আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দ্য মিলিয়ন ডলার হোটেল: ভালোবাসা আর পরিতৃপ্তির গল্প (একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনা)

কখনো চাই নাই দূরে থাকি...তবু দূরগুলো বারে বারে আসে...

সেই প্রথম জমানায়, যখন আরবের লোকেরা...এইভাবেই শুরু করার ইচ্ছা ছিলো লেখাটারে। যদিও আরবের লোকেরা না এই আমরাই সারাক্ষণ অলটারনেটিভ হওনের ঝোঁকে লেখালেখি কিম্বা চলচ্চিত্র বানানের লেইগা এমন সব বিষয় ভাবতাম যা এর আগে কখনো হয় নাই। এইটা নিজেরে অন্যের চাইতে আলাদা হিসাবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নাকি আসলে আন এক্সপ্লোর্ড এরিয়া এক্সপ্লোর করার জন্য তারুণ্যের বেসিক চাহিদা সেইটা নিয়া বিতর্ক হইতে পারে। কিন্তু আমরা অলটারনেটিভ থাকতাম, থাকতে চাইতাম। তার ছায়া পড়তো চেহারায়-পোষাকে-চিন্তায় কিম্বা কথা কওয়ার ধরণে।

আর তাই ২০০০ সালে এক এনজিও'র প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ কর্মশালায় একটা ডক্যুমেন্টারী বানানের সুযোগ পাইয়া প্রথমেই আমি পরিকল্পণা করি বাংলাদেশের একটা সুনির্দিষ্ট জেলা ঝিনাইদহে'র বিশ্বখ্যাত(!) আত্মহত্যা প্রবণতার উপর কিছু করন যায় কীনা। আত্মহত্যা প্রবণতা বিষয়টা আমাগো নব্বই দশকীয় শাহবাগীয় আড্ডায় একটা লাক্সারী ছিলো বহুকাল। আমরা তিন বন্ধু শামিম কবির, রায়হান আর আমি কোন এক বৈকালিক আড্ডায় ঠিক করছিলাম কে কবে আত্মহত্যা করুম। বন্ধু শামিম তার কথা রাখতে গিয়া বরং বছর চারেক আগেই ২৪ বছর বয়সে আত্মাহুতি দেয়...রায়হান তার সময়টারে মনে রাখে নাই মনে হয়...তার ৩০ অতিক্রান্ত হইছে বহুকাল আগে আর আমার সময়টা আগাইয়া আসতেছে ধীরে ধীরে। আর মাত্র ২ বছর বাকী।

জীবনের বিভিন্ন বাকে-পরিবর্তনের কারণে আত্মহত্যার এই চিন্তা আমার জীবনে প্রায়শঃই আসে... আর সেই কারণেই উইম ওয়েন্ডার্সের মিলিয়ন ডলার হোটেল সিনেমার প্রথম দৃশ্য বা টাইটেল দৃশ্যই আমারে শুরুতেই নিয়া যায় অন্য এক জগতে...হাতছানি দিয়া ডাকে তার দেহের পরতে পরতে দৃষ্টি রাখতে। আমার প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম কইতে গেলে আগে যে কোন সময় বিপদে পরতাম...ভাবতে হইতো...স্মৃতি থেইকা হয়তো আট/দশটা ছবির নাম কইতাম সংশয়ে। কিন্তু মিলিয়ন ডলার হোটেল ম্যুভিটা দেখনের পর আমি এক বন্ধুরে বলি, আলটিমেট সিনেমা দেখলাম। সে বেশ ইঙ্গিতবহ দৃষ্টি দিয়া আমারে জিগায় আলটিমেট সিনেমা বলতে কি বুঝাইতে চান? এইবার আমি বিপদে পরুম বইলাই নিশ্চিত মনে করে সে। এইরম ঘোষণামূলক বক্তব্য চিরকালই বিব্রতকর।

আমি নিজেও হয়তো এই ধরণের বক্তব্য শুনলে বিরক্ত হইতাম। আমারে পাল্টে দিলেন ওয়েন্ডার্স... যদিও এই ছবির গুরুত্ব নিয়া মার্কিন সাম্রাজ্যে বেশ নেতিবাচক গুরুত্ব তৈরী আছে শুরু থেইকাই। এই ছবি নিয়া সমালোচনা হইলো ছবিরে টাইনা বড় করা হইছে। অহেতুক বিরক্তি তৈরী করা হইছে। তয় উল্লেখযোগ্য হইলো এই ছবি কেবল মার্কিনী বাণিজ্যেই খারাপ ইম্প্রেশন তৈরী করছে।

ইউরোপ কিম্বা এশিয়ান দর্শকেরা মিলিয়ন ডলার হোটেল ছবির ব্যাপারে ভিন্নবোধ করছে সবসময়েই...বার্লিনে একবার রুপার ভল্লুকও মিলছে প্রতিযোগিতার ক্যাটেগরিতে। তয় অন্যের প্রিয়তা কিম্বা অপ্রিয়তা নিয়া আমি আসলেই ভাবিত না আমার নিজের ঘোষণামূলক বচনে। একটা চলচ্চিত্র যেইসব বিষয়ের কারণে মহত্ব অর্জন করে তার সকল উপস্থিতি আমি দেখি মিলিয়ন ডলার হোটেলে। এই ছবিতে ওয়েন্ডার্স ভালোবাসার যেই গল্প বলতে চাইছেন তারে আমার বিশ্বাস্য মনে হইছে। এই ছবিতে সংলাপের বাহুল্য ছিলো না...বরং ছিলো সিনেমাটিক ইমেজের অনুবাদ।

ছবির সকল চরিত্র অনেক ক্লীশে আইকনিক রূপে ছিলো। প্রত্যেক চরিত্রই সম্পূর্ণতা পাইছে নিজের নিজের বৈশিষ্ঠ্য নিয়া। আমি নিজে একজন ক্লীশে ইমেজের ভক্ত হিসাবেই এই ছবি দেখছি...যেমন দেখি টারান্টিনোরে। একটা ছবি পূর্ণতা পায় তার সিনেমাটোগ্রাফিতে। মিলিয়ন ডলার হোটেল চলচ্চিত্রের অনেক মুহুর্তের নজীর পাওন যায় একবিংশ শতকের অনেক সিনেমায়।

আর এই ছবির সাউন্ডট্র্যাক আর গান আমারে কেবল মুগ্ধতা নয়...আরো অন্য কিছু দিছে। তয় আমার ভালো লাগা অন্য সব সিনেমারে ছাপাইয়া যায় ছবির একটা সংলাপ শুননের পর, after I jumped it occurred to me life is perfect, life is the best, full of magic, beauty, opportunity... and television... and surprises, lots of surprises, yeah. And then there's the best stuff of course, better than anything anyone ever made up, 'cause it's real... ঝিনাইদহে আত্মহত্যা প্রবণতা নিয়া যখন গবেষণা করতেছিলাম তখন আত্মহত্যার প্রচেষ্টা কইরা বাইচা যাওয়া এক শাজাহানও আমাগো এমন পরিতৃপ্তির গল্প শুনাইছিলো। এই সিনেমার প্রোটাগনিস্ট টমের মতোন শাজাহানও যখন তার ভালোবাসার দিশা পাইছিলো তখন আত্মহননরেই ভাবছিলো পরিতৃপ্তির পরিনতি হিসাবে... জানি অনেকেই অপছন্দ করবো তবু সিনেমার গল্পের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমি দিতে চাই, যারা সিনেমা দেখার আগে গল্প শুনতে অপছন্দ করেন তারা পইড়েন না লস এঞ্জেলস শহরের মিলিয়ন ডলার হোটেল তার ঐতিহ্য হারাইয়া ফেলে অবস্থানগত কারণে। একটা সময় মূলতঃ সমাজের অনাকাঙ্খিত মানুষের আবাসে পরিনত হয়। সেইখানে থাকে ছবির প্রোটাগনিস্ট টম, ইলোয়...জেরোনিমো, ডিক্সি আরো অনেকেই।

একসময় সেইখানে মিডিয়া মুঘল ইহুদী গোল্ডকিসের পূত্র ইৎজি মুক্ত জীবনের অন্বেষায় আইসা উপস্থিত হয়। সে পুরা হোটেলবাসীর পছন্দের মানুষ হইয়া উঠে। কিন্তু হঠাৎ একদিন ইৎজি ছাদ থেইকা পইড়া মারা যায়। তার মারা যাওয়াটারে সবাই আত্মহত্যা হিসাবে ধইরা নিলেও পিতা গোল্ডকিস মনে করে কোন ইহুদী ধর্মাবলম্বী কখনোই আত্মহননে যাইতে পারে না। আর তাই সে একজন এফবিআই এজেন্ট নিয়োগ দেয় এর রহস্য উদঘাটনের জন্য।

একজন মূর্তিমান আতঙ্ক এজেন্ট স্কিনার অনেক চেষ্টা কইরাও হোটেলবাসীগো থেইকা কোন কথা বাইর করতে পারে না ইৎজি'র আত্মহত্যা বিষয়ে। শেষে ইৎজির সবচাইতে কাছের মানুষ, একজন মানসিক প্রতিবন্ধি টমের থেইকা কথা বাইর করনের জন্য ভিন্ন কৌশল নেয় সে। টম তার প্রতিবেশী ইলোয়'এর প্রেমে তখন হাবুডুবু খাইতেছে। ইলোয়'রে বাধ্য করা হয় টমের সাথে প্রেমের অভিনয় করতে। ইলোয় শুরুতে অনেক বিরক্ত হইলেও সে টমের ঘরে যায়।

তারা কথা বলে। আপাতঃ প্রতিবন্ধি টমের মধ্যে অন্য একজন মানুষের অস্তিত্ব খুঁইজা পায় ইলোয়... কিন্তু ইৎজি বিষয়ে অনেক কিছুই এড়াইয়া যাইতে থাকে টম। একসময় মিডিয়া এই ঘটনা নিয়া মাতামাতি শুরু করলে হোটেলবাসীরা সকলে মিলা ব্যবসার পরিকল্পণা শুরু করে। তারা জেরোনিমোর উদ্ভট আলকাতরা শিল্পরে ইৎজির নতুন ফর্মের পেইন্টিং হিসাবে উপস্থিত করে। যেই পেইন্টিং বিক্রীর অর্থ ভাগাভাগি কইরা তারা তাগো নিবাসরে আবারো সুখের মুখ দেখাইতে চায়।

কিন্তু জেরোনিমোরেই হত্যাকারী হিসাবে গ্রেফতার কইরা বসে এজেন্ট স্কিনার। তখন হোটেলবাসী আবারো বিপদে পড়ে। কারণ এইসব পেইন্টিংয়ের মালিকানা জেরোনিমোর। তারা পরিকল্পণা কইরা টমরে ম্যানেজ করে হত্যাকারী হিসাবে বক্তব্য দিতে। টম সারাজীবন একজন আলোচিত মানুষ হইতে চাইছে।

সে মুগ্ধ করতে চাইছে তার চারপাশের মানুষরে। আবার হোটেলবাসীরাও নিশ্চিত ছিলো যে একজন মানসিক প্রতিবন্ধি হিসাবে টমের অপরাধ খারিজ হইয়া যাইবো বরং সে মানসিক হাসপাতালেই সুখে দিন কাটাইতে পারবো। টম হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে ক্যামেরায়। পুলিশ তার পেছনে ছোটে। কিন্তু এজেন্ট স্কিনার তারে পালাইয়া যাইতে সহায়তা করে, কারণ সে বিশ্বাস করে না টম এইরম কিছু করতে পারে।

ইলোয় পালাইতে চায় টমরে নিয়া। কিন্তু টম বাইছা নেয় আত্মহননের পথ। ছবির শুরুর দৃশ্যের পুরাটা আমরা দেখতে পাই আবার শেষে। এই ইমেজেই আমি আমার ভালো লাগা খুঁইজা পাই। আশা করি এই লেখার পাঠকেরা এখনো দ্য মিলিয়ন ডলার হোটেল দেখার আগ্রহ হারান নাই।

কারন এই ছবির গল্প কেবল ভালোবাসা আর ত্যাগের না। আমার বরং এই গল্পরে পরিতৃপ্তির গল্প মনে হইছে। মনে হইছে মানুষের সারাক্ষণ নিজের অস্তিত্ব খুঁজনের যেই প্রচেষ্টা তার চিত্রায়ণ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।