আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভালো চাকর তৈরির শিক্ষা



আমাদের স্বপ্নের স্বদেশ আটত্রিশ যাপন করছে। চাওয়া-পাওয়ার ফারাক সত্ত্বেও অর্জনটা নেহাত কম নয়। আমরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছি, বিশ্বসভায় পেয়েছি সম্মানের আসন। এই এতোদিনে তৃতীয় বিশ্বের কাতার থেকেও উৎরে যেতে পারতাম। ভালোমতোই সম্ভব ছিলো সেটি, নিজেদের যা আছে তা দিয়েই।

বিপুল জনশক্তি, উর্বর মাটি, মাটির তলায় অঢেল সম্পদ। সব বাদ দিয়ে পানির কথাই ধরুন, এতো মিঠে পানি পৃথিবীর কোথাও নেই। শুধু এ পানি প্রক্রিয়াজাত করে সারা দুনিয়ায় রপ্তানি করা যায়। কিন্তু নিজের সম্পদ আমরা নিজেরা কাজে লাগাতে পারি না, মেধা বাইরে পাচার করে দিয়ে তেল-গ্যাস তুলবার জন্যে নাইকো-ফাইকো কতো কাকে ডাকাডাকি! সাহিত্যে সঙ্গীতে দুনিয়াকে দান করবার মতো সমৃদ্ধি আমরা অর্জন করেছি; কিন্তু পিছিয়ে আছি অর্থ ও প্রযুক্তিতে। আরো একটা খুব স্পর্শকাতর জায়গা আছে, যেখানে আমরা কেবলই খাদে গড়িয়ে পড়ছি _ মূল্যবোধ।

এখানে আমরা মানে প্রধানত আমাদের নেতারা। এঁদের সকল ভালোবাসার কেন্দ্রে আছে টাকা, দেশ নয়। নীতিবোধের পরোয়া করবার দায় বোধ করেন না। ফলে, আমরা যে এখনো তৃতীয় শ্রেণীতে, তার দায়ও এঁরা এড়াতে পারেন না। আমার এক বন্ধু সেদিন এক পয়সাওয়ালাকে ধরে এনে মানপত্র দিলো।

প্রশংসার তোড়ে ভাসিয়ে লোকটাকে প্রায় মহাপুরুষ বানিয়ে ফেললো। ধান্দা, সংগঠনের জন্যে কমপিউটার খসানো। আমাকে বললো, রাজনীতিটা বুঝতে পারছিস? বুঝলাম, এখানে রাজনীতি মানে চাতুরি। গ্রামে পলিটিক্স বললে লোকে বোঝে প্রতারণা। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর মননশীলতার চর্চা যাঁরা করেন, রাজনীতিতে জড়াতে তাঁদের রুচিতে বাধে।

নীতিহীন রাজনীতিকরা শব্দটাকে পঁচিয়ে ফেলেছেন। কিছুদিন পরে হয়তো বাংলা অভিধানে যুক্ত হবে: রাজনীতি_ (ব্যঙ্গার্থে) চাতুর্য। এটি স্পষ্ট যে দেশের মানুষ দুর্বৃত্ত নেতাদের চিনে ফেলেছে। ঠেকে সমীহ করে, বিশ্বাস করে না। ভোট দেয়, দিতেই হবে, যতোদিন না ভালো বিকল্প তৈরি হচ্ছে।

গরিষ্ঠ জনসংখ্যার দেশে সবাই যেখানে কর দিচ্ছে, লুটপাটের পরও কিছু উদ্বৃত্ত থেকেই যায়, তা দিয়ে পথঘাট হয়। এভাবেই স্বাধনিতার পর থেকে তিল তিল করে দাঁড়িয়েছে একটা রাষ্ট্রীয় কাঠামো। স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই কমবেশি কাজ হয়েছে। কিন্তু একটি খাত একদম বাদ পড়ে গেছে, সবচে' জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণ যাতে মৌলিক পরিবর্তনের কোনো ছোঁয়াই লাগে নি _ সে হলো শিক্ষা। এ যাবত একে একে পাঁচটি শিক্ষা সংস্কার ও সুপারিশমালা প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়েছে : ১৯৭২, ১৯৮৮, ১৯৯৭, ২০০২ ও ২০০৩-এ।

প্রত্যেকটি কমিটিই গবেষণা এবং বিভিন্ন দেশের পাঠক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি নিরীক্ষণ করতে গিয়ে খরচ করেছে কোটি কোটি টাকা। তাতে সরকারের কোনো লাভ নিশ্চয়ই হয়েছে, তবে দেশের কোনো কল্যাণ হয় নি। একটি সুপারিশও কার্যকর হয় নি। কেনো হয় নি, এমনকি সে কারণও দেশবাসীকে জানানো হয় নি। হবার মধ্যে হয়েছে বিতর্ক।

বিতর্কের বীজ রিপোর্টগুলোতেই পুঁতে দেয়া হয় বলে। এবারও তাই হয়েছে। নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশের শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ সাহেব খসড়া শিক্ষানীতি তৈরির জন্যে যাঁদের ডেকে পরামর্শ নিয়েছেন তাঁদের ভেতর ইসলামি নৈতিকতায় বিশ্বাসী কেউ ছিলেন না। হাজার হাজার মাদরাসা থেকে একজন প্রতিনিধিকেও তিনি দাওয়াত করেন নি। ফলে নিজের দেয়া বিশেষণ অনুযায়ী তিনি যে, 'গণমুখী, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক ও সর্বজনীন' 'শিক্ষানীতি তৈরি করেছেন, সেটি আদৌ সর্বজনীন বলে স্বীকৃত ও কার্যকর হবে কি না, সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বক্ষমাণ শিক্ষানীতিতে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা সংকোচনের প্রতিবাদে দেশজুড়ে সভা-সেমিনার হচ্ছে। আসলে ধর্মকে উপেক্ষা করে নৈতিকতার দাবি খুবই হাস্যকর ব্যাপার। ফলে মানুষের মনে প্রশ্ন : কেমন মানুষ তৈরি করতে চায় সরকার? বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা তো অসংখ্য অভিজ্ঞ চিকিৎসক তৈরী করেছে, যাদের বিবেক নেই। অনেক প্রকৌশলী, যাদের সৃজনশীলতা নেই। বহু শিক্ষক, যাদের আদর্শ নেই।

অজস্র নেতা, যাদের নীতি নেই। প্রচুর ছাত্র _ এদের জিজ্ঞেস করে দেখুন, কেনো পড়াশোনা করছো, কিছু না ভেবেই বলবে, চাকরির জন্যে। শিক্ষাবিদ তাত্তি্বকরা শিক্ষার লক্ষ্য নিয়ে যা-ই বলুন, বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষার্থীরা জেনে ফেলেছে যে, তারা পড়ছে চাকরির জন্যে। চাকরি তো চাকরের কাজ। সেই কাজের জন্যে দক্ষ চাকর তৈরি করতে চাইছে সরকার? কুরআন-সুন্নাহর বিশ্বমানবিক দর্শন ও সুন্দর জীবন গঠনের নীতিমালা উপেক্ষা করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে সরকার চালু করতে চায় কেবলই 'ভালো চাকর তৈরির শিক্ষা'? শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দেখেই আমি এ লেখাটির এমন রূঢ় শিরোনাম দিয়েছি।

কেননা প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতির ভূমিকায়ই 'শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য' অধ্যায়ে 'সেক্যুলার' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। ভেবে আশ্চর্য হলাম, আমাদের মাতৃভাষায় প্রকাশিত শিক্ষানীতির প্রণেতারা এমন কী মর্ম বুঝাতে ওই বিদেশি শব্দটি প্রয়োগে বাধ্য হলেন, বাংলায় যার প্রয়োগযোগ্য শব্দ খুঁজে পেলেন না? এ কি তবে বিশেষ পরিভাষা হিসেবে প্রযুক্ত, যা মূলত একটি মানবরচিত জীবনদর্শন তথা ধর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেই সেক্যুলারিজম? তাহলে কি নব্বই পৃষ্ঠার দীর্ঘ খসড়া শিক্ষানীতির ভেতরে প্রবেশ করার আগেই যৌক্তিকভাবে এই খসড়া সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, উপরিউক্ত বিতর্কিত মতবাদকে ভিত্তি করে যে শিক্ষানীতি প্রণীত, তাতে আমাদের জাতীয় আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কিছুতেই সম্ভব নয়? এবার আমরা দ্বিতীয় যে খসড়া সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি তা হলো, প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি সংবিধান পরিপন্থী। কেননা এটি প্রণীত হয়েছে মূলত ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশমালার আলোকে। যে কমিশনটি ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সংবিধান নির্দেশিত রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি গণতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়। পরবর্তীকালে বারবার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আসে।

এখন আমাদের জাতীয় মূলনীতি হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সুবিচার অর্থে সমাজতন্ত্র। কাজেই কুদরত-ই-খুদা কমিশন প্রদত্ত সুপারিশমালা আমাদের বর্তমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে পরিত্যক্ত, একই কারণে সেই সুপারিশমালার অনুকরণে প্রণীত বর্তমান প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিও সংবিধানসম্মত নয়। প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে আমাদের তৃতীয় সিদ্ধান্ত, এ শিক্ষানীতি প্রকৃতপক্ষে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে নীতিহীন নাস্তিক্যবাদের দিকে ঠেলে দেবার সর্বনেশে পরিকল্পনা। কারণ যে দেশের মা-বাবা তাঁদের সন্তানকে কথা বলতে শেখার পরই একত্ববাদের কালেমা শেখান, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের ধারণা দেন, সত্য কথা বলতে ও বড়দের সম্মান করতে শেখান, সেই দেশের সব ধরণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠক্রমকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষামুক্ত করার প্রস্তাব রীতিমতো অযৌক্তিক। এমনকি মাদ্রাসাতেও অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত কুরআন, আকাঈদ, ফিকহ ইত্যাদি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোকে আবশ্যিক হিসেবে না রেখে অতিরিক্ত রাখা হয়েছে।

এতেই শেষ নয়, এগুলো পড়াতে হলে নাকি সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হবে। বিজ্ঞ পাঠকের কাছে বিনীত নিবেদন, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যে রাষ্ট্রের বুনিয়াদ, সে দেশে এমন প্রস্তাব পেশ করাকে যদি ধৃষ্টতা বলি, খুব কি অন্যায় হবে? পুরো প্রস্তাবটি দেখুন, শিশু শ্রেণী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোথাও ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যিক রাখা হয় নি। প্রয়োজনের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ললিতকলাকে। আমরা এ শিক্ষানীতির সমস্ত ধারা-উপধারা বিশ্লেষণের প্রয়োজন দেখছি না, একে সংশোধনের উপযুক্ত বলেও ধরে নিতে পারছি না, বরং স্পষ্ট ভাষায় দাবি জানাচ্ছি, এ শিক্ষানীতি অবিলম্বে বাতিল করা হোক। মনে করিয়ে দিচ্ছি, বাংলাদেশের সংবিধানের সূচনা হয়েছে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' দিয়ে।

এ দেশের নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। বাকী সবাইও হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান ইত্যাদি একেকটি ধর্মে বিশ্বাসী। সেকু্যলারিজম আমাদের আদর্শ নয়। কাজেই আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি কোনো অবস্থাতেই বস্তুবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ বা সেক্যুলার দর্শনের ভিত্তিতে রচিত হতে পারে না। হলেও সেটি গ্রহণযোগ্য হবার কোনো কারণ নেই।

শিক্ষার ওপর জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল। সুতরাং নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন বুদ্ধিজীবি, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও বরেণ্য আলিমদের সমন্বয়ে নতুন কমিটি গঠন করে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে সত্যিকার অর্থেই সর্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করুন। এটাই সবার প্রত্যাশা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.