আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: আগুনের গলি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

বাগদাদ শহরের হাইফা স্ট্রিটটি খুবই বিখ্যাত একটি সড়ক। সেই সড়কের পাশেই সরু একটি গলির ভিতরে আলী আল আম্মার-এর তিনতলা বাড়ি । হাইফা স্ট্রিটটি দজলা (তাইগ্রিস) নদীর খুব কাছে, যে কারণে বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়ালে সন্ধ্যেবেলা দজলা নদীর ভিজে আঁষটে গন্ধ আর উথালপাথাল হাওয়া টের পাওয়া যায়।

বারান্দার নিচেই পীর বালাদানের গলি। পারস্যের ফাজারুদ্দীন বালাদান নামে এক পীরের নামে গলির নাম। পীরের মাজারটি গলির মধ্যেই। বাগদাদের লোকের বিশ্বাস: পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান ছিলেন অত্যন্ত বুজর্গ ব্যাক্তি, তাঁর নাকি এন্তার রূহানি শক্তি ছিল; কথাটা মনে হয় সত্য। তা না হলে ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই ক্ষমতা গ্রহন করার পরে সাদদাম হুসেইন আবদ আল মাজিদ আল তিকরিতি গোপনে কেনই-বা এক গভীর রাতে পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এক মাজারে যাবেন? ক্ষমতা গ্রহন করার আগেও নাকি সাদদাম হুসেইন আবদ আল মাজিদ আল তিকরিতি খুব শীতের এক ভোরে ছদ্মবেশ ধারণ করে অতি গোপনে পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এক মাজারে এসেছিলেন।

মাজারে ঢোকার মুখে কালো রঙের ভারী একটি গেট, লোহার; ভিতরে ছাই রঙের কবুতর ভর্তি ছোট্ট একটি পাথরের চাতাল। চাতালের দক্ষিণ পাশে কালো গম্বুজওয়ালা মাজার। আলী আল আম্মার-এর গালিচার দোকানটি পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারের কাছেই। আলী আল আম্মার-এর পূর্ব পুরুষের বসবাস ছিল পারস্যে, পারস্যের গালিচার পারিবারিক পুরনো ব্যবসা। বৃদ্ধের একটাই ছেলে- ফায়েক; ছত্রিশের মতো বয়স, সেও গালিচার দোকানে বসে।

২০০৩ সালের ২০ মার্চ। বাগদাদ শহরের ওপর মার্কিন বিমান হামলা শুরু হওয়ার পর আলী আল আম্মার হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান; হার্টের অসুখ ছিল বৃদ্ধের, তার চিকিৎসাও চলছিল। মৃত্যুর সময় দোকানে ছিলেন বৃদ্ধ। মার্কিন বিমান হামলা শুরু হলে বৃদ্ধের বলিরেখাময় মুখের তামাটে রংটি কেমন কালচে নীলবর্ণের হয়ে যেতে থাকে, তারপর তিনি ছটফট করতে করতে ছেলের সামনেই ঢলে পড়েন। হতভম্ব ফায়েক কী করবে বুঝতে পারে না, বোমা বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দে তারও বুক কাঁপছিল।

বৃদ্ধ আলী আল আম্মার ছিলেন অন্ধ । অন্ধ শ্বশুরের দেখাশোনা করত ফায়েক-এর বউ সাফিয়া । ইরাকের বাকুবা শহরের মেয়ে সাফিয়া, বড় চাচার বাড়ি একরকম অনাথ হয়েই মানুষ হয়েছে। বিয়ের পর বৃদ্ধ শ্বশুরের মধ্যে অদেখা বাবাকে খুঁজে পেয়ে অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়েছে সাফিয়া; বিয়ের ক’বছর পর থেকে বৃদ্ধ শ্বশুরের প্রতি সাফিয়ার সেবা যত্ন আরও বেড়ে গেছে । তার কারণ আছে।

তেরো বছর হল সাফিয়ার বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়নি; যে কারণে সাফিয়ার স্বামী ফায়েক সাফিয়ার ওপর বিরক্ত, বিরক্ত হলেও বিবাহ বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারছে না ফায়েক, কেননা, প্রথমত, ছেলের বউয়ের প্রতি বৃদ্ধর অসম্ভব গভীর টান; দ্বিতীয়ত, গালিচার দোকানটির মালিকানা এখনও বৃদ্ধ বাবার । বৃদ্ধর যে ছেলের বউয়ের ওপর ভীষণ টান - এও এক রকম কৌশল। ফায়েক আবার বিয়ে করলে সেই নতুন বউ যদি অন্ধ বৃদ্ধকে অবহেলা করে? এ কারণেই বৃদ্ধ ছেলের বিবাহ বিচ্ছেদ চান না। ওদিকে মা হতে না-পেরে মনে মনে গভীর গ্লানিতে ভুগছিল সাফিয়া; এ নিয়ে ওর উদ্বেগের শেষ নেই। বিয়ের পর পরই বুজর্গ পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর নাম শুনেছে।

ইচ্ছে ছিল একবার পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর বালাদান পীরের মাজারে গিয়ে মা হওয়ার মানৎ করে । লোকের বিশ্বাস, পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান নাকি কাউকে খালি হাতে ফেরান না, মানৎ করলে সবার মকসেদই পূর্ন। সাফিয়ার শ্বশুর আলী আল আম্মার আবার পীরফকির বরদাস্ত করেন না। আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে বৃদ্ধ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য নরম হন এবং সাফিয়াকে বালাদান পীরের মাজারে যাওয়ার অনুমতি দেন। তা ছাড়া হার্টের অসুখ ছিল বৃদ্ধের, তার চিকিৎসাও চলছিল।

তেমন লাভ হচ্ছিল না। যদি পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর উছিলায় অসুখ ভালো হয়ে যায়। আসলে অসুখে ভুগে ভুগে অন্ধ বৃদ্ধের আগেকার শক্ত মনটিই দূর্বল হয়ে পড়েছিল। পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারের খাদেম আবদেল হালেফ, মাঝবয়েসি লোক, বাড়ি নাজাফ; আবদেল হালেফ নানা রকম বাতেনি কেরামতি জানে, সাফিয়ার শ্বশুরকে বিশেষভাবে প্র¯তুত রুম্মান (ডালিমের শরবত) খেতে দিয়েছে। পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারে নির্জন কোঠায় মার্বেল পাথরের ঠান্ডা মেঝে।

সেই মার্বেল পাথরের মেঝের ওপরে কপাল ঠেকিয়ে সাফিয়া কাঁদে । বুজর্গ পীরকে মনের কথা খুলে বলে। সাফিয়ার স্বামী ফায়েক আজকাল ভীষণ শীতল আচরণ করে । ক’বছর হল সাফিয়ার শরীরের প্রতি উদাসীন হয়ে উঠেছে ফায়েক । বিছানায় রাতের বেলায় সাফিয়ার পাশে কাঠের মতন শুয়ে থাকে, ছোঁয় না।

সাফিয়া কি আর করে- কখনও মাহাজ-এর কিশোর শরীরটি, কখনও-বা রাহিলের টগবগে শরীরটি ভেবে ছটফট করে... মনে মনে এসব গোপন কথা বলতে বলতে মাজারে বসে সাফিয়া কাঁদে আর কাঁদে । সাফিয়াকে মাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন সাফিয়াদের তিনতলার ভাড়াটে সাঈদূন বিবি । সাঈদূন বিবির বাদামী চুল, ঘন কালো ভুরু, নীলচে চোখ আর থলথলে ফরসা শরীরে কুর্দি রক্ত। মহিলা বিধবা । সাঈদূন বিবির স্বামী হাসান আল বকর বাথ পার্টি করতেন।

সাদদাম হুসেইন আবদ আল মাজিদ আল তিকরিতি ১৯৭৯ সালের ১৬ জুলাই ক্ষমতা গ্রহন করার পরের দিনই হাসান আল বকর-এর লাশ দজলা নদীতে ভাসছিল । সেদিনই সাঈদূন বিবির এক ছেলে হয়। রাহিল, ইরাকের সামরিক বাহিনীতে আছে: আন নাসিরিয়ায় পোষ্টিং । মাঝে মাঝে মাকে দেখতে আসে রাহিল। আগে কত ফরসা ছিল, রাহিল এখন তামাটে হয়ে গেছে।

সাফিয়ার আপন ভাইবোন নেই, রাহিলের সঙ্গে সে ভাইয়ের সম্পর্ক পাতিয়েছে। রাহিল গতমাসে বাগদাদ এসেছিল, বোনকে কাছে টেনে কানে কানে বলেছিল, আর কত, এবার আমায় একটি সুন্দরী বউ এনে দাও না বইিন। সাফিয়া চোখ রাঙিয়ে বলেছিল, শখ কত! তারপর হেসে বলেছিল, বউ যদি সুন্দরী না হয় তো? রাহিল হতাশার সুরে বলে, বউ সুন্দরী না হলে আমি আল্লার ইচ্ছেকে মেনে নেব, নয়তো এই পোড়া কপালের দোষ দেব। কথাটা শুনে ভাইয়ের কপালে চুমু খেয়ে সাফিয়া বুকের ভিতর থেকে নাফেসার ফটোগ্রাফ ছবি দেখিয়ে বলেছিল: এই নাও তোমার বউ। নাফেসার ছবি দেখে রাহিলের চোখ দুটি আঙুর পাতায় মোড়ানো দোলমার মতন হয়ে গেল ।

হবে না কেন- ছিপছিপে তরুণী নাফেসা; এ মহল্লাতেই নতুন এসেছে। নাফেসার বাবা হাদী আল হাকিম সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অভ ইরাকের কেরানি । একটাই মেয়ে তার, ভালো পাত্রের হাতে তুলে দেবেন। সাঈদূন বিবিও ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। নাফেসাকে পছন্দ করেছেন।

এ বছরই, ২০০৩, এপ্রিলে বিয়ে। সেদিন সাঈদূন বিবি বলছিলেন, রাহিলের আব্বা বেঁচে থাকলে কত খুশি হতেন। সাফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এসব সময়ে চুপ করে থাকতে হয়। আমার স্বামী বেঁচে আছে, অথচ আমারও দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

সাঈদূন বিবির স্বামী নেই তারও দীর্ঘশ্বাস পড়ে। আশ্চর্য! স্বামীর কথা স্মরণ করে সাঈদূন বিবি এখনও কাঁদেন। স্বামীর মৃত্যুর কারণটা সাঈদূন বিবির কাছে এখনও ঠিক বোধগম্য নয়। কে বা কারা তার লাশ দজলায় ফেলল। বাথ পার্টি করতেন।

তারাই তে এখন ক্ষমতায়। ইরাকসহ সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য এখন থমথম করছে, আম্রিকা ইরাক আক্রমন করতে পারে, প্রেসিডেন্ট বুশ সাদদাম হুসেইনকে দিনরাত হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। সাঈদূন বিবি তাতে অখুশি নন। সাঈদূন বিবি সাদদাম হুসেইনকে দুচোখে দেখতে পারে না। সাঈদূন বিবি কুর্দি।

রাহিলের বাবা অবশ্য সুন্নি ছিলেন। পৃথিবীতে আজও এমন অসবর্ণ বিবাহ হয় বৈ কী। সেই স্বামী মরে গেল। মৃত স্বামীর কথা স্মরণ করে সাঈদূন বিবি এখনও কাঁদেন। সাঈদূন বিবির এখন মাঝবয়েস।

সেই থলথলে ফরসা শরীরে রাতদিন দজলা নদীর জোয়ারভাঁটার খেলা; যে কারণে সাঈদূন বিবির নজর সাফিয়ার শ্বশুরের ওপর । (সাফিয়া বেঁচে থাকতে সাঈদূন বিবি ফায়েক- এর ওপর নজর দেবে সে সাহস ওই বিধবার নেই!)। সাফিয়া যখন রান্নাঘরে রান্না করে পাশের ঘরে তখন সাফিয়ার শ্বশুর সাঈদূন বিবির সঙ্গে বসে গল্প করেন। এক বিধবা ও এক অন্ধ বৃদ্ধের ভারি অদ্ভুত প্রেম খুব কাছ থেকে দেখে সাফিয়া । (ফায়েক অবশ্যি এসব টের পায় না।

পুরুষ মানুষ বলেই টের পায় না হয়। ...সংসারে নারীর অনেক আমোদ ...বিনে পয়সায় কত কত নাটক তারা দেখে। ) সাফিয়াকে খুশি রাখতে সাঈদূন বিবি সাফিয়াকে কত কিছু যে রান্না করে খাওয়ায়: এই যেমন বাসমতি চালের বিরিয়ানি, কচি ভেড়ার মাংসের কাবাব, ফাসোওলিয়া (এক ধরনের স্যূপ), হারিসা, (এক ধরনের পায়েস) ;জামেড- ভেড়ার দুধের লাবান (দই) ... রুম্মান। সাফিয়ার অন্ধ শ্বশুর আর মধ্যবয়েসী বিধবা সাঈদূন বিবির সঙ্গে ভারী অদ্ভুত ধরনের এক প্রেম চলছে। সাঈদূন বিবির হাতের মজাদার রান্না খেয়ে হোক বা শ্বশুরের বিরাগভাজন হবে না বলেই পুরো বিষয়টা সাফিয়া দেখেও না-দেখার ভান করে।

সাফিয়া ভালোই জানে, তার ষাট বছরের অন্ধ শ্বশুরটি নপুংসক, ভোরবেলা বুড়ো খালি পেটে মিছরি আর পেস্তার গুঁড়ো মিশিয়ে মধুর শরবত খান ( শরবতটা সাফিয়াই বানিয়ে দেয়) ...কালিজিরার তেল খান ; তারপরও বুড়োর মাজায় হারানো তাকৎ ফিরে আসে না, সাঈদূন বিবি শরীরে আন্দাজে হাত দিতে সাহস পান না। রান্না করতে করতে সাফিয়া পাশের ঘরে সাঈদূন বিবির দীর্ঘশ্বাস যেন টের পায়। সাঈদূন বিবির এই দীর্ঘশ্বাসের জন্য কি সাদদাম হুসেইন আবদ আল মাজিদ আল তিকরিতি দায়ী? কবে যেন রাহিলের বাবা হাসান আল বকর-এর লাশ দজলা নদীতে ভাসছিল? আজ এক বাটি ভেড়ার দুধের লাবান নিয়ে সাঈদূন বিবি এসেছিলেন। সকালে গাজরের হালুয়া বানিয়েছিল সাফিয়া। লাবানটুকু অন্য একটি বাটিতে ঢেলে খালি বাটিটা ধুয়ে বাটিতে কয়েক চামচ গাজরের হালুয়া রাখল, খালি বাটি ফেরত দিতে নেই।

এই সময় কলিং বেলটা বাজল। সাঈদূন বিবি বললেন, মাহাজ এল বোধহয়। আমি যাই। সাফিয়া দরজা খুলল। মাহাজ।

সাফিয়ার বুকটা ধক করে উঠল। সাঈদূন বিবি তিন তলায় থাকেন, মাহাজ-এর পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। মাহাজ ঘরের ভিতরে ঢোকে: আঠারো-উনিশ বছরের কিশোর ছেলে; ফরসা, লাল লাল কোঁকড়া চুল, সুরমা দেওয়া ছোট জ্বলজ্বলে চোখ। গালিচার দোকানে দুপুরের খাবার নিয়ে যায় মাহাজ । মাহাজকে সামনে বসিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে ধীরে ধীরে ভাত, শাক, ফুলকপি আর ভেড়ার মাংস দিয়ে রান্না করা ‘মাকলুবা’ ভরে ।

মাহাজ খুব কাছে বসে দেখতে থাকে সাফিয়ার একত্রিশ বছরের গোলাপি রঙের মোলায়েম শরীরটি। (সাফিয়া ঘরে বোরখা পরে না ...) সাফিয়া সুন্দরী। বাকুবার মেয়ে বলেই সুন্দরী। বাকুবার মেয়েরা সুন্দরী হয়। মাহাজ লোভী চোখে সাফিয়াকে দেখে।

সাফিয়া মুচকি হাসে। উঠতি বয়েসের ছেলে-তাকাবেই তো। পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারে যাওয়ার পর থেকেই সাফিয়া তার মনের ভিতরে অদ্ভূত এক পরিবর্তন টের পায়। মাহাজ-এর প্রতি আরও মনোযোগী হয়ে ওঠে। ফায়েক ক’বছর হল সাফিয়ার শরীরের প্রতি একেবারেই উদাসীন হয়ে উঠেছে।

রাতের বেলায় বিছানায় সাফিয়ার পাশে কাঠের মতন শুয়ে থাকে, ছোঁয় না। সাফিয়া কি আর করে? মাহাজ-এর শরীরটি মনে ভাসায়। কখনও রাহিলের ... এক দুপুরে মাহাজ খাবার নিতে এল। শ্বশুর সেদিন ঘরে ছিলেন না, দোকানে গিয়েছিলেন। সাঈদূন বিবিও আসেন নি।

রাতে নাফেসার মা-বাবার দাওয়াত, তারই জোগারযন্ত্র করছেন বোধহয়। সারা বাড়ি ফাঁকা। সাফিয়ার বুকটা কাঁপছিল। ও ওর ঘামে ভেজা হাত দিতে মাহাজ-এর খসখসে হাতটি ধরে। মাহাজ হাসে।

ঝুঁকে চুমু খায় সাফিয়ার গোলাপ-রঙা গালে। সাফিয়ার ঘন নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। তারপর যেন ফায়েককে অপমানিত করার জন্যই মাহাককে শোয়ার ঘরে নিয়ে যায়। মাহাজ অবাক হয়নি। যেন সে জানত।

সাফিয়ার গোলাপি রঙের কোমল শরীরটি ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে সাফিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গত বছর এপ্রিল মাসের শেষের দিকে সাফিয়া ওর ভিতরে নতুন এক জীবনের কাঁপন টের পায়। এ বছরই জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান সাফিার মনের ইচ্ছে পূরণ করেন । হাসপাতালে মেয়ের লালচে শিশু মুখ দেখে সাফিয়া অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল । মনে মনে পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান কে হাজারবার সালাম দিল।

সাফিয়ার শ্বশুর আলী আল আম্মার নাতনির নাম রাখেন জাঈনাব, আলী আল আম্মার মায়ের নাম ছিল জাঈনাব। সাঈদূন বিবি নবজাতককে একটি সোনার মোহর উপহার দিয়ে জাঈনাব এর নাম রাখলেন, সাজিদা; সাঈদূন বিবির মায়ের নাম ছিল সাজিদা । হবু শাশুড়ির সঙ্গে নাফেসাও এসেছে। নাফেসা সাজিদার নাম রাখল আবিয়া। নাফেসার মায়ের নাম আবিয়া।

সদ্য প্রসূত নাতনিকে কোলে নিয়ে অন্ধ আলী আল আম্মার বলেছিলেন, পাঁচ বছর ধরে আল্লা আমার নজর কালো করে দিয়েছেন, তাতে আমার দুঃখ নেই সাফিয়া। কিন্তু এক নজর জাঈনাবকে দেখব না, আমি এই দুঃখ কোথায় রাখি। ২০০৩ সালের ২০ মার্চ। সাফিয়া মেয়েকে নিয়ে একা ছিল ঘরে। মেয়েকে নিয়ে আজ পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারে যাওয়ার কথা।

ফায়েককে বলেছিল, তার নাকি এখন সময় নেই, দোকানে গিয়ে মাহাজ কে পাঠাবে বলল। সাফিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে। মেয়ে হওয়ার পর এই প্রথম মাহাজ কে একা পাবে। মেয়ের হওয়ার পর মাহাজ সাফিয়ার দিকে লাজুক হেসেছিল। মাজারে আজ খাবার নিয়ে যাবে সাফিয়া।

দোলমা রাঁধছিল । আঙুর পাতায় মুড়িয়ে নেবে। টমাটো, কাঁচা মরিচ কেটে আলাদা করেছে । মাজারের খাদেম আবদেল হালেফ লাবান মাখিয়ে দোলমা খেতে পছন্দ করেন। মাজারের কথায় সাঈদূন বিবির স্বপ্নের কথা মনে পড়াতে বুকটা কেঁপে উঠল।

সে দিন সাঈদূন বিবি বললেন, ভারি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম সাফিয়া। কি! দজলা নদীর পাড়ে রাহিল উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ওর গায়ের উর্দিতে আগুন ধরে গেছে । নাফেসা পানি ঢালছে ; কয়েকজন আম্রিকান সৈন্য নাফেসাকে টানতে টানতে নিয়ে যায়, ওর বোরখা ছিঁড়ে ফেলে, তারপর ... নাফেসার চিৎকারে পীর ফাজারুদ্দীন বালাদান-এর মাজারের ওপর আকাশ থেকে আগুনের ফুলকি ঝরে পড়ছে । সাফিয়া শিউরে ওঠে।

তলপেটের কাছে হাত দেয়। ওখানকার চর্বি তিরতির করে কাঁপে। বলে, থাক। এসব কথা থাক। ছোট ছোট করে টমাটো কাটছে সাফিয়া।

মেয়েটা শোওয়ার ঘরের বিছানায় ঘুমাচ্ছে। কী মনে হতে একবার রান্না ফেলে শোওয়ার ঘরে গেল সাফিয়া। বিছানার ওপর ছোট্ট একটি পুঁটলি। ঘুমন্ত। কী মাসুম চেহারা! তেরো বছর পরে কোলে এল।

সাফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে যাবে-তখনই গলির দিক থেকে বিস্ফোরনের প্রচন্ড শব্দ শুনতে পেল। সমস্ত বাড়িটা কেঁপে উঠল। মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গে ট্যা ট্যা করে কেঁদে উঠল। সাফিয়া দ্রুত জানালার কাছে ছুটে যায়।

গলিতে আগুন আর ধোঁওয়ার কুন্ডলী। ওপাশের বাড়ি পুরোপুরি ধ্বসে গেছে। গলিতে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে। গলিতে মাহাজ দৌড়াতে দেখল। এদিকেই আসছে।

আগুন আর ধোঁওয়া দ্রুত ওপরের দিকে উঠে আসছে। সাফিয়ার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আগুনের তাপ টের পায়। প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ পেল। মেয়েকে নিয়ে নিচে নেমে যাবে কিনা ভাবল।

কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। মাহাজ? দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সাফিয়া। মাথা ঘুরছে। দরজাটা কী ভাবে যেন খুলে গেল। সাঈদূন বিবি।

পাগলের মতন চিৎকার করে কী যেন বলছেন। সাঈদূন বিবির পিছনে মাহাজ .. সেও উঠে এসেছে। সিঁড়িতে ধোঁওয়া। সাফিয়ার হঠাৎ মেয়ের কথ মনে পড়ল। ঘুরে দাঁড়াতেই বাড়িটা দুলে ওঠে ভেঙ্গে পড়তে থাকে ... উৎসর্গ: ২০০৩ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৮৫ হাজার নিহত ইরাকির উদ্দেশ্যে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.