আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম কাণ্ডারী

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ষড়যন্ত্রকারীরা জাতিকে মেধাশূণ্য ও পুরোপুরি পঙ্গু করার জন্যই জেলহত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। ঘাতকদের ইচ্ছা ছিল ১৫ আগস্ট রাতেই বঙ্গবন্ধুর চার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। সেদিন সময় স্বল্পতা এবং এই চার নেতার বাসস্থান বিভিন্ন স্থানে হওয়ার কারণে ঘাতকরা সিদ্বান্ত পালটায়। ১৫ আগষ্টের পর চার জাতীয় নেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটকে রাখে।

৩ নভেম্বর এই অবিসংবাদিত চার নেতাকে জেলের মধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানের জন্ম ১৯২৬ সালের ২৬ জুন। নাটোর মহকুমার বাগাতীপাড়া থানার মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে। পৈতৃক বাড়ি রাজশাহী জেলার কাদিরগঞ্জ মহল্লায়। পিতামহ হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার (১৯৪৮-১৯৩৬) গুলাই-এর জমিদার ছিলেন।

কামরুজ্জামানের বাবা আব্দুল হামিদ মিয়া। মা জেবুন নেসা। ১২ সন্তানের প্রথম কামরুজ্জামান। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর প্রাইমারী।

এরপর ভর্তি হন রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী কলেজিয়েট স্কুলে। সেখান থেকে চলে যান চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৪২ সালে এখান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুনরায় রাজশাহী চলে আসেন। ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ১৯৪৪ সালে এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশের স্বীকৃতি পান।

তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা যান। কলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্স কলেজে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ শেষ করে তিনি চলে আসেন রাজশাহীতে। পুনরায় আইন বিষয়ে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে।

১৯৫৬ সালে তিনি এখান থেকেই লাভ করেন বি.এল ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর যুক্ত হন আইন পেশায়। কামরুজ্জামান পারিবারিকভাবেই রাজনীতির কর্মী ও সংগঠক হয়ে ওঠেন। দাদা হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার ১৯২৪-২৬, আর ১৯৩০-৩৬ সাল পর্যন্ত দু’বার অবিভক্ত বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (এম.এল.সি) নির্বাচিত হয়েছিলেন। চরকার প্রচলনে বিশ্বাসী তিনি ছিলেন গান্ধিবাদী।

কামরুজ্জামানের বাবা আব্দুল হামিদ মিয়া ১৮৮৭-৭৬ ছিলেন রাজশাহীর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি ১৯৪৬-৫৪ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলাদেশ ও পরে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। দাদা এবং বাবার রাজনৈতিক মতাদর্শ তার চেতনা মানসকে রাজনৈতিক ধারায় প্রভাবিত করে। পারিবারিক ধারাবাহিকতায় স্কুলে পড়ার সময়ই কামরুজ্জামান জড়িয়ে পড়েন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। যুক্ত হন মুসলিম ছাত্র লীগে।

সাংগঠিন দক্ষতা ও নৈপূন্যতার কারণে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে নেতৃত্বে চলে এসেছিলেন। ১৯৪২ সালে বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩-৪৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র লীগের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন। ১৯৫১ সালে কামরুজ্জামান জাহানারাকে সহধর্মিনী করেন। বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামের আশরাফ্উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জাহানারা।

তাদের সংসারে ৬ সন্তানের জন্ম হয়। ১৯৫৬ সালে কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। রাজনৈতিক জ্ঞান, সাংগঠিন দক্ষতা ও নৈপূন্যতার কারণে তিনি আওয়ামী লীগের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন বঙ্গবন্ধুর। ৬০’র দশকে জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে তিনি প্রায় সকল আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬২ সালের আইয়ুব খানের প্রর্বতিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়, সে আন্দোলনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। ১৯৬৬ সালে পরপর দু’বার এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনের সময় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সারাদেশে এই আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য দিনরাত অক্লান্ত শ্রম দেন। ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

ওই বছর তিনি বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সারাদেশে গণঅদ্ভ্যূত্থানে বাস্তবতার কারণে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। এ সময় আইয়ুব খান সমস্যা উত্তরণের পথ হিসেবে রাওয়াল পিন্ডিতে এক গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করে। কামরুজ্জামান আওয়ামী প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এ বৈঠকে অংশ নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন৷।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে সারাদেশে রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সকল আলোচনা-আন্দোলন যখন অনিবার্যভাবে একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তখন শেখ মুজিব দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেন। এ হাই কমান্ডের ৫ জনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন কামরুজ্জামান। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুজ্জামান।

শত প্রতিকূলতার মাঝেও আন্তরিকতার সাথে পালন করেছেন নিজ দায়িত্ব। যুদ্ধকালীন সময় তিনি চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের প্রান্ত সীমাসমূহ। দেশ স্বাধীনের পর ৩০ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২-৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাজশাহীর দু’টি সদর গোদাগাড়ি ও তানর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে তিনি মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করলো মোশতাক গংরা সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্রে।

এর পরে তিন জাতীয় নেতাসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকেসহ অন্য নেতাদের আটক রাখা হয়। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫। রাত্রিবেলা। কারাগারের নিউ জেল বিল্ডিং এর ২নং রুমে বন্দি এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান।

কারাগারে প্রবেশ করে অস্ত্রধারী সৈন্যরা। নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানকে। সম্পাদনায়ঃ শেখ রফিক ও কল্লোল

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।