আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক কিশোরের চোখে মুক্তিযুদ্ধের অমলিন স্মৃতি < ৫ > অচেনা আঁধারে বাবার তালাশ

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি
যে যে পথে গেছিলাম সেই সেই পথে ফেরার সময় আর পথ অচেনা মনে হলো না। মনে মনে এটা ভেবেই শুধু অসহায় বোধ করছিলাম-কোথা থেকে শুরু করব? লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে কোথায় বাবাকে খুঁজব? জনে জনে জিজ্ঞেস করব, নাকি শুধুই মুক্তিযোদ্ধাদের জিজ্ঞেস করব? মুক্তিযোদ্ধাদের কোথায় পাব? এমন অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে বহরমপুর এসে গেলাম। কয়েকদিন আগে যে রেস্টুরেন্টে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম সেই রেস্টুরেন্টকেই আপন আর চেনা মনে হল। বুন্দিয়া পরোটা খেয়ে ওই রেস্টুরেন্টের কাউন্টারে বসা লোকটিকে সব কিছু খুলে বললাম। তিনি আমাকে সাহায্য করবেন আস্বাস দিয়ে বসতে বললেন।

বসে রইলাম চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ পরে তিনি আমাকে ডেকে বললেন-তোমাকে শুরু করতে হবে এক প্রান্ত থেকে, যেখানে সেখানে খুঁজে লাভ নেই, শুধু শরণার্থী ক্যাম্প আর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খুঁজবে। তিনি যা যা বলে দিলেন আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম, কিন্তু মনে মনে আরো ঘাবড়ে গেলাম! তার পরও মন শক্ত করে বললাম-‘আমি তাহলে দক্ষিণ দিক থেকেই শুরু করি’। এর পর তিনি কাকে যেন ডেকে বললেন-‘এই খোকাকে কৃষ্ণনগরের বাস স্ট্যান্ডে যাওয়ার জন্য একটা রিকসা করে দাও’। সেইমত আমার চেয়ে একটু বড় একটা ছেলে আমাকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এসে একটা রিকসা ডেকে তাতে উঠিয়ে দিল।

একটু পরে আমি কৃষ্ণনগরের বাসে চেপে বসলাম। কোথা দিয়ে এলাম কিছুই মনে নেই! প্রায় বিকেল নাগাদ পৌঁছুলাম কৃষ্ণনগরে। সেখানে কাকে কি জিজ্ঞেস করব কিছুই বুঝতে না পেরে বাস স্ট্যান্ডেই নিরূপায় বসে রইলাম। একসময় সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হয়ে এলো। এখানে এসে একটা ব্যাপারে একটু ভাল লাগছিল, আমরা চুয়াডাঙ্গায় যে ভাষায় কথা বলতাম এখানেও দেখলাম সেই রকমই কথা বলে সবাই।

এখন কোথায় যাব, কোথায় থাকব এই চিন্তায় প্রথমেই মাথায় এলো যেখানে শরণার্থীরা থাকে সেখানেই থাকতে হবে। বাস স্ট্যান্ডের পাশেই একটা ছোট মাঠের মত খালি যায়গায় দেখলাম তাবু খাটানো শরণার্থী শিবির। তারই পাশে গিয়ে বসে পড়লাম। এই প্রথম নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হলো! আগে তো মা-বোন সাথে ছিল, এখন আমি একা! অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।

খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল মানুষের চিৎকার শুনে। আমার কাছে এই সময়ে একটা ব্যাপার বেশ সোজা মনে হচ্ছিল,যে কোন হোটেলে বা রেস্টুরেন্টে গেলে অনেক খবর পাওয়া যায়। কাউন্টারের লোক বা যারা খায় তারা কেউ না কেউ অনেক খবর দিতে পারে। কাছের একটা রেস্টুরেন্টে বসে নাস্তা করে সেখানেই জেনে নিলাম এখানে বর্ডার কত দূরে, কাছের শরণার্থী শিবিরগুলো কোথায়, এইসব। সেই মত আবার বেরিয়ে টেম্পোতে চড়ে রওনা হলাম কল্যাণী শরণার্থী শিবির।

অনেক বেলা হওয়ার পর কল্যাণী পৌঁছানোর পর আবার আমার মাথা ঘুরে উঠল! হাজার হাজার মানুষ কয়েক মাইল জুড়ে তাবু খাটিয়ে আছে! অনেক দূর থেকেই মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। মূল শরণার্থী শিবিরে ঢোকার পর দুএকজনকে জিজ্ঞেস করার পর মনে হলো এভাবে কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। অনেকে তো কথাই বলতে চায় না। সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। আমি চেষ্টা করছিলাম আমার বয়সী বা আমার থেকে একটু বড় যারা তাদের কাছে খবর নিতে, কিন্তু তারা আমার কথা শুনে কেউ হাসে, আবার কেউ বলে- এভাবে বাবা পাওয়া যায় নাকি? পাগল কোথাকার! দুপুরের পর এক মুক্তিযোদ্ধা আমাকে পাশে ডেকে অনেকক্ষণ কথা বললেন।

সব শুনে তিনি আমাকে শিকারপুরের একটা ট্রাকে তুলে দিলেন। এটা আরও দক্ষিণে না উত্তরে তা মনে নেই। তিনি আমাকে বলে দিলেন‘ শিকারপুর হচ্ছে আমাদের যশোরের বর্ডার। যদিও তোমার বাবা মেহেরপুর ইউনিটে ছিলেন, তবুও তুমি শিকারপুর থেকেই শুরু কর। আর এভাবে শরণার্থী শিবিরে কেউ কিছু বলতে পারবে না, তার চেয়ে বরং তুমি একেবারে বর্ডারে চলে যাবে’।

আমার কাছে টাকা-পয়সা আছে কিনা তাও জিজ্ঞেস করলেন তিনি। আমি ‘আছে’ বলায় আমাকে পিঠ চাপড়ে অভয় দিয়ে ট্রাকে তুলে দিলেন। একসময় শিকারপুরে এসে নামলাম। এর ওর কাছে জিজ্ঞেস করে চলে গেলাম মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় বিশ-ত্রিশ জনকে জিজ্ঞেস করেও কোন কুলকিনারা হলো না।

তবে কৃষ্ণনগরের মত আমাকে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হলো না। ওরা একটা বারান্দায় থাকতে দিলেন। সকালে উঠে আবার রওনা দেব। কিন্তু কোন দিকে? কোথায়? বাবার চেয়ে একটু বেশি বয়সী একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে সোজা বাড়ি(মুর্শীদাবাদ) ফিরে যেতে বললেন। এভাবে নাকি আমি জীবনেও বাবাকে খুঁজে পাব না! এক পর্যায়ে তিনি বললেন-তোমার বাবা বেঁচে আছে কিনা তা কি জানো? আমি অসহায়ের মত মাথা নাড়ালাম শুধু।

কেন জানিনা ওই লোকটির উপর খুব রাগ হচ্ছিল। কোনভাবেই আমি ভাবতে চাচ্ছিলাম না যে বাবা মারা গেছেন। ওখান থেকে বেরিয়ে আবার আমার উত্তরে যাত্রা। এবার আর আমি বড় বাসে বা ট্রেনে না চড়ে ছোট ছোট মিনি বাসে আর টেম্পো তে চড়ে বর্ডার ধরে উত্তরে এগুতে থাকলাম। দুই তিন দিন পর আরো হতাশ হয়ে একটা বড় লরির ড্রাইভারের কাছে আমার বিষয় বলায় ড্রাইভার বলল- তোমার উচিৎ হবে তোমার বাবা জয়বাংলার যে সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে পারে সেখানে খোঁজ করা।

আমি তাকে মেহরেপুরের কথা বলায় তিনি বললেন-আমার সাথে থাকো। আমি সন্ধ্যায় ওদিকেই যাব। আমি তার সাথেই থেকে গেলাম। প্রথম আর দ্বিতীয় দিনের কথা মনে ছিল, কিন্তু এখন আমি আর মনে করতে পারছিলাম না যে কত দিন আমি বেরিয়েছি! আমার পরনে ইংলিশ হাফপ্যান্ট আর কেরোলিনের সার্ট। কেরোলিনের সাট ময়লা হয়নি, কিন্তু প্যান্ট কালো হয়ে গেছে।

প্যান্টের পকেটে যে টাকা আছে সেটা আমি অতি যত্নে রেখেছি। ট্রাক বা মিনি বাসে আমার কাছ থেকে কেউ ভাড়া নেয়নি। খাওয়া ছাড়া আর টাকাও খরচ হয়নি। এক একবার মনে হচ্ছিল এভাবে হবে না। বাড়ি ফিরে যাই।

আবার যখন ওই বাড়ির বড় মামার কথা মনে পড়ে তখন মনে হয় যে করেই হোক বাবাকে পেতে হবে। আর যদি বাবাকে নাও পাই তবুও আর ওখানে থাকব না। একধরণের জিদ হচ্ছিল মনে মনে। সন্ধ্যার দিকে সেই ট্রাকে আমি আবার রওনা হলাম। এবার একটু ভাল লাগছিল এটা ভেবে যে সেই বেতাই যাচ্ছি, সেখানে সেই বুড়ো মানুষটা মানে নিরঞ্জনের বাবা আছেন যিনি আমাদের চিনেছিলেন।

ট্রাক ছুটে চলেছে। ট্রাক কোন জায়গা দিয়ে যাচেছ কিছুই জানিনা। একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। ট্রাকের ড্রাইভারও আমাকে ডাকল না। সকালে যখন ড্রাইভারের ডাকে ঘুম ভাঙ্গল তখন ড্রাইভার লজ্জিত হয়েই বলল-আমার তো মনেই নেই যে তোমাকে তেহট্ট থানায় নামিয়ে দেব! তেহট্ট কোথায় জিজ্ঞেস করতে সে জানাল বেতাই এর পাশে, ওটা থানা শহর।

আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম একটা সাইনবোর্ডে লেখা রাধিকাপুর (পশ্চিম দিনাজপুর)! মাথা ঘুরে উঠল! এ কোথায় এলাম! ড্রাইভারের উপর রাগ হচ্ছিলনা, কিন্তু কেন ডেকে দিল না ভেবে কান্না পাচ্ছিল। এবার ড্রাইভার নিজের পয়সায় আমাকে নাস্তা করিয়ে বললেন-‌"ভালই হলো, তুমি এবার এখানেও খুঁজতে পারবে"। আমি কিছুই বলছি না। আরও কিছু সময় পরে ড্রাইভার আমাকে একটা মিনি বাসে তুলে দিল। বাসটা যাবে মালদহ।

তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম মালদহ। এদিন আমার ভয় একটু একটু করে কমে যেতে লাগল। মনে হলো অনেকটা পথ তো ঘুরে বেড়াচ্ছি, এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা যখন হয়নি, তখন আর মনে হয় কোন ভয় নেই। মালদহ শহরে এসে নামলাম। আবারও এক রেস্টুরেন্ট।

আবাও সেই রেস্টুরেন্টের কাউন্টারের মানুষটিকে কাকা বলে জিজ্ঞসাবাদ। এখানে এসে জানলাম এই মালদহ বর্ডার পার হলে ওপারের রাজশাহী। মালদহ থেকে মিনি বাসে চলে এলাম আমাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জের বর্ডারে। আমি জানি নেই, তবুও এখানে সেই একই জিজ্ঞাসাবাদ করে চললাম। দুই দিন ধরে এখানে বর্ডারে, শিবিরে আর ছোট ছোট ক্যাম্পগুলোতে খুঁজে আবার ফিরে এলাম মালদহ শহরে।

রাতে সেখানে বাস স্ট্যান্ডের পাশে টিনের ছাপড়ায় থেকে পর দিন সকালে জিজ্ঞেস করে করে গিয়ে উঠলাম আরো দক্ষিণে শিকারপুর যাওয়ার বাসে। দুপুরের দিকে বাসটা একটা স্টপেজে থামার পর মনে হলো এই জায়গাটা আমি চিনি! আমি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচিছলাম। বাসের হেল্পারকে জিজ্ঞস কললাম-এটা কোথায়? "বেতাই"। হেল্পার জবাব দিল। আমি তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে বাস থেকে নেমে গেলাম।

পেছন থেকে হেল্পার বলল-"তুই না শিকারপুর যাবি বলছিলি"? আমি কোন কথা না বলে আর এক দিকে সরে গেলাম। বুঝতে পারলাম শিকারপুর আরও দূরে। বাসটা ছেড়ে চলে গেল। বাস স্ট্যান্ডের কাছেই একটা মুদি দোকানে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম -‘এখানে নিরঞ্জনের দোকান কোনটা’? যায়গাটা ছোট। প্রথম জন বলতে না পারলেও এর পরে আর জনকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল- ওই যে ছোট বটতলা, ওর পাশেই তিনটে দোকানের পরে।

আমি কথামত সেই দোকানে গিয়ে সেই বৃদ্ধকে দেখলাম না। একজন ফর্সামত লোক বসে আছে একটা ছোট বাক্সো সামনে নিয়ে। লোকটা চিকন লিকলিকে। তার কাছে নিরঞ্জনের নাম জিজ্ঞেস করতেই বলল-‘আমার নাম নিরঞ্জন, কেন কি চাও’? আমি সেই বৃদ্ধের সাথে আমাদের কি কি কথা হয়েছিল সব খুলে বলার পর তিনি বললেন- ‘বাবা তো এখন নেই, তেহট্ট গেছে মাল আনতে’। আবার চুপ করে বসে থাকায় তিনি আমার আসল ঘটনা জানতে চাইলেন।

আমি সব খুলে বলার পর বললেন- রাস্তার ওপারে একটা হাইস্কুল আছে, ওখানে রোজই মুক্তিযোদ্ধারা আসে। কেউ কেউ থাকে আবার কেউ কেউ পরদিন চলে যায়। ওটা একটা অস্থায়ী ক্যাম্প। তুমি ওখানে খোঁজ করো। তিনি হেসে হেসে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করলেন না।

আমার মনে হচ্ছিল তার বাবা থাকলে নিশ্চই আমাকে আদর করে অনেক কিছু করতেন। আমার যে রাগ হচ্ছিল তা নয়, কেমন যেন মনে হচ্ছিল-উনি আমাকে কাছে ডেকে বসতে বললেন না কেন? রাস্তা পার হয়ে সেই হাই স্কুলে গিয়ে দেখলাম সত্যিই অনেক মুক্তিযোদ্ধা। সবাই ভীষণ ব্যস্ত। কারোরই যেন কথা বলার অবসর নেই। প্রথম কয়েকজনকে কিছু জিজ্ঞেস করতেই তারা যার যার কাজে চলে গেলেন।

আবার একজনকে জিজ্ঞেস কললাম। এবার তিনি আমার কথা শুনতে চাইলেন। আমি আগ্রহী হয়ে তাকে সব বলার পর তিনি আমাকে আদর করে বললেন- "এখানে এখন এই নামে তো কেউ নেই বাপ, তবে রোজই নতুন নতুন লোক আসে। হয়ত এমনও হতে পারে তোমার বাবা বেঁচে আছেন, এবং এখানেই এসে আবার বর্ডারে চলে গেছেন"! তার সাথে যখন কথা বলছি সে সময় আর একজন এসে ঘটনা কি জানতে চাইল। সেই প্রথম জন তাকে বলার পর দ্বিতীয় জন বলল-"আসো, আমার সাথে আসো"।

আমি তার সাথে চলে গেলাম। তিনি এ ঘর ও ঘর আমাকে নিয়ে ঘুরে একটা লম্বা ঘরের কাছে এসে বললেন-এখানে একজন ইনামুল আছে, দাঁড়াও দেখি। ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল যার কথা বলা হচ্ছে তিনি ইনামুল ঠিক তবে আমার বাবা নয়। তিনিও অন্য অনেকের মত আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। আমি ওখান থেকে বেরিয়ে এসে কি করব ভাবতে ভাবতে শহরের এক প্রান্তে বিশাল বট তলায় কালী মন্দিরের কাছে চলে গেলাম।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। আমি মন্দিরের পাশেই বসে আছি। কি ভাবে অনেক রাত হয়ে গেল বুঝিনি। ওই মন্দিরেই প্রসাদ খেলাম। আতপ চাল ভেজানো, কলা, চিড়া আর দই দিয়ে মাখানো।

এর আগেও কৃষ্ণনগরে একরাতে মন্দিরের খাবার খেয়েছিলাম। রাতে আর কোথাও গেলাম না। শুয়ে পড়লাম মন্দিরের বারান্দায়। সকাল হলে আবারো সেই ক্যাম্প। আবারো নেই।

এদিন সেই বৃদ্ধকে (নিরঞ্জনের বাবা) পেলাম। তিনিও আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বললেন। সাথে এই কথাও বললেন-তোমরা কোথাও থাকার যায়গা না পেলে তোমার মাকে নিয়ে এখানে চলে আসো। আমার একটা চালা ঘর আছে সেখানে থাকতে পারবে। কেন জানিনা এই লোকটকে আমার আপন দাদু মনে হচ্ছিল।

রাতে মন্দিরে ছিলাম শুনে বললেন-‘কেন, আমার এখানে আসতি পাইরতে, আইসলে না কেন? আর আইজ যদি না ফিরে যাও তালি আমার এইহেনে থাকতি পারবা’। আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে আবার বেরিয়ে পড়লাম। সারা বিকেল, সন্ধ্যা এদিক ওদিক ঘুরে আবার রাতে সেই হাইস্কুল ক্যাম্পে গিয়ে আবার খোঁজ নিলাম। আবারও হতাশ হতে হলো। তবে আজ সেই লোকগুলো জানাল –"আজ রাতে একটা টিম আসার কথা আছে"।

এই কথা শুনে আমি আজ আর মন্দিরে গেলাম না। ওই ক্যাম্পের যে বড় ঘরটা তার বারান্দায় বসে থাকলাম। ক্রমে রাত বাড়তে থাকল। এক সময় ক্লান্ত আমি কুন্ডলি পাকিয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক রাতে ঘুমের ভেরতেই আবছা শুনতে পেলাম অনেক লোক কথা বলতে বলতে সেই ঘরে ঢুকছে।

আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার কোন স্বপ্নের কথা মনে থাকেনা। কিন্তু ঘুমালেই স্বপ্ন দেখি আমি পথে পথে বাবাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। খুব সকালে দরজার খিল খোলার শব্দে ঘুম ভাঙ্গলেও আমি শুয়েই ছিলাম। কয়েকজন লোক কথা বলছে।

কিছু কিছু শুনছি কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। তারপর আমার কাছে এসে কে যেন বলল-‘হ্যাঁ এখানে, এই তো! এই ছেলেটাই....." আমি দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিলাম। কে যেন আমাকে টান দিয়ে ঘুরিয়ে দিল! আমার পাশে দাঁড়ানো লোকটি একটু ঝুঁকে আছেন। আমার মুখটা দেখেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন! আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম! বাবা! আমার বাবা! আমার বাবা! আমার বুকের ভিতর থেকে ঠেলে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে.....মুহূর্তে বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন.....কাকে যেন বললেন-তোমরা রাতে বল নাই কেন, আমি ঘরের ভিতর সারারাত, আমার আমার ছেলে এখানে এই অবস্থায়......বাবা বাচ্চাদের মত কাঁদছেন! আমিও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছি.....আমার মাথায় টপ টপ করে বাবার চোখের পানি পড়ছে.....আমি বাবার বুকে মুখ ঘসে চলেছি.... সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে.....মনে হলো দূরে কোথাও একসাথে অনেকগুলো বাজ পড়ল.....কতক্ষণ এভাবে ছিলাম জানিনা, বাবা আমার মুখটা সোজা করে শুধু বললেন-মা? ‘সবাই আছে’ বলতেই আবার তার বুকে আমার মাথা চেপে ধরে রাখলেন.....আমার মনে হলো আমি বাবার বুকে মাথা রেখে যেন কতকাল হয় কাঁদছি.....বাবা আমাকে কোলে করে উঠে দাঁড়ালেন, দেখলাম আরো কয়েক জনের চোখেও পানি। আমার মাথায় অনেক অচেনা হাত।

পূব দিক থেকে লাল হয়ে সূর্য উঠছে.....বাবার গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মাথা রেখে মনে হলো আমার ঘুম পাচ্ছে........... চলবে............... পর্ব > ১ পর্ব > ২ পর্ব > ৩ পর্ব > ৪
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।