আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওই বুট ওই লাথি, ওই আমাদের শিক্ষক, ওই পড়ে মার খায় জনতার লোক

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

হ্যাঁ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে রাস্তায় পেড়ে ফেলে লাঠিপেটা, পদাঘাত, বুট দিয়ে পেষা আমরা সহ্য করে নেব। আমাদের চোয়াল শক্ত হলেও, দাঁতে দাঁতে পেষাপেষির শব্দ আপাতত কাউকে শুনতে দেব না।

কারণ, দিনবদলের সরকার আর গ্যাস-কয়লার লুণ্ঠনের সহযোগী দালালদের আমরা সহ্য করে নিয়েছি। কারণ, এনজিও আর কর্পোরেটের দালালদের আমরা জাতীয় বুদ্ধিজীবীর তকমায় মুড়িয়ে কেষ্ঠগোপাল বানিয়ে মাথায় করে রেখেছি। আমাদের এখন গা কাঁপলেও, চোখ জ্বললেও আমরা স্বাভাবিক হয়ে যাব। একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের নির্মম-নৃশংস ও নোংরাভাবে হত্যা করার পরও তো আমরা স্বাভাবিক আছি। আছি না? আমাদের এই বিষাক্ত স্বাভাবিকতা, আমাদের এই অসহ্য কাপুরুষতা, আমাদের এই নির্লজ্জ নিরাপত্তাকাতরতার খেসারত দিতে দিতে আমাদের পশ্চাদদেশ লাল হয়ে গেছে, আমাদের সবুজ দেশটা ধর্ষণে ধর্ষণে মধ্যাঙ্গে স্থায়ী লাল রক্তিমা নিয়ে চললেও আমরা বলবো, ওই লাল স্বাধীনতার সূর্যের আভা।

কোনো এক রাষ্ট্রদূতের থাপ্পর খেয়েও আমরা মুখে হাসি ধরে রাখি। দেশের মাটির তলার গ্যাসসম্পদ সাবাড় হয়ে গেলেও, সমুদ্রের গ্যাস বিদেশি বেনিয়াদের তুলে দেব বলে আমরা দিনবদলের সরকার আনি। অবোধ পশু-পাখির সামনে ন্যাংটো হতে কেউ লজ্জা পায় না। এদেশের অসংগঠিত নেতৃত্বহীন জনতাকে হাসিনা-খালেদার সরকার, ইঊনূস-আবেদেন সিভিল সোসাইটি আর মরিয়ার্টি-পিনাক-ওয়ালিকদের কাশিমবাজার কুঠির বালবংশধররা দেশকে ন্যাংটো করতে লজ্জা বোধ করেন না। জনগণকে নির্বোধ ঠাউরে নিয়ে ন্যাংটা দশার খ্যামটা নাচে তারা বিব্রত হয়না।

এই ন্যাংটার নাই বাটপারের ভয়ের দেশে আনু মুহাম্মদরা মার খাবেই। ভুলতে গিয়েও তবু ভুলি না, এই ব্যক্তি ব্যক্তি নন কেবল। বাল্যকাল থেকে বিচিত্রায় লিখতে শুরু করা আনু মুহাম্মদ, দীর্ঘকাল বিপ্লবী রাজনীতির সংগঠক আনু মুহাম্মদ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সম্পদ রা আন্দোলনের অন্যতম নেতা আনু মুহাম্মদ, দেশের প্রায় একমাত্র মার্কসীয় অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংক-এডিবি-আর এনজিওদুর্গে অনবরত আঘাত হানা আনু মুহাম্মদ, ফুলবাড়ী কয়লাখনি রা আন্দোলনের সাফল্যের অন্যতম নায়ক ফুলবাড়ীবাসীর প্রাণাধিক আনু মুহাম্মদ, রাজনৈতিক অর্থনীতির জনপ্রিয় লেখক আনু মুহাম্মদ অনেক বিচারেই এক নিঃসঙ্গ বিদ্রোহী, এক বিরল শেরপা। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষকের মতো নন তিনি। বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি ক্ষমতার নানানমহলের মধু খেয়ে মহান হতে পারেননি।

দালালির সুবিধায় ওপরমহলের রাকবচ জোটেনি তাঁর। তিনি এদের অনেকের জন্য অনিরাপদ। তাই গোপন মহল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে হুমকি আসে অনবরত। তাঁর রিকশাকে আঘাত করে পা ভেঙ্গে দিয়ে যায় অচেনা পাজেরো। তাঁর ওপর বোমা পড়ে।

আর আজ বাংলাদেশের পুলিশ সমুদ্রের গ্যাস বিদেশিদের তুলে দেওয়ার প্রতিবাদ মিছিল থেকে তাঁকে রাজপথে শুইয়ে পেটায়, লাথি মারে। ওই পুলিশ আর তাদের অভিভাবক সাহারা খাতুন, ওই ওসি আর তার প্রভু বেনিয়া অধিপতি, ওই সরকার আর তার প্রভু মার্কিন-ভারত, তারা ওখানে এক অধ্যাপককে এক শিক্ষককে এক প্রতিবাদী মনীষাকে পদাঘাত করছে না কেবল, পদাঘাত করছে বাংলাদেশের বিলুপ্ত প্রজাতির এক মানুষকে, যিনি তাঁর সামর্থ্যরে সর্বস্ব দিয়ে জনতার সংগ্রামের সামনের সারির লোক, সার্বভৌমত্বের এক নিঃসঙ্গ কিন্তু অবিচল প্রতিনিধি। আজ তাঁকে তারা লাঞ্ছিত করেছে। তা করার আগে ওই পুলিশকে, ওই মন্ত্রীকে, ওই সরকারকে এবং কাল বেশিরভাগ পত্রিকায় মামুলিভাবে ছাপা হওয়া এই সংবাদটির সাংবাদিকরা কি তাদের সভ্যতার পোশাক, তাদের মানবিকতার শিক্ষা, তাদের দেশাত্মবোধের দায় সব খুলে অসভ্য, অমানবিক, বর্বর, গণবিরোধী এক সুবিধাবাদী কীট হয়ে যায়নি? যাচ্ছে না কি? এই কীটেরা আজ দেশকে খাবলে খাচ্ছে। জনতাকে ধোঁকা দিয়ে মার দিয়ে চুপ করিয়ে রাখছে।

দেশকে যুগের পর যুগ ধরে বিক্রি করে দিতে দিতে তারাও সব বিক্রি হয়ে গেছে। আশা মরলেই সুবিধাবাদ জন্মায়। তারা আশাহীন, তাই আত্মবিক্রয়ের সোনা সঞ্চয় করে চলেছে। তাদের সোনার ভোগে লাথি থথু ধিক। তবুও আমরা সব সয়ে যাই।

কারণ আরামের বিষ্ঠায়, ভয়ের গাদে আর লোভের পাপে আমরা এতদিনে কচ্ছপের মতো শক্ত খোল বানিয়ে নিয়েছি। বিপদ দেখলে তাতে ঢুকে পড়া রপ্ত করেছি। মাঝে মাঝে আরামে বা ব্যারামে তারা গলা বাড়ায় বটে, তবে ওটুকুই সার। দেশের মাটিতে তারা কেবলই অসার। ফুলবাড়ী-কানসাটের শহীদ কৃষকসন্তানরা মাঝে মাঝে এই খোলে আঘাত করেন, মাঝে মাঝে আনু মুহাম্মদরা এই খোলে মাথা ঠোকেন, কিন্তু কুম্ভের ঘুম ভাঙ্গে না।

আনু মুহাম্মদরা ভাঙ্গেন কিন্তু কদাচ মচকান না। আনু ভাই, আপনার এই অবমাননা ব্যক্তিগত নয়, জাতীয়। আপনার সঙ্গে আর যারা মার খেয়েছে তারাও এই দুষ্কালে অল্পকটি শিখা। এই শিখা নিভবে না, কারণ আঘাত আছে, কারণ দেশ ভেতরে ভেতরে জ্বলছে, কারণ ভদ্রলোকরা সুখে থাকলেই দেশের মানুষ সুখে থাকে না। এই অসহায়ত্ব এক মুহুর্তের জন্য ভুলি না।

তাই আমরা লড়ে যাই, কিছুটা বাঁচি কিছুটা মরি, পারলে মারি, আবারো লড়ি। এই আমাদের ব্রত এই আমাদের দগ্ধ ক্ষত।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।