেক কুকর্মের দোসর ও সাক্ষী।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে 'লুকিং ফর শত্রুজ' খ্যাত চুলে জেলমাখা এ হাওয়া ভবন ক্যাডারযুক্ত সেটা এখন ক্রমেই প্রকাশ পাচ্ছে ধৃত ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকে। বাবর হঠাৎ করে হাওয়া ভবনে শীর্ষ কর্ণধারদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে যান কি না সেই ভয়েই খুব দ্রুত তাকে দলে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। বর্তমানে পলাতক হারিছ চৌধুরী, জেলে আটক আবদুস সালাম পিন্টু কিংবা মুফতি হান্নানের মতো জঘন্য জঙ্গিকেও এখন যদি বিএনপি সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে তবেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এটি কারোরই অজানা নয়, বাংলাদেশে ডানপন্থি মিডিয়াগুলো নানাভাবে সরকারকে হেনস্থা করতে ব্যস্ত। আর সেজন্য বিভিন্ন টক শো, কলাম, বিতর্কে অংশ নিয়ে মৌলবাদের মদদপুষ্ট কিছু বুদ্ধিজীবী কখনও শেখ মুজিবকে, কখনও শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়কে বিতর্কিত করার ইজারা নিয়েছেন।

তাদের কথার বাণ থেকে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকীর বিদেশে অবস্থানরত-অধ্যয়নরত সন্তানরাও বাদ যাচ্ছেন না। অন্যদিকে তাদের পরামর্শেই পরিকল্পিতভাবে কথিত যুবরাজকে তার দুর্নীতির পুরস্কার হিসেবে লোভনীয় পদটি দেয়া হয়েছে। এটি চরম লজ্জাকর বিষয় বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে জড়িয়ে এ পর্যন্ত যে মিথ্যা রিপোর্টগুলো করা হয়েছে এর স্বপক্ষে এসব মিডিয়া কোন প্রমাণ দাঁড় করতে পারেনি। কেউ দুর্নীতিবাজ হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অবশ্যই হবে। কিন্তু কারও জনপ্রিয়তায় হিংসাপরায়ণ হয়ে তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচার তো কাম্য হতে পারে না।

বাংলাদেশে পুলিশের পোশাক বদলের নামে, বিদ্যুতের খাম্বা লাগানোর নামে, বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে হত্যাকা- ধামাচাপা দেয়ার জন্য উৎকোচ নেয়ার নামে কারও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা, জনগণের এসব খবর অজানা নয়। আজ তাদের কাতারেই জয়কে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে। দল, রাজনীতি, কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতার ধারে কাছে না যাওয়ার আগেই তাকে ঘায়েল করার ফন্দি আঁটা হচ্ছে। প্রতিটি সরকারের ধারে কাছেই কিছু দুর্নীতিবাজ আশ্রয় নেয়। আওয়ামী লীগ কর্তৃক তিরস্কৃত জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান, হাজী সেলিম প্রমুখ নেতা এখনও দলে তেমন সক্রিয় নয়।

যারা তথাকথিত 'সংস্কারপন্থি' বলে পরিচিত তারাও তাদের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের এর আগে প্রায় চলে গিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে নতুন ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করছে বিএনপি। দুর্নীতিবাজ, আন্তর্জাতিক চোরাচালানি চক্রের মদদদাতা ও জঙ্গিদের আশ্রয়দাতাদের পুনর্বাসিত করছে। পুরস্কার দিচ্ছে রাজনৈতিকভাবে। একটি জাতির জন্য এটা কোন মতেই শুভ সংবাদ নয়।

তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে সেই সব রাজাকার আবারও স্বার্থ হাসিলের ধান্দা করছে। যেভাবে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছিল। ২০০১-এ বেগম জিয়ার মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব পেয়েছিল। আবারও বলি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। সবাইকেই আইনের আওতায় রাখা উচিত।

কিন্তু তাই বলে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কারও চরিত্র হননও মেনে নেয়া যায় না। বর্তমান রাষ্ট্রপ্রশাসন আইনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এসব স্বেচ্ছাচারী বর্ণচোরার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেই জাতির প্রত্যাশা। অন্যদিকে কেউ দুর্নীতি- স্বজনপ্রীতির আশ্রয় নিলে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নিতে যেন কার্পণ্য না হয়। মনে রাখতে হবে এদেশের মেহনতি জনতা বড় কষ্টে জীবনযাপন করেন। তারা যেন আর প্রতারিত না হন।

নিউইয়র্ক, ২২ ডিসেম্বর ২০০৯ -------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ২৫ ডিসেম্বর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- ড্রাগন ডেইল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।