আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুন্দরবনের মুন্ডাতে দুই রাত

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
গাল্লী আমার বাসার সুইপার। তার বাড়ি সুন্দরবনের কয়রার দক্ষিন বেদকাশীর গাবুরা ইউনিয়নের মুন্ডা গ্রামে। গাল্লী আদিবাসী। মুন্ডা শব্দের অর্থ বুনো।

ওদের জীবন নিয়ে আমাদের কৌতুহলের শেষ নেই। আমরা প্রায়ই বলি --এবারে গাল্লীর বাড়ীতে বেড়াতে যাব। যাব যাব করে পাঁচ বছর হয়ে গেছে যাওয়া হয়নি। এবারে ওর ছোট বোন এর বিয়ে, যেতেই হবে। আমাদের চেয়ে বাচ্চাদের উৎসাহ বেশী।

বাচ্চাদের উৎসাহের কাছে আমরা পরাজিত হলাম এবং ছুটি দেবার সময় গাল্লীকে বলে দিলাম ৫ তারিখে আমরা কয়রায় সকালে পৌঁছাব। তুমি হাজির হবে। তার আগে আমাদের জন্য একটা টয়লেট বানাবে। আর কোন কিছুতে কোন অসুবিধা হবে না বলেই বিশ্বাস আমাদের। আমরা যাব সুন্দরবন এই কথা শুনে আমাদের দলটি বেশ ভারী হয়ে গেল।

রাত সাড়ে দশটার দিকে লঞ্চে করে খুলনা থেকে কয়রার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আমাদের গন্তব্য মুন্ডা। সকালে পৌঁছালাম কয়রা। সেখান থেকে রিক্সা ভ্যানে করে গেলাম গাবুরা ইউনিয়নের মুন্ডা গ্রামে। আমাদেরকে পথ চিনিয়ে নেবার জন্য অবশ্যই উপস্থীত ছিল গাল্লী।

ঘন্টা দুই চলার পর পৌঁছালাম গাল্লীর গ্রাম মুন্ডাতে। মুন্ডা শাকবাড়ীয়া নদীর তীরে অবস্থিত। ওখানে পৌঁছেই সবাই নেমে পরলো বিভিন্ন ধরনের ছবি তুলতে। ভ্যানে বসে থেকে থেকে গায়ে হাতে পায়ে যে ব্যাথা হয়েছিল তা ভুলে গাছে চড়তে উৎসাহী হয়ে পরলাম। আদীম অধিবাসীদের সাথে আমরা এক হয়ে গেলাম হাসিতে আনন্দে।

এখানে কেউ একবার ও বললো না যে এখানে কষ্ট করে থাকতে আমাদের বেশ কষ্ট হবে বা তাদের গরীব খানায় আমরা কীভাবে থাকবো? কত সুন্দর সহজ সরল ওদের জীবন। ওদের জীবন যাত্রা দেখে আমরা যত অবাক হই ওরা ততই উৎসাহ ভরে আমাদেরকে দেখায় ওদের জীবন বৈচিত্র। ওদের ভাষাও বিচিত্র। শুধু গাল্লীর পরিবার সহ দুই একটি পরিবার কিছু কিছু বাংলা বলে ও বুঝে। আমাদের উত্তর বঙ্গে যেমন হাড়িতে ভাত পঁচিয়ে দেশী মদ বানায় যা হাড়িয়া নামে পরিচিত তেমনি ওরাও হাড়িতে ভাত পঁচিয়ে তৈরী করে হাড়িয়া মদ।

মদ তৈরীতে কোন ভিন্নতা নেই সারা বঙ্গে মনে হয়। আমার ছেলে এবং মেয়ে এল আমার সামনে মুখে একগাল হাসি ও জ্বল জ্বলে চোখ নিয়ে। ওদের জামার কোঁচর ভর্তী শামুক ঝিনুক। আর গাল্লীর ভাইয়ের ছেলের হাতে পাতায় মোড়া কি যেন? সে পাতা খুলে দেখালো ইয়া মোটা মোটা কেঁচো। কেঁচো যে এত মোটা হয় আমার সত্যিই জানা ছিল না।

আমার মেয়ে উৎসাহে উত্তেজিত হয়ে গরগর করে বলে গেল-- আমরা এখন পিকনিক করবো। ও আগুন জ্বালাবে। এগুলি পুড়াবো তার পর মজা করে লবন দিয়ে খাব। লবন না দিয়েও খাওয়া যায়। খুব মজা।

কেঁচোগুলি কিলবিল করছে। গা ঘিন ঘিন করে উঠলো। কিছু বলতে যাবার আগ মুহূর্তে জানু মানা করলো--কিছু বলো না । দেখো ওরা খাবে না। রাতে বিয়ের খাওয়া দাওয়া মহা হৈচৈ।

খুব ভালো লাগছিল। ওদের খাবারের মেনুতে ছিল ইঁদুর পোড়া, বাদুর ভাজি, শূকরের ঝাল মাংস এবং চাল ডাল সব্জী কেঁচো, শামুক , ঝিনুক, তেল, লবন, মরিচ সব মিলিয়ে মাটির হাড়িতে রান্না করা ভাত/খিচুরী বা পোলাও এর সঙ্গে হাড়িয়া। আমাদের রাধুনি আমাদের জন্য রান্না করেছে আমরা তাই খেলাম। সবাই মিলে ওদের সাথে কোমর ধরে নাচলাম। আমার ননদের ছেলে পলাশ এসে বললো --মামী সসের বোতলটা কী এনেছেন? আমি বললাম --না ।

সে বললো-- আনা লাগতো ?!! কে জানে এত্ত অমৃত এখানে আছে? বললাম --তুমি কি খাবে সস দিয়ে ? পলাশ নির্বিকার ভাবে বলল-- ইঁদুর পোড়া আর বাদুরের চিকেন ফ্রাই। --মানে??? --বাদুরের চিকেন ফ্রাইটা দারুন। ওরা একটু হাড়িয়া দিয়ে মেখে দিয়েছিল। কিন্ত ইঁদুরটা খেতে যেয়ে মনে হচ্ছে একটু সস হলে ভাল হত। পলাশের বউ এর চোখ কপালে।

ও শুরু করলো চিৎকার। ---তুমি সব বমি করে বের করে পুরা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করলেও আমি তোমারে আর আমার বিছানায় জীবনে নেব না। তুমি এখানেই থাকো??? তোমাকে ঢাকা নিয়ে সম্পুর্ন স্টমাক ওয়াস করাতে হবে তবেই যদি পরিস্কার হও। কিছুক্ষন পর পলাশের বউ শুরু করলো বমি। সেই বমি আর থামে না।

আমরা পরলাম মহা বিপদে। এখানে নেই কোন হাসপাতাল। আমাদের গ্রুপের আমার ডাক্তার ননদ তার সাধ্যমত চেষ্টা করেও বমি বন্ধ করতে পারলো না। ঘুমের ঔষধ কারো কাছে নেই। থাকলে ঘুম পাড়ানো যেত।

সব বকা পলাশের ঘাড়ে। এখন বউ এর যদি কিছু হয়। এই জায়গায় কোন যানবাহন নেই। হেঁটে যেতে হবে কয়রা পর্যন্ত। ভ্যান আসার কথা বলা আছে পরদিন বিকালে।

কারন কয়রা থেকে খুলনার উদ্দ্যেশে লঞ্চ ছাড়বে সন্ধায়। এবারে এল গাল্লী। আকর্ণ হাসি বিস্তৃত করে সে বললো--যদি বলেন তো আমাদের কবিরাজ ঔষধ দেবে। কবিরাজ বলেছে ঘুমালেই ঠিক হবে। আমাদের ডাক্তার বুবুরও ঐ মত।

ঘুমালেই ঠিক হবে। আমি তাতেই রাজী। বুবু বলল যদি ঔষধ খেয়ে হিতে বিপরীত হয়, আমি বললাম --আল্লাহ ভরসা। গাল্লী বললো --কেন বলো মেমসাব আল্লা ভরসা? আমাদের কবিরাজ তো রামভক্ত মানুষ? বল রাম রাম। ভগবান ভরসা।

কবিরাজের ঔষধ এল। আর তা হলো ইঁদুরের চর্বির সাথে হাড়িয়া মিশেয়ে তৈরী। যাক বউ সাথে সাথে ঘুম। পরদিন সকালে বউ সুস্থ্য। বলা হল তুমিও হাড়িয়া এবং ইঁদুর খেয়েছো।

অতএব শোধ বোধ। দয়া করে আর বমি করো না। ওদের বিয়ে হয় অদ্ভুত ভাবে। সেই সাথে ওদের জীবন যাত্রা নিয়ে পোস্ট দেব পরের পর্বে।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।