আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আল জাজিরাঃ দ্য ভয়েস অব আরব



কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা। নাম শুনলেই অনেকে আল কায়েদার গ পায়। অনেকে এটাকে আল কায়েদার মুখপাত্রও ভাবে। আবার অনেকে সন্দেহ করেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের হয়ে মুসলমানদের পক্ষে থেকে কাজ করছে এটি। চ্যানেলটি মুসলিম সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে নিছক ব্যবসা করছে এমনটিও ভাবেন অনেকে।

আল জাজিরা আরবি শব্দ। যার অর্থ উপদ্বীপ। মূলত আরব উপদ্বীপ। অর্থাৎ আরব বিশ্বের প্রতিনিধিত্ব করছে চ্যানেলটি। কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফার ১৫০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে চ্যানেলটি।

চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় তারই কাজিন শেখ হামাদ বিন থামার আল থানিকে। ডিরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বে আছেন ওয়াদাহ খানফার। আরব ও চলতি বিশ্বের ঘটনা মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যেই কার্যক্রম শুরু হয় আল জাজিরার। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের কাজের পরিধি ও দায়িত্ব। সাথে জনপ্রিয়তাও।

মূলত ৯/১১’র ঘটনার পর আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেন ও অন্য নেতাদের ভিডিও ফুটেজ প্রচার করায় চ্যানেলটি সবার নজরে আসে। পরবর্তী বছরগুলোতে চ্যানেলটি পেয়েছে একের পর এক সাফল্য। ফলে চ্যানেলটিকে বিবিসি, সিএনএন, এএফপি’র মতো বাঘাবাঘা মিডিয়াগুলোও সোর্স হিসেবে ব্যবহার করছে। আল জাজিরার আয়ের একটি বড় উৎস হয় ফুটেজ বিক্রি। আরববিশ্বের দেশগুলোতে এক সময় জাতীয় চ্যানেল ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল দেখা যেত না।

সেক্ষেত্রে সব ধরণের খবরের জন্য জাতীয় চ্যানেলই ছিল শেষ ভরসা। আল জাজিরার উত্থান সে সমস্যা মিটিয়েছে শতভাগ। সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইনসহ ওই অঞ্চলের দেশগুলোর জাতিগত নানান অসঙ্গতি তুলে ধরার পাশাপাশি বেশ কয়েকটি অন্তর্জাতিক ইস্যুও দর্শকদের সামনে তুলে ধরে ব্যাপক উদ্দীপনা ও আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয় আল জাজিরা। এ লক্ষ্যে তারা ১৯৯৯ সালে চালু করে `El-Itidjabel Mouaka' নামের লাইভ প্রোগ্রাম। যেখানে যুক্তি করে তুলে ধরা হয়েছে বেশ কিছু জাতীয় ইস্যু।

এজন্য সমালোচনার মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাদের। প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের একটি ঘটনা। ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস ও এরাবিক ল্যাংগুয়েজ টিভি স্টেশন একটি চুক্তি করে আরব বিশ্বে নতুন টিভি চ্যানেল চালুর বিষয়ে। কিন্তু সৌদি সরকারের বাধার মুখে তাদের এ কাজে ব্যাঘাত ঘটে। মাত্র দু’বছরের মাথায় ব হয়ে যায় নয়া এ স্টেশনটি।

এগিয়ে আসেন কাতারের আমির শেখ হামিদ বিন খলিফা। খোলেন আল জাজিরা। কিন্তু তাতে বেগ আসছিল না। পরে ব হওয়া বিবিসির অনেক স্টাফ ও সাংবাদিককে আল জাজিরায় কাজ দেন তিনি। সে থেকেই আল জাজিরা পায় জেটের গতি।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে চ্যানেলটি টুইন টাওয়ারে হামলার পেছনে লাদেনের সম্পৃক্ততা ঘোষণা করে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে মার্কিন প্রশাসন আল জাজিরাকে সমর্থন করলেও ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ ছিল। সে সময় আল জাজিরাকে মার্কিন বিদ্বেষী অপশক্তি বলতেও পিছপা হয়নি তারা। ফলে ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল আল জাজিরার বাগদাদ অফিসে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় নিহত হন তারেক আইয়ুব নামে এক রিপোর্টার।

কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের রক্তচুক্ষু উপেক্ষা করে আল জাজিরা তার সম্প্রচার অব্যাহত রাখে। ইরাকের বিরুদ্ধে অবস্থানের অজুহাতে ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট ইরাকে আল জাজিরার অফিস ব করে দেয়া হয়। কিন্তু এরপরও ইরাকে মার্কিন অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ ব করেনি চ্যানেলটি। মার্কিন আক্রমণ থেকে মুক্তি পায়নি আল জাজিরার কাবুল অফিসও। ২০০১ সালে কাবুল অফিসে মিসাইল হামলা চালানো হয়।

আল জাজিরার ক্যামেরাম্যান সুদান নাগরিক সামি আল হাজকে আফগানিস্তানে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ডিটেনশন দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। এভাবে অব্যাহতভাবে চাপ বাড়তে থাকে চ্যানেলটির বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালের ৩০ জানুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস আল জাজিরা চ্যানেল ক্রয়ে মার্কিন প্রশাসনের আগ্রহের কথা প্রকাশ করে। রিপোর্টে এজন্য কাতার সরকারকে বুশ প্রশাসন থেকে চাপ দেয়ার কথা উলে্নখ করা হয়। অবশ্য ২০০৭ সালে চ্যানেলটি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় জাজিরা কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু এরপরও বসে থাকেনি বুশ প্রশাসন। বারবার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে সম্প্রচারে। যুক্তরাষ্ট্রে আভ্যন্তরীণ চাপের মধ্যে পড়লে বুশ লাদেনের বিভিন্ন ফুটেজ নিজেরা তৈরি করে আল জাজিরার মাধ্যমে তা প্রচার করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। উদ্দেশ্য জনমতকে বুশের পক্ষে নেয়া। এছাড়াও চ্যানেলটিতে নিজেদের লোক ঢুকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মার্কিন ও ইসরাইল প্রশাসন।

আল জাজিরার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ ঘণ্টা আরব সংবাদ নিয়ে। তবে ২০০৩-০৪ সালে এর সাথে যুক্ত হয় আল জাজিরা স্পোর্টস ওয়ান ও আল জাজিরা স্পোর্টস টু নামের আরো দুটি স্পোর্টস চ্যানেল। অনেকটা বিবিসির অনুকরণে ২০০৫ সালে চালু করা হয় আল জাজিরা মোবাশ্বের নামের আরও একটি চ্যানেল। এই চ্যানেলে কোনো সম্পাদনা ছাড়াই রাজনৈতিক দলের সম্মেলন, সেমিনার প্রচার করা হয়। একই বছর শিশু-কিশোরদের জন্য চালু করা হয় আল জাজিরা চিলড্রেন চ্যানেল নামে আরো একটি চ্যানেল।

প্রথম দিকে আরবি ভাষায় সংবাদ প্রচার করলেও পরে ২৪ ঘণ্টা ইংরেজি সংবাদ প্রচার শুরু করে। যা আল জাজিরা ইংলিশ চ্যানেল বা আল জাজিরা ইন্টারন্যাশনাল নামে পরিচিত। বিবিসি ও সিএনএন’র সাথে পাল্নায় টিকে থাকতে গত বছর চালু করে আল জাজিরা ডকুমেন্টারি চ্যানেল। চ্যানেলটি শিগগিরই পাকিস্তান ও উর্দু ভাষাভাষীদের জন্য আল জাজিরা উর্দু নামে আর একটি চ্যানেল চালু করতে যাচ্ছে। এছাড়াও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে একটি আন্তর্জাতিকমানের সংবাদপত্র প্রকাশের।

আরব বিশ্বের ৪ কোটি দর্শক প্রতিদিন আল জাজিরা উপভোগ করছে। শুধু আরব নয় সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়েছে চ্যানেলটি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ৯৬ ভাগ মুসলমান, দুই দশমিক চারভাগ খ্রিস্টান ও শূন্য দশমিক দুইভাগ ইহুদি এ চ্যানেলটি দেখে। কাতারের দোহায় এ চ্যানেলটির প্রধান কার্যালয়। চ্যানেলটি লন্ডন, কুয়ালালামপুর এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে একযোগে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠান পরিচালনা করছে।

শত সমালোচনা সত্ত্বেও বেশ কয়েকটি পুরষ্কার জিতে নিয়েছে এ চ্যানেলটি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।