আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক প্রত্যয়দীপ্ত প্রতিভা: বিপ্লব দত্ত



বিপ্লব দত্ত --এই মানুষটি আজ বাংলাদেশের চারুশিল্পে জায়গা করে নিয়েছেন শুধু তাই নয়, তার নাম আজ সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবার মুখে মুখে। পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার নতুনভারেঙ্গা ইউনিয়নের সোনাপদ্মা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে তার জন্ম। বাবা মনোরঞ্জন দত্ত ও মা সন্ধ্যা রাণী দত্তের উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই তার ছবি আঁকা শুরু। ছোটবেলায় বই-খাতা নিয়ে যখন পাঠশালায় যেতেন, তখন তার বইয়ের ভেতরের বিভিন্ন রং-বেরঙের ছবিগুলো দেখে দেখে হারিয়ে যেতেন অন্য এক ভূবনে। ক্লাসে শিক্ষক গদ্য-পদ্যের প্রশ্ন লিখতে দিলে পাঠের লেখা না লিখে বিপ্লব দত্ত গদ্য-পদ্যের পাশের ছাপা জয়নুল আবেদীন, হাসেম খান কিংবা কাইয়ুম চৌধুরীদের আঁকা ছবিগুলো দেখে দেখে অবিকল এঁকে ফেলতেন।

শিক্ষকরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন। এভাবে মাত্র সাত বছর বয়স থেকে শুরু হয় তার আঁকাআঁকি। তার হাতেখড়ি ও গুরু বলতে যা বুঝায়, তা ওই পাঠ্যবইই। এভাবে প্রাইমারী শেষ করে হাই স্কুলে পদার্পন। এবং ছবি আঁকায় পুরোপুরি মনোনিবেশ।

হাই স্কুলে ভর্তির পরপরই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের স্কেচ এঁকে অবাক করে দেন স্কুলের সকল শিক্ষককে। স্কুলের শিক্ষকদের অকুণ্ঠ ভালোবাসা পেতে থাকেন। এভাবেই নানাভাবে উৎসাহ পেয়ে ছবি আঁকার প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে যান বলে জানান বিপ্লব দত্ত। এরপর একে একে এস. এস. সি ও এইচ. এস. সি পাশ করে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়।

তিনি ২০০১ সালের বি.এফ.এ সম্মান এবং ২০০২ সালের এম.এফ.এ পরীক্ষায় রেকর্ডস নম্বরসহ ১ম শ্রেণীতে প্রথম হন। বিগত ২০ বছরে বিশ্ববিদ্যায়ের কলা অনুষদ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার গৌরব অর্জন করায় বিশ্ববিদ্যালয় আগামী ১৪ নভেম্বর’০৯ বিপ্লব দত্তের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র বিপ্লব দত্ত তার হাতের কাজেও সেরা অবস্থানটিই করে নিয়েছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত পত্র পত্রিকায় তার আঁকা কার্টুন যেভাবে প্রাণ পায়, অন্য কারো আঁকায় সে প্রাণ পাওয়া যায় না। পত্র পত্রিকায় কার্টুন এবং বিভিন্ন বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে ইতোমধ্যে কুড়িয়েছেন এক গাদা প্রশংসা।

তার হাতের ছোঁয়ায় ছবি যেন হয়ে যায় জীবন্ত। দেশের বিভিন্ন ধর্মালয়ে বিপ্লবের আঁকা পৌরাণিক কাহিনীর যে বিশাল চিত্রমালা রয়েছে, তা দেখার মত। কারো আপন কেউ মারা গেছেন এবং স্মৃতি ধরে রাখার মত ছবিটিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; অমনি ছুটে যায় বিপ্লবের কাছে। মন আর হাতের ছোঁয়ায় রঙের এক অদ্ভূত খেলা খেলতে পারেন বিপ্লব দত্ত। তার আঁকা চিত্রকর্মগুলি ঠিক যেন লেন্স ক্যামেরায় তোলা ছবি।

বিভিন্ন জায়গায় ছবি এঁকে এবং ভাস্কর্য তৈরি করে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি, যেমন পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল্ড মেডেলটিও। সম্প্রতি কথা বলতে গিয়েছিলাম তার কর্মস্থল ধানমন্ডিস্থ অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে। তার আঁকাআঁকির একটি কক্ষে প্রবেশ করতেই ভেসে এলো গানের সুর। ভেতরে প্রবেশ করেই কিছুক্ষণের জন্য গোলক ধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম। আমরা তো কণ্ঠশিল্পীর কাছে আসিনি, এসেছি একজন চিত্রশিল্পীর কাছে।

বিপ্লব দত্তকে তো চিত্র শিল্পী হিসেবে চিনি, কিন্তু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তো নয়! আলাপকালে বিপ্লব বলেন, আঁকাআঁকির অবসরে পড়ন্ত বিকেলে হারমোনিয়াম সহযোগে গান গেয়ে মনকে প্রফুল্ল রাখেন। তবে সংগীত তার পেশা নয়, নেশা। সংগীতে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নেই তেমন। তার গুরু বলতে ছোটবেলায় হাতেখড়ি ও চর্চা তার মায়ের কাছেই। সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি না থাকলেও বিভিন্ন ওস্তাদের লেখা স্বরলিপির বই পড়ে ও চর্চার মাধ্যমে তিনি নিজের একটা গায়কী ভঙ্গি আয়ত্ত্ব করেছেন।

বিপ্লবের গান গাওয়া শুরু নজরুল সংগীত দিয়ে। যদিও ইদানিং আধুনিক-ক্লাসিকের দিকেই বেশি ঝোঁক। আধুনিক-ক্লাসিকের প্রতি আগ্রহের কারণ-এ গানে সুর ও ছন্দের বৈচিত্র আছে, যা ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে মানুষকে। তিনি সুবীর নন্দী, আ. জব্বার, আব্দুল হাদি কিংবা নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর গান অবিকল তাদের মত করেই গাইতে পারেন। আর মেহেদী হাসান বা গোলাম আলীর গজল তার কণ্ঠে শুনলে অবাক হবে না এমন মানুষের সংখ্যা কম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন আন্ত. বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। এত ভালো গান করেন, অথচ অডিও বা সিডি বের করছেন না কেন?--গান শুনে অভিভূত হয়ে প্রশ্ন করতেই স্মিত হেসে তিনি জবাব দেন, আমি কি আসলেই গান গাইতে পারছি? আমি মূলত একজন ভালো শ্রোতা হওয়ার জন্যই গান করি। অত্যন্ত সহজ, সরল ও মিষ্টভাষী এই মানুষটির কথা শুনে অবাক হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না। বর্তমানে দেশের অনেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পীদের চেয়েও বিপ্লব দত্ত ভালো গান করছেন। যদি কাউকে বলা যায়-- বিপ্লব দত্তের কোনটি তোমার পছন্দ--গান, নাকি ছবি আঁকা? তবে দ্রুত উত্তর আসবে-দুটোই।

তিনি দু’দিকে পদচারণা করে দু’দিকেই সফল। শুধু এই তারুণ্যদীপ্ত, স্বাধীনচেতা মানুষটির সঠিক মূল্যায়ণ ও প্রচারের প্রত্যাশা আমাদের।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।