আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় 'ফেমিনিনিটি' উৎপাদন: বাজার- পুরুষতন্ত্রের একটি 'পরিমিত' রূপ

munirshamim@gmail.com
পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন অথবা বাজার অর্থনীতি যে নামে ডাকি না কেন এ শব্দগুলোর প্রায়োগিক লেবাসে যে আর্থনীতিক-রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগুলো এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় সচল রয়েছে, সেখানে মুনাফা কেবল উপায় নয়, একমাত্র লক্ষ্য। ফলে সকল আয়োজন এ মুনাফাবাদিতাকে ঘিরেই আবর্তিত ও বিবর্তিত হয়। কখনও প্রকাশ্যে, আবার কখনও অপ্রকাশ্যে। এ মুনাফাকেন্দ্রীক বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থাটির টিকে থাকা ও বিকাশে প্রধান দুই প্রদায়কের একটি হচ্ছে তেল-গ্যাস ও যুদ্ধের অর্থনীতি, অপরটি পুরুষতন্ত্রের অর্থনীতি। প্রথমটির ওপর শেষেরটির শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে, প্রথমটি প্রায়শ: দৃশ্যমান, তথ্য যোগাযোগ প্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকারের কারণে প্রান্তিক জনপদের মানুষজনও আঁচ করতে পারে।

কিন্তু শেষেরটির প্রক্রিয়াগুলো প্রয়োগ হয় বেশিরভাগ সময় সাংস্কৃতিক ফর্মে, বিনোদনের মোড়কে। এখানে নারীর অংশগ্রহণ বর্নীল এবং দৃশ্যমান বলে এটি সচরাচর সনানতন পুরুষতন্ত্র থেকে নারীর মুক্তি হিসেবে অনূদিত হয়। সনাতন পুরুষতন্ত্রের বলয় থেকে নারী যে একটি মাত্রায় হলেও বেরিয়ে আসে এ কথাও সত্যি। এ আপাত সত্যের আড়ালে আসল সত্যটা ঢাকা পড়ে থাকে। ফলে বাজারী পুরুষতন্ত্রের নতুন শৃঙ্খলের অনেকটাই অদৃশ্য রাখা সম্ভব হয়।

অন্তত আমজনতার কাছে। বাজার অর্থনীতির মুনাফাবাদী মতলবটাকে কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বশীলতা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এ রকম বাজারী পুরুষতন্ত্রের একটি সা¤প্রতিক দেশজ পরিবেশন হচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরে আয়োজিত লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা। আমি বলছি না যে, বাংলাদেশের মডেলিং-টিভি নাটক ও অভিনয় জগতে এ প্রতিযোগিতার কোন অবদান নেই। বরং স্বীকার করতেই হবে যে, এ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এসে পরবর্তীতে বেশ কয়েকজন খুব সরবভাবে মিডিয়ায় নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন এবং কৃতিত্বের সাথে কাজ করছেন।

তবে এ প্রতিযোগিতার দৃশ্যমান সফলতাটাকে চিহ্নিত করা এ লেখার উপলক্ষ্য নয়। বরং এ ধরনের প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে বাজার-পুরুষতন্ত্রের উৎপাদন, পুনরুৎপাদন হচ্ছে এবং বাজার-পুরুষতন্ত্রের একটি স্থানীয় রূপ পরিগ্রহ করছে তার প্রতি যতকিঞ্চিৎ নজর দেয়া। প্রসঙ্গত বলা দরকার মতাদর্শ ও ব্যবস্থা হিসেবে পুরুষতন্ত্রের প্রকাশ সমাজ ও সময় নিরপেক্ষ নয়। আর এ কারণেই বাজার-পুরুষতন্ত্রের বহি:প্রকাশেও ভিন্নতা রয়েছে। তবে বাজার ভিত্তিক পুরুষতন্ত্র ধর্ম ও প্রথাভিত্তিক পুরুষতন্ত্রের মতো কঠোর নয়, বরং নমনীয়।

স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। ঐতিহ্যভিত্তিক পুরুষতন্ত্রের অতটুকুই বদল করে, যতখানি বদল কর্পোরেট স্বার্থের জন্য দরকার পড়ে। তবে সকল পরিবর্তন-পরিবর্ধন এর লক্ষ্য এক। কর্পোরেট পণ্যের প্রসার। ভোক্তার মনে ক্রমাগত অনুভূত চাহিদা তৈরির মাধ্যমে নির্দিষ্ট পণ্যের বাজার তৈরি।

এ প্রক্রিয়ায় নারী একদিকে পণ্যের প্রসারে ভূমিকা রাখে। অপরদিকে নিজেও পণ্যে রূপান্তরিত হয়। বাজার-পুরুষতন্ত্রে নারী একই সাথে কর্তা এবং কর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়। কিন্তু কর্তা হিসেবে স্ব-পরিচালিত নয়। কর্পোরেট পণ্যের বিকাশের উদ্দেশ্যে গৃহিত শিল্প ও সংস্কৃতির ব্যাকরণ ঠিক করে দেয় কর্তা হিসেবে তার গতি-প্রকৃতি ও গতিশীলতা।

নানা প্রতিযোগিতা-আনুষ্ঠানিকতার নামে তার চলন, কথাবার্তা, হাসি, শরীর প্রতিটির চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে। পুরুষতান্ত্রিক চশমায়। অনুষ্ঠানের বিচারক কি নারী কী পুরুষ সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিচারের চোখগুলো ঠিক করে দেয় বাজার অর্থনীতি। ফলে তাদের বিচার-বিশ্লেষণগুলোও পণ্যে রূপান্তরিত হয়।

নারীর সৌন্দয্য বিশ্লেষণের অনুষ্ঠান এর বিকিকিনি চলে টিভির পর্দায়। একটু গোড়ার দিকে ফেরা যাক। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশের প্রসাধন বাজারে লাক্স এর দাপট ছিল এক চেটিয়া। পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্য রক্ষায় সাবান একটি লিঙ্গ নিরপেক্ষ উপাদান এবং নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য দরকারি হলেও একেবারে গোড়াতেই লাক্স প্রকাশ্য ভোক্তা হিসেবে নারীকে টার্গেট করেছে। আবার লাক্সের প্রচার-প্রসারেও ব্যবহার করেছে নারীকে।

এ প্রক্রিয়াটিই অনুসরণ করেছে পরবর্তীতে প্রসাধন বাজারে আসা কোম্পানীগুলো। বলিউড এবং বাংলাদেশের প্রায় সব বিখ্যাত অভিনেত্রীরাই লাক্সের বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছেন। নারীর সৌন্দর্য বিচারে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশীয় পুরুষতন্ত্রের একটি বর্ণবাদী অবস্থান রয়েছে। ফর্সা হওয়াটা এখানে নারী সৌন্দর্যের প্রধান নিয়ামক। লাক্স তার প্রচার-প্রসারে এ বর্ণবাদী পুরুষতান্ত্রিক ভাষাটাকেই প্রধান অবলম্বন করে তুলেছে।

বছরের পর বছর। নারীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ও এতিহ্যগত সাংস্কৃতিক-সামাজিক উপাদানগুলোকে কীভাবে কর্পোরেট স্বার্থে ব্যবহার করা হয় এবং সে ব্যবহারের মাধ্যমে কীভাবে পুরুষতন্তের উৎপাদন-পুনরুৎপাদন ঘটে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে লাক্সের বিজ্ঞাপন। ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন তারই উপজাত এবং আরও বেশি করে প্রকাশিত একটি বর্ণবাদী বিজ্ঞাপন। এবার আসা যাক লাক্স-চ্যানেল আই সুপার স্টার প্রতিযোগিতার একটি পর্ব প্রসঙ্গে। গত সপ্তাহে প্রচারিত অনুষ্ঠানে একটি পর্বের নাম ছিল 'ফেমিনিনিটি'।

একটি সমাজের নির্দিষ্ট আবহে নারী হওয়ার মানে কী তা বুঝাবার জন্য এ শব্দটি সমাজতত্ত্বে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সামাজিক পরিসরে নারীর প্রত্যাশিত গুণ ও আচরণ। সুতরাং ফেমিনিনিটি কোন জৈবিক বিষয় নয়। এটি একশোভাগ সামাজিক। তথাকথিত নারীসূলভ আচরণ ও গুণাবলীর সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা।

এবং এটি যেহেতু জৈবিক নয় সেহেতু অবশ্যই পরিবর্তনযোগ্য (জেন ই স্টেটস এন্ড পিটার জি বার্ক, ফ্যামিনিটি/মাসকুলিনিটি, এনসাইক্লোপেডিয়া অব সোসিওলজি)। এখন দেখা যাক লাক্স চ্যানেল আই কী ধরনের ফ্যামিনিনিটি উৎপাদন ও উপস্থাপন করেছে। আলোচ্য পর্বে প্রতোযোগীরা বিভিন্ন ডিজাইনারের তৈরি শাড়ি পরে বিচারকদের সামনে 'বিড়াল হাটা’ (ক্যাটওয়্যাক) হেটে ছিলেন। প্রতিযোগীরা বিচারকদের সামনে আসার আগে উপস্থাপক এর ছোট্র ঘোষণা, আমরা দেখতে চাই আমাদের প্রতিযোগীরা কতখানি চৌকষ, আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারে। সনাতন বাঙালী পুরুষতন্ত্রে চৌকষ, আত্মবিশ্বাসী বা সৃজনশীল হওয়া নারীর প্রত্যাশিত গুণাবলী হিসেবে স্বীকৃত নয়, এগুলো পুরুষের।

সুতরাং উপস্থাপকের এ ঘোষণা শুনে মনে হতে পারে লাক্স-চ্যানেল আই বুঝি বাঙালী পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোয় ফ্যামিনিনিটি সম্পর্কিত প্রবল ও প্রচলিত ধারণাটিকে বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু না, এ পর্বের পুরোটাতেই চৌকষ, আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীলতা খোঁজা হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, বরং নারীর শরীরি উপস্থাপনায়। চৌকষ ক্যামেরার ক্লোজ শর্টগুলো যেসব জায়গায় ধরাবার চেষ্টা করা হয়েছে তাতে যৌনতার উপমহাদেশীয় ধারণাটাই প্রবল হয়ে উঠেছে। সনাতন বাঙালী পুরুষতন্ত্রে নারীর প্রধান পরিচয় যেমন শরীর ঠিক লাক্স-চ্যাানেল আই পরিবেশিত ফেমিনিনিটিতেও নারী কেবলই শরীর। পার্থক্য পরিবেশন ও উপস্থাপনায়।

সনাতন পুরুষতন্ত্রে শরীর ভোগের, কিন্তু এজমালী নয়। ফলে ঘরের বাইরে তাঁর শরীর বাড়তি আবরণে ঢেকে রাখা তার জন্য সাংস্কৃতিক-সামাজিকভাবে বাধ্যতামূলক। আবরণটা কতখানি হবে সেটি আরোপিত হয় তার ধর্ম, শহর-গ্রাম, এমন কি শ্রেণী দ্বারা। আর বাজার-পুরুষতন্ত্রে ঢাকা-না ঢাকার সীমারেখাও নারীর নিজস্ব বিষয় নয়, একশোভাগ আরোপিত, উদ্যোক্তা, ডিজাইনার আর করিওগ্রাফার দ্বারা। দৃশ্যমান শৃঙ্খল এর বদলে অপেক্ষাকৃত অদৃশ্য শৃঙ্খল দ্বারা।

এভাবেই বাজার ভিত্তিক পুরুষতন্ত্রের একটি স্থানীয় অবয়ব গড়ে উঠে। স্রেফ পণ্যের বিকিকিনিটা বাড়াবার জন্য। আর বাজার অর্থনীতি পুরুষতন্ত্রকে উৎপাদন, পুনরোৎপাদন করে। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা (লাক্স, চ্যানেল আই) নারীর ক্ষমতায়নে কর্পোরেট দায়িত্বশীলতা পালন করছেন বলে প্রচার চালান।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।