আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

*~*| |* ঈদের চাঁদের মাঝে লুকিয়ে থাকা পূনর্জন্ম *| |*~*

এই ব্লগের সব লেখা সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
সকাল ৭টার এ্যালার্মটা প্রতিদিনের জন্যই দেয়া থাকে তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই এ্যালার্মে ওর ঘুমটা খুব কম দিনই ভেঙ্গেছে , সবসময় দেখা যায় তার ঘুমটা দু চার মিনিট আগেই ভেঙ্গে যায় আর এ্যালার্ম বাজার আগেই তা বন্ধ করে দেয় ... আজ অনেক দিন পর... উহু , অনেক দিন বললে বোধ হয় ভুল হবে অনেক বছর পর ঘুমে যেন তার চোখ আটকে আসছিল, এ্যালার্মের শব্দে আজকে যেন উঠতেই মন চাইছিল না, ঘুমের ঘোরেই মন বলছিল এই কর্কশ ডাকের যায়গাতে যদি কোন মধুর শব্দে আজ ঘুম ভাঙ্গতো তবে হয়ত আজকের সকালটা হয়ে উঠতো অন্যরকম সুন্দর ... অন্যসময়ের মতই, গত একমাসে প্রতিদিন সেহরী খেয়ে একটু ঘুমানোর অভ্যাসটার সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে সে, তাইতো এখন পর্যন্ত কখনো তার কাজে যেতে দেরী হয়নি তবে আজ হঠাৎ এই চিন্তার ঘোরের কারনেই হয়ত ১৫ মিনিট দেরিতেই ঘুমটা ভাঙ্গলো ... ত্রস্ত পায়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে সুনিপুন হাতের সুক্ষ কারুকাজে নিজেকে রেডি করতে কখনোই তার ১৫ থেকে ২০ মিনিটের বেশী লাগে না ... আজও তার ব্যাতিক্রম না হলেও কেন যেন মনের মাঝে এক অন্যরকম অনুভুতি দোলা দিয়ে যাচ্ছিলো .... ঠিক ৭:৪৫ এ দরজায় তালা লাগিয়ে করিডোর দিয়ে হাটতে হাটতে এত বছরের পরিচিত যায়গাটাকে যেন নতুনের মত মনে হচ্ছিলো ... এটা কি সকালে ১৫ মিনিট দেরি হওয়ার কারনে মনে হতেই হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিশ্চিত হলো -- নাহ ! আজ অফিসে যেতে দেরী হবে না, হাতে যথেষ্ট সময় আছে ... করিডোর পার হয়ে লিফটের সামনে আসতেই প্রতিদিনের সেই পরিচিত মুখগুলোকে দেখতে পেল যারা একসাথে একই সময়ে লিফটে করে নিচে নামে ...মিস্টার আর মিসেস এরিক তার আদরের মেয়ে ক্যারিন, আর তাদের পাশে দাড়িয়ে আছে কলেজগামী আরেক প্রতিবেশীর মেয়ে ... সেই সাত আট বছর ধরে দেখছে ওকে তবুও আজ যেন ওর নামটা মনে করতে পারছে না ,নিজের মনে নিজেই প্রশ্ন করে বসে ওর নামটা যেন কি ? ... কাছে আসতেই যন্ত্রচালিত মানবের মত সবাইকে শুভ সকাল বলে দাড়িয়ে গিয়ে আজ লক্ষ্য করলো ওরাও শুভসকাল বলে প্রতিউত্তর করে, কিন্তু সবার মুখে থাকে এক অন্যরকম স্নিগ্ধতার পরশ ... মনে মনেই আবার প্রশ্ন করে বসলো -- এই জিনিসটা এত বছরেও কেন আমার চোখে ধরা পড়লনা ?... সামান্য কিছুক্ষন পর, অভ্যস্ত হাতে পার্কিং লট থেকে হুশ করে বেরিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করলো আজকের সকালটা একটু অন্যরকম লাগছে ... জানালা টার উপর দিকে অল্প একটু নামিয়ে দিতেই সকাল বেলার টাটকা হাওয়া ওর গায়ে যেন ছুয়ে দিলো এক অনাবিল শান্তির ছাপ ... মনটা যেন একেবারেই ভাল হয়ে গেল সাথে সাথে, অথচ কাল রাত থেকে সে অন্যরকম কিছু প্ল্যান করছিল আজকের জন্য ... প্ল্যানটার কথা মনে পড়তেই আস্তে আস্তে সে যেন ফিরে চলছিল সেই আগের মানুষটির মাঝে যাকে সে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে গত সাত আট টি বছর ধরে ...যার ভিতর থেকে ধীরে ধীরে এক একটা করে বের করে দিয়েছে অনুভুতির ছিটেফোটা ... নিটল কালো গভীর দুটি চোখে প্রতিস্হাপন করেছে নিশ্চল পাথরের স্হবিরতা ... মন থেকে মুছে ফেলেছে আনন্দ নামক জিনিসটি ... সবার মাঝে থেকেও এক অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে সবার কাছ থেকে ... হুমমম ... এক দু জন নয়, সবার কাছ থেকেই সে আজ দুরে ... শারিরীক আর মানসিক, দুভাবেই ... বস্তু জগতের কঠোরতা আপন করে নেয়ার বিনিময়ে দুর করেছে মনের সুপ্ত ইচ্ছেগুলো, ভালোলাগা গুলো আর সেই সাথে ভালবাসা ... নাহ ! এ জিনিস গুলো আজ কেন তাকে এভাবে ভাবাচ্ছে ? এগুলো সে তো কখনো চিন্তা করে না ... তবে আজ কেন করছে ? অফিসে গিয়ে কালকের কাজের একটা প্ল্যান তৈরি করতে হবে, ঠিক কি কাজ করলে নিজেকে সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত ব্যাস্ত রাখা যাবে তা নিয়ে বরং চিন্তা করা যাক ... এবার সে ঐ দিকেই আবার নিজের মনোযোগকে নিবদ্ধ করার পাশাপাশি হয়ে উঠলে লাগলো সেই চিরাচরিত অন্যমানুষে ... অফিসে ঢুকতেই আজকে দেখে কাজের চাপ বেশ কম, সবাই যার যার কাজ বেশ আগে ভাগেই শেষ করে রেখেছে, মুসলমান কলিগ গুলো সবাই আজ বেশ সকালে এসেই কাজে হাত লাগিয়েছে, যেন একরকম উঠে পড়ে লেগেছে দুপুরের আগেই আজকের কাজগুলো শেষ করে কালকের কাজের কিছু অংশ শেষ করে একদিনের ছুটি নিয়ে ঈদের দিনটা আনন্দে কাটাতে পারে ... সবার মুখেই এক অন্যরকমের পরিতৃপ্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে , এক মাস সিয়াম সাধনার পরে কাল ঈদ ... বিদেশ বিভুইয়ে অইসলামিক দেশে ঈদের জন্য একটা দিনের বেশী ছুটি পাওয়াটা কল্পনার ব্যাপার তবে ঈদের দিন ছুটিটা সবাই যে ভাবেই হোক নিয়ে থাকে ... নন-পেইড ছুটি হলেও নিয়ে নেয় ... কিন্তু সে অন্যরকম একজন, তাই তার কাজ ও অন্যরকম ... সে ছুটি নেয়, সবার মত সেই ঈদের দিন ছুটি নেয় তবে মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য ... ঈদের নামাজটা পড়ে সে সোজা চলে আসে কাজে, এরপর গভীর রাত পর্যন্ত নিজেকে ব্যাস্ত করে রাখে কাজের মাঝে যাতে কোনভাবেই ঈদের পুরোনো স্মৃতিগুলো ওকে তাড়া করে নিয়ে না যেতে পারে সেই অসামান্য আনন্দের মুহুর্তগুলোতে যখন ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত রমজানের আগে থেকেই ... কাছের বন্ধুরা সব এক ডিজাইনের পান্জাবী, স্যান্ডেল আর চাদর পরে ঈদ করবে বলে পুরো রমজান মাসটি দল বেধে ঢাকার প্রতিটি শপিং সেন্টার চষে ফেলতো ... একটাও যদি কম পাওয়া যেত তবে সে ডিজাইন যতই পছন্দের হোক না কেন বাদ দিতে এক সেকেন্ডও কার্পন্য করতো না, ঈদের দিন থেকে নিয়ে পরের দুই তিন দিন একটানা বেষ্ট ফ্রেন্ডগুলোর সাথে কাটিয়ে তৃতীয় বা চতুর্থ দিনে ঘরে ফিরে আম্মুর অভিযোগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যেত " সেই ঈদের দিন নামাজ পড়ে এসে একটু খেয়ে বের হয়েছিলে আর দুদিন পরে বুঝি ক্ষিদে পেয়েছে ?" ... এর পরে এমনি আদরের বকাগুলো শুধু সে না, বরং তার কাছের বন্ধুগুলোকেও খেতে হতো সবকটা মায়ের কাছ থেকে, কখনো কখনো ঈদির বদলে সবার পিঠে পড়ত গোটা কয়েক ধুমধাম কিল ... হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিতে দেখে মায়েদের মনগুলো কেমন করে যেন গলে যেত, পরম মমতার আদরে ভরে দিতেন সবকটা ছেলেগুলোর জীবন ... সব ক'জনের বাবা একরকম ছিলেন না তবে জানতেন এই বাদরের দল ঘরে ঢুকলে তাদের পকেটের উপর হামলা হবেই, এ ক'দিন একটানা ঘুরাঘুরি করে নিশ্চয়ই ওদের পকেট খালি বলেই ঘরে ঢুকেছে, তাই তারাও আগেভাবে নিজের পকেটগুলোকে রেডি করে রাখতেন যাতে "চাহিবামাত্র নোটগুলোর আসল বাহকদের হাতে সেগুলো হস্তান্তর করা যায়" ... নাহ ! আজ এত বছর পরে কেন এসব মনে পড়ছে, সে তো সবার থেকে এতদুরে আছে বলে এসব পুরোনো স্মৃতি মনে করতে দুঃখ বাড়াতে চায় না, যে জিনিস আর কখনো ফিরে পাবার নয় তার আশা কেন করবে সে ? এ জীবনে কষ্ট পাওয়ার মত অনেক কিছুই আছে, আর বাড়ানোর দরকার নেই, এ কথাটিকেই মনে রেখে নিজের জীবন থেকে বছরের দুটি কষ্টের দিন গুলোকে অতি সন্তর্পনে দুরে রেখে চলেছে প্রতিবার ... ঈদ এখন আর তার জীবনে আনন্দ নিয়ে আসেনা , বরং তা যেন আসে স্মৃতির সুঁচালোর কাঁটার সুতীক্ষ্ণ খোচায় ওকে রক্তাক্ত করে তুলতে ... এসব ভাবতে ভাবতেই আজ কখন যে দুপুর গড়িয়ে গেল ভেবেই পেলনা সে ... সেল ফোনে টেক্সের শব্দে চিন্তার রেশটা কেটে যেতেই দেখে আব্বু আম্মু একসাথে নাম লিখে ম্যাসেজ দিয়েছে, কাল আমাদের ঈদ, ঈদ মোবারক ... সাথে সাথে সেল ফোন থেকেই ডাইরেক্ট ফোন করে তাদেরকেও ঈদের মোবারকবাদ দিয়ে শক্ত চোয়ালে ফুটিয়ে তোলা মৃদু হাসির শব্দে ওদের মন ভরিয়ে দিয়ে লুকিয়ে রাখলো নিজের সব দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রনা ... এর কিছুক্ষন পরে এক আরেকটি টেক্সট ... ""আজ আমার আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে, তোমার আকাশেও নিশ্চই উঠবে,কখনো না বললেও আমি জানি তুমি ঈদের দিনে কেমন করে কাটাও, তোমার যেভাবে খুশী তুমি সেভাবে নিজের ঈদের দিনটি কাটাও তাতে আমি কিছুই বলবো না, শুধু একটা অনুরোধ - অন্তত এবারের ঈদের চাঁদটা কি তুমি আমার জন্য দেখবে ?"" পরিচিত এই কাছের মানুষটা কখনোই তার কাছে কিছু চায়নি, আজ কি মনে এমন আবদার করলো সে ? সে কি জানে না এই কাজটা করতে তার কি পরিমান কষ্ট হবে ... সে কি সব যেনেও বুঝতে চায় না নিজের সাথে কি পরিমান যুদ্ধ করে তাকে এই কাজটা করতে হবে ... আজ সে নিজেও বুঝতে পারছেনা এই টেক্সট টি যেন তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে সেই পুরোনো আনন্দে উচ্ছল ঝলমলে দিনগুলোতে ... অনেক করেও নিজেকে যেন আর বেঁধে রাখতে পারছে না অদৃশ্য সেই দেয়ালের মাঝে , যা এত বছর ধরে তিলে তিলে সে নিজেই গড়ে তুলেছিল নিজের চারপাশে ... মাথাটা যেন আজ আর নিজের নিয়ন্ত্রনে নেই ... অনেকটা ঘোরের মাঝেই সে ঐ কাছের মানুষটিকে টেক্সট রিপ্লাই দিয়ে বসলো -- "আমার মনে কেন যে এমনটা হচ্ছে ঠিক জানি না, তবে আজ সত্যি সত্যি তোমার জন্য ঈদের চাঁদ দেখতে খুব ইচ্ছে করছে" (সবাইকে ঈদ উল ফিতরের অগ্রিম শুভেচ্ছা -- ঈদ মোবারক )
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।