আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি < ৯ > যুদ্ধের ভেতরে আর এক যুদ্ধ

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
আমাদের এই শহরতলী গোছের গ্রামটাতে তেমন ধনীর বসবাস ছিল না। এক জমিদার ছিল তার বাড়ি এখন ভগ্নদশা। তার পুকুরটি সারা গ্রামের মানুষের নাওয়া-খাওয়ার জলের সংস্থান। আমরা যখন এখানে একেবারে নতুন, সে সময় আশেপাশের প্রায় সকলেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখত আমাদের। কেউ সরাসরি ঘৃণা করত, কেউ বা করুনা।

বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পরে ধীরে ধীরে এই অবস্থা বদলে গেল। আমরা যার বাড়িতে থাকছিলাম সেই রায় বুড়োর বাড়ির পাশের বাড়িটি মালতিদের। মালতির মা আমার মায়ের চেয়ে একটু বেশি বয়স হবে। ওদের আদি বাস গোপালগঞ্জের গোবরা। ৪৭ এ দেশ ভাগের পর মালতির মায়েদের এমন অবস্থা ছিলনা যে তারা বিনিময় করে পশ্চিম বঙ্গে আসবে।

মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। কিন্তু শুধুই মাটি কামড়ে থাকলে যে বাঁচা যায় না, বাঁচার জন্য কৌশল আর ক্ষমতা থাকতে হয়, তা ছিলনা তাদের। আশেপাশের ভেন্নাবাড়ি, হরিদাসপুরের মানুষরা নাকি দলে দলে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে! জমি জমা নিয়ে গেরস্ত পরিবার, হুট করে কি করবে ঠিক করতে পারেনি মালতির দাদু। একদিন ভর সন্ধ্যায় মালতির দাদুদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়ে মালতির মা’কে তুলে নিয়ে গেল ! অসম্ভব সুন্দরী হওয়াটাই যেন কাল হলো। সারারাত ধরে একজনের পর একজন ছিঁড়েকুটে খেল মালতির মা’কে! পরদিন অচেতন মেয়েকে নিয়ে তার দাদু উঠে বসল ভাটিয়াপাড়ার লঞ্চে।

লঞ্চ, ট্রেন,হাঁটা শেষ হতে এই বেতাই ইউনিয়নের লালবাজার। শরীরের উপর দিয়ে পাশবিকতা সওয়া সেই মালতির মা আমার মা’কে বোন বলে কাছে টেনে নিয়েছিল। বলেছিল-‘ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি তোর বোন আছি না’? এ এক পরম আশ্রয়। রায় বুড়োর স্ত্রী নেই। পঞ্চাশে মারা গেছে।

সেও সেই ঘরে আগুন দিয়ে ভিটেছাড়া করে ভিটে দখলের মরণ খেলা! রায় বুড়োর ছেলে জগা তখন শিশু। চোখের সামনে মা’কে জ্বলে পুড়ে খাক হতে দেখে সেই যে স্মৃতিভ্রষ্ট হলো, আর স্বাভাবিক হয়নি। এখন তাকে সবাই জগা পাগল বলে জানে। এই জগা মাঝে মাঝে মায়ের গোসলের পানি এনে দিত। কোন কোন দিন আমাদের ঘরে খাবার না থাকলে জগা ঘর থেকে চাল এনে দিয়ে বলত-আমার তো মা’ও নাই দিদিও নাই! তুমিই আমার দিদি! মা বলতেন আমরা দেশে থাকতে কোনদিনই টের পাইনি এরা কে কি ভাবে দেশ ছেড়েছে! কে কি পরিমানে কষ্ট বয়ে বেড়ায়, আর কেনই বা এরা পূর্ব বাংলার মানুষদের ঘৃণা করে! মা’ও ওদের সাথে সেই সব অতীত দিনের গল্প করতেন।

মামা বাড়ির পাশে যে খালটি ছিল তার ওপারেই যশোরের(নড়ালের) সীমানা। খালের পর থেকেই বিল। সেই বিলের মাঝ বরাবার একটা রাস্তা ধরে গেলেই গলক এর বাড়ি। সেই পঞ্চাশেই ইঁটের দো’তলা। পাশাপাশি তিনটি বাড়ি।

তিনটিই পাকা। গলকের বাড়ির মাইল খানেক দূরেই "ভূতের বাড়ি"। আসলে সেটা ছিল নীলকুঠি। নীলকর চলে যাবার পর পরিত্যাক্ত। দালাদের গা বেয়ে বট গাছ গজিয়ে এক ভয় ধরানোর চেহারা।

সেই গলকের সাথে মুসলমানদের কাইজে (কাজিয়া) লাগলে গলক বন্দুক ছোঁড়ে। মুসলমানদের বন্দুক ছিলনা বলে তারা হেরে যায়, কিন্তু দেশটা তো এখন পাকিস্তান, তাই নড়াল থেকে পুলিশ এসে গলকের সব বন্দুক নিয়ে যায়। তার পরই গলকের সাথে আবার কাজিয়া করে মুসলমানরা জেতে। বিজয়ীরা গলককে সাথে সাথে কেটে টুকরো টুকরো করে খালে ভাসিয়ে দেয়। বিল পাড়ি দিয়ে গলকের বাড়ির বউ-ঝি রা এসে ওঠে মা’দের বাড়িতে।

নানা প্রসিদ্ধ আলেম হওয়ার পরও সেই পুরো পরিবারকে রক্ষা করে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। নানার এই ভূমিকা আর মায়ের আপন করে নেওয়ার কারণে ওরা খুব শিগগিরই আমাদেরকে আপন করে নেয়। এই সময়টাতে আমাদের মনেই হতো না যে আমরা বিদেশে আশ্রিত। প্রায় পুরো গ্রামের মানুষ বাংলাদেশের নিজের ভিটে ছেড়ে এখানে রিফিউজি হয়েছে। আর আমরা হয়েছি শরণার্থী।

গ্রামের মানুষদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর ওরাই দেখল আমরা খুব অমানবিক ভাবে বাস করছি। তখন মালতির মামা, রায় বুড়ো, অশ্ব-বিশ্ব’র দাদু-দিদিমা একটা ভাল যায়গা দেখে আমাদের টিনের ঘর তুলে দেয়। ঘরটি ছোট হলেও তাতে একটা বারান্দা থাকে। সামনে নিকোনো উঠোন থাকে। এই সময় মালতি, কেশবের মা, জগদিশের মা আর বিশ্বর দিদিমা মা’কে সেলাইয়ের কাজ এনে দেয়।

মা সেলাই শুরু করেন। মুর্শীদাবাদের কথা মা কখনো মনে করতে চাইতেন না, কিন্তু রেজাউল মামা যে কষ্ট করে সেলাই মেশিনটা এনে দিয়েছিলেন সে জন্য বার বার তাকে কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আমাদের আপন কেউ না। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার কারণে ধর্ম ভাই-বোন সম্পর্ক। সেই ধর্ম ভাই দেশে ফিরে যেয়ে কেমন আছে সেটা নিয়েও মা মাঝে মাঝে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতেন।

মা সেলাই শুরু করার পর আমি তিন বোনের জন্য একই রকম প্রিন্টের কাপড় কিনে এনেছিলাম। মা একই রকম ডিজাইনে তিন জনের জামা বানিয়ে দিয়েছিল। তিনটি মেয়ে যখন একই রকম জামা গায়ে এবাড়ি ওবাড়ি যেত সবাই তাদের আদর করত। মনে হয় এই সময়টাতে আমরা সুখেই ছিলাম। ততদিনে বাড়ি ছাড়ার এবং আশ্রয়হীনতার কষ্ট অনেকটাই মুছে গেছে।

সন্ধ্যে বেলা আমিও বোনদের নিয়ে হ্যারিকেন জ্বেলে পড়তে বসাতাম। বড় বোনটি যার বয়স মাত্র আট সে মাঝে মাঝে মা’র সাথে রান্নাও করতে লাগল। কে জানত কিছুদিন পরই তাকে নিয়মিত রান্না করতে হবে? এর কিছুদিন পরে মায়ের পুরোনো রোগ গ্যাস্ট্রিক ভীষণ বেড়ে গেল। মা সরাক্ষণ ব্যথায় ছটফট করতেন। দাদু-দিদিমা’রা আমাকে বললেন- জালুটি গ্রামে যাওয়ার পথে অর্জুন গাছ আছে।

সেখান থেকে অর্জুনের ছাল এনে বেঁটে খাওয়ালে ব্যথা কমবে। এই কাজটা আম চুয়াডাঙ্গাতেও করেছি। আমার কাছে নতুন কিছু না। মা অসুস্থ্য হওয়ার পর ওইটুকুন মেয়ে আমাদের সমস্ত রান্নাবান্না করত। রায় বুড়ো আমাকে একটা গুলতি বানিয়ে দিয়েছিল।

আমি সময় পেলেই সেই গুলতি নিয়ে পাখি শিকারে বেরিয়ে পড়তাম। সাথে থাকত বড় বোনটি। কোনদিনই পাখি মারতে পারিনি, কিন্তু ফেরার সময় গাছের মরা ডালপালা কুড়িয়ে আনতাম। তাই দিয়েই রান্নাবান্না হতো। আমি তো আগেই "বড়" হয়ে গেছি, এবার অবস্থার নির্মম বাস্তবতায় আট বছরের বোনটিও ‘মা’ হয়ে উঠল।

তখন সে নিজেই ছোট বোনদের গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর কাজগুলো করতে লাগল, যেটা আগে মা আর আমি করতাম। আরও কিছুদিন পরে একদিন দেখি ক্যাম্প ঝাড়ু–টাড়ু– দিয়ে পরিষ্কার করা হচ্ছে। ব্যাপার কি? সেক্টর কমান্ডার আসবেন ভিজিটে। সারা ক্যাম্পে যেন সাজ সাজ রব রব। আমি দৌড়ে বাড়ি এসে আমার ভাল প্যান্ট আর পরিষ্কার সার্ট পরে গেলাম।

দুপুর থেকেই ক্যাম্পের সবাই অপেক্ষা করছে। আমার ভেতরও কেমন যেন মনে হচ্ছে! সেক্টর কমান্ডার কেমন, কি করেন, কাকে কি বলবেন, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে কি কি বলব সব মনে মনে ভাবছি। বিকেলের দিকে তিনি এলেন। একটা উইলস জিপ (এই ছোট্ট নিচুমত গাড়িটা আমার ভারী পছন্দ হতো। আমাদের ক্যাম্পেও একটা ছিল।

ক্যাপ্টেন সাহেব কখনো তেহট্ট বা কৃষ্ণনগরে গেলে এই জিপেই যেতেন। ড্রাইভার ওসমান কাকা বলেছিলেন-এটা আমেরিকান জিপ) এসে থামল। চার-পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা নেমে ড্রাইভারের পাশের দরোজা খুলে দিলে নেমে এলেন সেক্টর কমান্ডার। আরে আমি তো ইনাকে চিনি! আমি দেখেই চিনেছি, এই লোককে আমি হ্যাবা ডাক্তারের বাড়িতে দেখেছি! আমার আনন্দ আর ধরে না! আমি সামনে যাকে পাচ্ছি তাকেই বলছি সেক্টর কমান্ডার সাহেবকে আমি চিনি! তার সাথে হাত মিলিয়েছি! ইনি মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। আমরা সবাই তিনটি লাইন করে দাঁড়িয়ে আছি।

বাবা প্রথম লাইনে। আমি একেবারে শেষের লাইনে। তিনি একে একে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছেন আর এটা ওটা বলছেন। তার পাশাপাশি হাঁটছেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। শেষ লাইনে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েই তিনি মাথা ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে তাকালেন।

দেখলাম ক্যাপ্টেন হাসছেন। আমার বুক ঢিপ ঢিপ করছে। আমি কতক্ষণ হাত বাড়িয়েছিলাম জানিনা তিনি আমার হাতটা ধরলেন দুই হাত দিয়ে। তার পর যখন সরে আমার পাশের জনের কাছে গেলেন তখনই আমি বলে উঠলাম-‘আমি আপনাকে চিনি’! সাথে সাথে তিনি আবার ফিরে এসে আমার গাল টিপে দিলেন, কিন্তু জিজ্ঞেস করলেন না যে কি ভাবে চিনি। পরে সেকেন্দার কাকা শিখিয়ে দিলেন- ‘ফুয়া এ্যামনে কয় নাকি? কইতা-‘আমি আপনাকে চিনি স্যার’।

তারপর স্যালুট দিতা? আমার মেজাজ খারাপ হলো, ধুর! এত নিয়ম মানে কে? সেক্টর কমান্ডার চলে যাবার পর দিনই বাবা একটা টিম নিয়ে সাতক্ষীরা বর্ডারে চলে গেলেন। বাবার টিমে যারা গেল তারা সবাই লেখাপড়া জানা লোক। কেন গেলেন, তারা কি করবেন জানতেও পারলাম না। বাড়িতে বলে গেলেন ফিরতে পনের দিন বা তারও বেশি লাগতে পারে। যদি মাস পার হয়ে যায় তাহলে যেন আমি তার বেতন তুলে আনতে পারি সে জন্য সেকেন্দার কাকাকেও বলে গেলেন।

বাবা চলে যাওয়ার পর আমি আবার ক্যাম্পে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কখনো খাবার নিয়ে ফ্রন্টে যাওয়া, কখনো ডাক্তার কাকার সাথে এ্যাসিসটেন্ট হওয়া, কখনো বা রাইফেলে ফুলথ্রু মেরে রাইফেল পরিষ্কার করা। আবার ট্রেনিংয়ের জন্য যারা নতুন তাদের রাইফেল সাজিয়ে দেওয়া, গ্রাউন্ডসিট বিছিয়ে দেওয়া। আর এই সব কাজের সময় আমার সারাক্ষণের সাথী আমার সেই সাদা বেড়ালটি। কৌটার দুধ খেয়ে ওটা এখন বেশ গাব্দাগোব্দা।

আমি যে পথে ক্যাম্পে যাওয়া-আসা করতাম সেই পথের ধারেই একটা বাঁশঝাড় ছিল, তার নিচেই ক্যাপ্টেনের তাবু। তিনি যদি কখনো তাবুর বাইরে বসে থাকতেন তাহলে আমাকে দেখলেই ডাক দিতেন। তিনি অনেক সময়ই রেডিও শুনতেন। একটু পুরোনো হলেই রেডিওর ব্যাটারী বদলাতেন। আমার লোভ ছিল তার পুরোনো ব্যাটারী নেওয়া।

আমি সেই ব্যাটারী নিয়ে মুখ খুলে ভেতরের কালো কালো কয়লার গুড়ো বের করে ভেতরের কার্বন আর কার্বনের উপরের ক্যাপ জমাতাম। ইয়াসিন কাকার কাছ থেকে লিকোপ্লাস্ট এর খালি রিল নিয়ে তার মধ্যে ব্যাটারী দিয়ে লিকোপ্লাস্ট দিয়ে মুখ আর পিছন দিক আটকে টর্চ লাইট বানিয়েছিলাম। মাহানন্দে সেই টর্চ জ্বেলে রাতে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু সেই ব্যাটারীর নেশাই যে একদিন আমার জন্য কাল হয়ে যাবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারিনি.......... চলবে............. প্রথম পর্ব। দ্বিতীয় পর্ব।

তৃতীয় পর্ব। চতুর্থ পর্ব। পঞ্চম পর্ব। ষষ্ঠ পর্ব। সপ্তম পর্ব।

অষ্টম পর্ব।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।