আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিন কি একেবারেই গেছে?

অন্যায়ভাবে সংঘটিত সকল বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাই । ।

বলকান অঞ্চলের দেশ বুলগেরিয়ার ছোট্ট দ্বীপ দানিউব। বিলুপ্তপ্রায় সি-ঈগল আর বামন প্রজাতির মানুষ পিগমিদের আবাসস্থল এই দ্বীপের ঘন অরণ্যের ভেতর রয়েছে শত শত গণকবর। সাবেক কমিউনিস্ট শাসনামলে এখানেই শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

১৯৪৯ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত বিরামহীনভাবে চলেছে এ নির্যাতন। ১৯৯০ সালে বুলগেরিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, অর্থাৎ সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটার ২০ বছর পর সেসব নির্যাতনের কথা আজ আর মানুষের মনে নেই। বলকান অঞ্চলের ছোট্ট এই দেশটিতে এখন পুঁজিবাদী সরকার। সমাজতন্ত্রের পতনের পর মানুষ ভেবেছিল, কমিউনিস্টবিরোধীদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হওয়ায় মানুষ এবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। কিন্তু না, শান্তির ঘুম উপহার দিতে পারেনি পুঁজিবাদী সরকার।

বরং গত ২০ বছরে সেখানকার মানুষের চোখ থেকে শান্তির ঘুম কেড়ে নিয়েছে পুঁজিবাদ। আগে পড়াশোনা শেষ করে এখানে কাউকে বেকার থাকতে হতো না। বেকারত্বের হার ছিল ০ শতাংশ। খাবারের দাম ছিল কম। সামাজিক নিরাপত্তা ছিল।

কিন্তু আজ সেসবই স্মৃতিচারণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বুলগেরিয়ার ফুটপাতে এখন অসংখ্য শিক্ষিত বেকার কাজ না পেয়ে ঘুরে বেড়ায়। একজন চাকরিজীবীকে তার বেতনের সিংহভাগই খাবার কেনার পেছনে ব্যয় করতে হয়। পুলিশের ঘুষবাণিজ্যে অতিষ্ঠ লোকজন। এসব কারণে বুলগেরিয়াসহ সাবেক সোভিয়েত ব্লকের পুরো এলাকা, অর্থাৎ পূর্ব ইউরোপে এখন ভর করেছে নস্টালজিয়া অর্থাৎ স্মতিকাতরতা।

এসব এলাকার প্রায় প্রত্যেক বয়স্ক লোক মনে করেন, সোভিয়েত ব্লকের অংশ হিসেবে তাদের দেশে যখন সমাজতান্ত্রিক সরকার ছিল, তখন তাদের জীবন ছিল অনেক বেশি সহজ ও শান্তিপূর্ণ। বেলেনি শহরের ৩১ বছর বয়সী অ্যানেলিয়া বিভা জানান, আমাদের জন্য সেই সময়টা ছিল স্বর্ণযুগ। ছুটির দিনে আমরা তখন পাহাড়-সৈকতে ঘুরতে যেতাম। খাবার-দাবার, পোশাক-পরিচ্ছদের অভাব ছিল না। আর আজ যা আয় করি, তার প্রায় সবটাই চলে যায় খাবার কেনা বাবদ।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বহু ছেলেমেয়ে চাকরি না পেয়ে বিদেশে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু কমিউনিস্ট আমলে এমন সমস্যা ছিল না। সব মিলিয়ে গোটা বুলগেরিয়ায় এখন সমাজতন্ত্রের স্মৃতিচারণ চলছে। সেখানকার মানুষ যেন বলতে চাইছে_ 'আমাদের গেছে যেদিন, একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকি?' হয়তো এমন নস্টালজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাশিয়ার মস্কোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সোভিয়েত থিম্ড রেস্টুরেন্ট। নাইট ক্লাবে তরুণ-তরুণীরা কমিউনিস্টদের ক্লাসিক নাচ নাচছে।

জন্মদিনে সোভিয়েত শ্যাম্পেন আর রেড অক্টোবর চকোলেট খেয়ে ফুর্তি করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সাবেক কমিউনিস্ট শাসিত পূর্ব ইউরোপের জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র সম্পর্কে বর্তমানে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েও তারা এখন আর বিত্তবান শ্রেণীকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পিউরিসার্চ সেন্টার গত সেপ্টেম্বরে এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ইউক্রেন, বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া ও হাঙ্গেরিতে গত এক দশকে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের জনপ্রিয়তায় সাংঘাতিক ধস নেমেছে। জরিপে দেখা গেছে, ১৯৯১ সালে ইউক্রেনে ৭২ শতাংশ লোক গণতন্ত্রে বিশ্বাস করত।

আর এখন সেখানকার মাত্র ৩০ শতাংশ লোক গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। বুলগেরিয়া ও লিথুয়ানিয়ায় আগে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক গণতন্ত্রের পক্ষে ছিল। এখন সেই সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বৈশি্বক মহামন্দায় ইউরোপের মধ্যে এ অঞ্চলটাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলোর 'প্রেসক্রিপশন' অনুযায়ী নব্য উদার পুঁজিবাদী অর্থনীতি দিয়ে সেখানে এই সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টা চলছে।

নব্য উদার অর্থনীতির ফলে সেখানকার এক শ্রেণীর ধনী আরও ধনী হচ্ছে; গরিব হচ্ছে আরও গরিব। জরিপ সংস্থা জোন্ডা ইপসোস বলেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সময় ১৯৮৯ সালে হাঙ্গেরিতে যত লোক প্রাপ্তবয়স্ক ছিল, তাদের ৭০ ভাগই মনে করে, নতুন পুঁজিবাদী সরকারব্যবস্থা তাদের জন্য অমঙ্গল ডেকে এনেছে। সাবেক যুগোস্লাভ দেশগুলোর লোকজনও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় মর্মাহত। জরিপ সংস্থা গ্যালাপ ২০০৮ সালে তাদের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া, ইউক্রেন, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়াকে বিশ্বের শীর্ষ ১০ অসন্তুষ্ট ও হতাশ দেশের তালিকায় রেখেছে। বুদাপেস্টের ২৩ বছর বয়সী ছাত্রী সোফিয়া কিস তার অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে জানায়, 'আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের চেয়ে অনেক সুখী জীবন কাটিয়েছেন।

সেই সময় তাদের যা ছিল, তা তাদের প্রয়োজন মিটিয়েছে ভালোভাবেই। কিন্তু এখন কেউই বর্তমান সুবিধায় সন্তুষ্ট হতে পারছে না। ' পূর্ব ইউরোপে বিশেষত বুলগেরিয়ায় বড় বড় মাফিয়া ডন প্রকাশ্যে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। সেখানকার জনগণের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, সেখানে দ্রুতগতিতে আমেরিকান সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে।

ভোগবাদী দর্শন প্রতিফলিত হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রের পরতে পরতে। মধ্যবিত্তরা মনোকষ্টে আছে। তারা বুঝতে পারছে, আমেরিকান সংস্কৃতি অনুযায়ী জীবন চালাতে তাদের যে আয় থাকা দরকার, তা তাদের নেই। তারা এখন না পারছে বর্তমানকে নিয়ে সুখী হতে, না পারছে অতীতে ফিরে যেতে। আপাতত সমাজতান্ত্রিক যুগের স্মৃতিচারণ করেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের।

সূত্র/সংগ্রহ: দৈনিক সমকাল (১৯.১১.০৯)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।