আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেন লিখি?



কেন লিখি? এই ‘কেন লিখি’ নিয়ে অনেক কথাবর্তা হয়ে গেছে মানুষের মধ্যে। অধিকাংশ গল্পকার কিংবা সাহিত্যিকদের এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে বহুবার। কেন লিখেন? এই প্রশ্নের উত্তর অনেক সময় অনেকে বহুভাবেই দিয়ে গেছেন। আসলে, সমাজের বিভিন্ন বাস্তবতায় আমরা সন্ধিহান হয়ে পড়ি। বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় আমরা আটকে আর্তনাদ করতে থাকি।

তখন তা প্রকাশের কোনো জায়গা আমরা পাই না। তাই মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া হয় লেখা। এই লেখাই অনেক মানুষের জীবনে প্রশান্তি হয়ে দেখা দেয়। তবে লেখালিখি নিয়ে বলতে গিয়ে বাংলার শক্তিধর লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়েই যে সব কথা বলা যায় না, তাই সেই কথাগুলো জানাবার জন্যই আমি লিখি। কথাটি কিন্তু অনেকাংশে যথার্থ।

মানিকের উপন্যাসগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, তিনি সমাজের বহু অসংগতি তুলে এনেছেন অসাধারণ ভঙিমায়। যেমন, মানিক পদ্মানদীর মাঝি উপন্যাসের মাধ্যমে পদ্মা পাড়ের মানুষগুলো জীবনচিত্র তুলে এনেছেন। এমন উপন্যাস বাঙলা সাহিত্যে না থাকলে হয়তো পাঠককুলের তা জানার সুযোগই হতো না। কখনও কোনদিন পদ্মার ভয়াল জীবনযাত্রা অনুভব করানো যেত না সহজে। কিন্তু উপন্যাস তৈরী হওয়ার পর সেখানকার চরিত্রগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সবার কাছে।

চোখের সামনে ভেসে উঠেছে পদ্মা নদী। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে জেলে পল্লীর চিত্র। তাই মানিকের ক্ষেত্রে অনেকটাই “কেন লিখেন?” প্রশ্নের উত্তর যথার্থ ভাবে দিতে পেরেছেন বলেই আমার মনে হয়। আর মানিক বলেছেন আরও কিছু। যেমন, আমার লেখাকে আশ্রয় করে সে (পাঠকদের উদ্দেশ্য করে) কতগুলো মানসিক অভিজ্ঞতা লাভ করে।

আমি লিখে পাইয়ে না দিলে বেচারি যা কোনদিন পেত না। কিন্তু এই কারণে লেখকের অভিমান হওয়া আমার কাছে হাস্যকর ঠেকে। পাওয়ার জন্য অন্যে যত না ব্যাকুল, পাইয়ে দেওয়ার জন্য লেখকের ব্যাকুলতা তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। মানিক লেখকদের নিছক কলম-পোষা মজুর বলে উল্লেখ করেছেন। কলম দিয়ে যারা লিখে চলেন তারা তো কলম পোষা মজুরই হবে।

এটাই স্বাভাবিক। অনেকে আবার সাহিত্যের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে যান যে তিনি খাতা কলম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে নেমে পড়েন। যেমন, নোবেল বিজয়ী লেখক, অরহ্যান পামুক তার “পরোক্ষ লেখক” প্রবন্ধে বার বার সাহিত্যকে তিনি সাহিত্য-ডোজ হিসেবে আখ্যা করেছেন। এই কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ডায়াবেটিস রোগীদের প্রতিদিন একটি করে ইঞ্জিকশন নেওয়ার দরকার পড়ে, তখন অধিকাংশ লোকের মতোই, তাদের জন্য আমার খারাপ বোধ হতো। আমি এমনকি তাদেরকে অর্ধমৃত বলে ভাবতাম।

সাহিত্যের প্রতি আমার নির্ভরতা অবশ্যই আমাকে একইভাবে অর্ধমৃত করে। আমি যখন তরুণ লেখক ছিলাম, আমি অনুভব করতাম অন্যেরা আমাকে “ বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ” মনে করতো এবং আমাকে অর্ধমৃত বলে সাব্যস্ত করতো। অথবা সম্ভবত সঠিক কথাটা হচ্ছে “ অর্ধভূত ”। আমি এমন চিন্তাও লালন করছি যে, আমি পূর্ণ মৃত এবং সাহিত্য দিয়ে আমার মরদেহে জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য শ্বাস নিতে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আমার জন্যে, সাহিত্য হচ্ছে ওষুধ।

অর্থাৎ সাহিত্যের দ্বারা পামুক এতই আসক্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, প্রতিদিন তাঁর সাহিত্যচর্চা না করলে তিনি অসুস্থ অনুভব করতেন। আর এজন্য তিনি লিখতে বসতেন। পামুক অন্যসব লেখকদের থেকে অনেকটা আলাদা আমার কাছে এই জন্য যে তিনি খুব একা থাকতে সবচাইতে বেশী পছন্দ করতেন। তার নোবেল ভাষণে তিনি বার বার বলেছেন, তিনি একা থেকেছেন বলেই তিনি লিখতে পেরেছেন। যাইহোক।

এই পামুকও “কেন লিখি?” নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন। একবার পামুকের মা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কাদের জন্য লিখছ? এই প্রশ্ন পামুককে একটুও বিচলিত করেনি। কারণ তিনি জানতেন, মা এই প্রশ্ন করছেন কারণ তিনি জানতে চাচ্ছেন, নিজের জীবিকার জন্য তুমি কি পরিকল্পনা করছ? নোবেল জয়ী এই লেখক বার বার ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন সাহিত্য নিয়ে তার ভাবনা। মানুষের অন্তরের গভীরের কথাগুলোকে। মানুষের লেখক সত্ত্বা নিয়ে।

কেন লিখি এই প্রশ্ন একবার ঘুরিয়ে এক সাক্ষাতকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কোথায় লিখেন? উত্তরে পামুক বলে ওঠে, আমি সব সময় ভেবেছি যে, যেখানে আপনি ঘুমান কিংবা যেখানে সঙ্গীর সাথে সময় কাটান সে জায়গা থেকে আপনার লেখার স্থানটা হবে বিচ্ছিন্ন। গার্হস্থ্য অনুষ্ঠানাদি ও দৈনন্দিনতা কোনো-না-কোনো ভাবে কল্পনাকে হত্যা করে। তারা আমার মধ্যকার শক্তিটাকে হত্যা করে। ঘরের পোষমানা দৈনিক রুটিন অন্য পৃথিবীর আকাক্সক্ষা, যার পরিচালনার জন্য প্রয়োজন কল্পনা, তাকে শেষ করে দেয়। সেজন্যে বহু বছর থেকে লেখার জন্য আমি আমার বাড়ির বাইরে একটা অফিস বা ছোট্ট জায়গা নিয়েছি।

আমার সব সময় আলাদা আলাদা ফ্ল্যাট ছিলো। কিন্তু একবার আমাকে আমেরিকায় কিছু সময় কাটাতে হয়েছিল যখন আমার সাবেক স্ত্রী কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন। বিবাহিত ছাত্রদের জন্য নির্ধারিত একটি এ্যাপার্টমেন্টে আমরা থাকতাম যেখানে আলাদা কোন জায়গা ছিল না। সুতরাং যেখানে লেখা সেখানেই ঘুমানো। চারদিকের উপকরণ সব সময় পারিবারিক জীবনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমার মেজাজ বিগড়ে যেত। ভোরে আমি আমার স্ত্রীকে “ গুডবাই ” জানিয়ে বেরিয়ে পড়তাম যেন কেউ কাজে বেরুচ্ছে। বাড়ি ত্যাগ করে হাঁটতাম কয়েকটা ব্লক ঘিরে, তারপর ফিরে আসতাম এমনভাবে যেন কোনো ব্যক্তি তার অফিস এসে পৌছলো। দশ বছর আগে বসফরাসের ওপারে পুরণো নগরীতে আমি একটি ফ্ল্যাট খুঁজে পাই। এটা, সম্ভবত, ইস্তাম্বুলের সর্বোৎকৃষ্ট দৃশ্য।

আমি যেখানে বাস করতাম সেখানে থেকে এটা পচিশ মিনিটের পথ। এখানে বইয়ে ভর্তি এবং আমার ডেস্ক থেকে দৃশ্যটা দেখা যায়। এখানে আমি প্রত্যেকদিন গড়ে দশ ঘন্টা কাটাই। পামুক এভাবেই বর্ণনা দিয়ে সাক্ষাতকার যিনি নিচ্ছিলেন তাকে বিষ্ময়ে ভাসিয়ে দেন। বিষ্ময়ে আত্মহারা হয়ে সাক্ষাতকার গ্রহণকারী প্রশ্ন করে বসেন, দশ ঘন্টা? পামুকের লেখা-লিখি নিয়ে আরেকটি উক্তি দিয়ে “কেন লিখি?” প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, লেখকরা লেখেন তাদের আদর্শ পাঠকের জন্য। তাদের প্রিয়ভাজনদের জন্যে, তাদের নিজেদের জন্যে অথবা কারও জন্যে নয়। এসবই সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে, আজকের লেখকরা লেখেন তাদের জন্যেও যারা তাদের বই পড়েন। এর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, আজকের লেখকরা ক্রমেই তাদের নিজ জাতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্যে (যারা তাদের বই পড়ে না) লিখছেন কম, বেশি লিখছেন বিশ্ব জুড়ে যারা পড়েন সেই সংখ্যালঘিষ্ঠ সাহিত্যিক পাঠকদের জন্য।

এবার বর্তমান প্রজন্মের একজন লেখকের এই “কেন লিখি?” ভাবনা তুলে ধরা যাক। আহমাদ মোস্তফা কামাল তাঁর ধ্যানের জগৎ জ্ঞানের জগৎ প্রবন্ধে অনেকটা প্রশ্ন করেই বলেছেন, একজন লেখককে কেনই-বা এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়? সৃজনশীলতার অন্যান্য শাখায় যাঁরা কাজ করেন তাঁদেরকে তো এত প্রশ্ন করা হয় না! অসাধারণ সৃজনশীল কোন চিত্রকরকে সচারাচর প্রশ্ন করা হয় না যে, তিনি আঁকেন কেন? কথাটি কিন্তু সত্যিই। সৃজনশীল অন্য শাখায় যারা কাজ করছেন তাদের কিন্তু এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না। যেমন, একজন সুরকারকে কিন্তু প্রশ্ন করা হয় না, আমি সুর করছেন কেন? তাহলে একজন লেখককেই কেন এই প্রশ্ন করা হয়? এই প্রশ্নের উত্তর আহমাদ মোস্তফা কামাল নিজেই দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সম্ভবত অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে লেখালিখির সম্বন্ধে মানুষের কৌতুহল বেশি- একটি কবিতা বা গল্প বা উপন্যাস হয়তো পাঠককে বিস্মিত করে।

পাঠকরা ঐসব লেখায় কোনো-না-কোনো ভাবে নিজেদের খুঁজে পেয়ে অবাক হয়ে ভাবেন, তার অপরিচিত এই লেখকটি কীভাবে তার কথাটিই লিখলেন! একজন লেখককে লিখতে হলে অনেক সাধনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। চাইলেই গল্প লেখা যায় না। চাইলেই কবিতা বা উপন্যাস লেখা যায় না। এই লেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। আর এই অপেক্ষাটাও অনেক লেখক উপভোগ করেন।

ভালোবাসার প্রহরের জন্য যেমন অপেক্ষা মানুষ করে। মানসিক শান্তি লাভ যে লেখার মধ্যে দিয়েও আসতে পারে তা শুধু অপেক্ষা দিয়েই বোঝা যায়। অনেকে এই অপেক্ষাটাকে অনুভব করতে পারেন বলেও লেখেন। অথবা অনেকে সৃষ্টির মধ্যে আনন্দ পান। সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে লেখা-লেখি এক আজব রহস্য ঘেরা কাজ।

যে সৃষ্টি একজন লেখককে হাজারো যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দান করে। তাই তারা লেখেন। অনেক লেখকই কিন্তু বলেছেন, তারা তাদের জীবনকে অর্থময় করে তুলবার জন্যই লেখালেখি করেন। তাই আহমাদ মোস্তফা কামালের উক্ত প্রবন্ধের শেষ কটি লাইন দিয়েই লেখাটি শেষ করলাম। জীবনের অর্থহীনতা ভুলে থাকা অথবা জীবনকে অর্থময় করে তোলার জন্য চেষ্টার তৃপ্তিই মানুষকে দৈনন্দিন কাজগুলোর বাইরে নিয়ে আসে।

আর এজন্যই হয়তো সে লেখালেখি করে, গান গায়, সুর তৈরী করে, নাটক-সিনামা বানায়, ছবি আঁকে, কিংবা রাজনীতি করে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।