আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের পুরোধা _কমরেড মনিসিংহ

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের পুরোধা _কমরেড মনিসিংহকমরেড মনিসিংহ। যে নামটির সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তিনি প্রবাদতুল্য বিপ্লবী কমরেড। তিনি উপমহাদেশের শোষণমুক্তি ও জাতীয় মুক্তিরসংগ্রামের অন্যতম পুরোধা।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পরাধীনতা থেকে স্বাধীন ভারত এবং পাকিস্থানের স্বৈর-শাসন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের মহানায়ক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ সাত দশক ধরে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের জন্য এবং মানুষের চুড়ান্ত মুক্তির লক্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কমরেড মনিসিংহের জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুল। কলকাতা শহরে। বাবা কালীকুমার সিংহ ছিলেন পূর্বধলার জমিদারের সন্তান।

তিনি বিয়ে করেন সুসং রাজবংশে। সেই সূত্রে কমরেড মনিসিংহ ছিলেন সুসং রাজবংশের ভাগ্নে। মনিসিংহের বয়স যখন আড়াই বছর তখন তাঁর বাবা মারা যায়। মা ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রোকোনা মহাকুমার সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার বংশের মেয়ে। তিনি সুসং-দুর্গাপুরে কিছু ভূ-সম্পত্তি, বার্ষিক খোরাকি ও শরীক হিসাবে মাসোহারা পান।

মনিসিংহের বয়স তখন ৭ বছর। সেই সময় থেকে তাঁরা সুসং-দুর্গাপুরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই মনিসিংহ প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু ও শেষ করেন। তারপর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। ওই সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ঘৃনা ও ক্ষোভ জমে যায় তাঁর চেতনায়।

তাই ১৯১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সাথে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে নিজের সাহস ও দৃঢতা দিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে দক্ষতার পুরিচয় দেন। ১৯২১ সালের আসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ব্যাপকতা তাঁকে এই সংগ্রামী মানুষে পরিনত করে। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য নিজ জেলায় কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। বঞ্চিত হাজং কৃষকদের সন্তানদের জন্য একাধিক স্থানে তিনি পাঠশালা তৈরী করে দেন।

১৯২৫ সালে রুশবিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী ও মার্ক্সবাদী বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে কমরেড মনিসিংহের সাক্ষাৎ হয়। দিনে দিনে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে মার্ক্সবাদী চেতনার সম্পর্ক। এ সময় তিনি মার্ক্সবাদ ও লেনিনবাদের রাজনীতি, দর্শন ও আদর্শে নিজেকে নির্মাণ করেন। ১৯২৬ সালের শেষের দিকে মনিসিংহ কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রীটের গুপ্ত ম্যানশনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ‘ওরিয়েন্টাল ট্রেডিং’ নাম দিয়ে একটি অফিস খুলেন। শ্রমিক আন্দোলনের উপায় খুঁজে বের করার জন্য এই প্রচেষ্ঠা।

এখানে দেখা হলো গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী, নীরোদ চক্রবর্তী, নলীন্দ্র সেনসহ আরো অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে। এ সময় তিনি প্রতিদিন কমরেড মুজাফফর আহমেদের হ্যারিসন রোডের অফিসে গিয়ে ‘গণবাণী’ পত্রিকা পড়তেন। ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে গোপেন চক্রবর্তী মনিসিংহকে জানালেন শ্রমিক আন্দোলনের সুবর্ণ সুযোগ এখন। কেসি মিত্র রেলওয়ে ধর্মঘট করেছেন। সেখানে কর্মী প্রয়োজন।

এসুযোগ গ্রহণ করতে হবে। পরদিন মনিসিংহ লিলুয়া রেলওয়ে গেলেন। মেটিয়াব্রুজের কেশোরাম টেক্সটাইল মিলে গিয়ে ধর্মঘটে আংশ নেন। সেখানেই শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলন। ১৯৩০ সালে মাস্টার দা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসক পাগলা কুকুরের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বিচারে গ্রেফতারের হিড়িক চালায়।

শত শত বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। ৯ মে কলকাতায় গ্রেফতার হন মনিসিংহ। টানা ৫ বছর বিভিন্ন জেল-ক্যাম্প ঘুরিয়ে এনে ১৯৩৫ সালে সুসাং-এ নিজ গ্রামের বাড়িতে নজরবন্দী করে তাঁকে রাখা হয়। এ সময় মাতুল বংশের সাথে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মনিসিংহের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তিনি সাধারণ প্রজাদের পক্ষে দাড়ান।

তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। যার কারণে মনিসিংহকে তিন বছরের কারাদণ্ডে যেতে হয়। আপিলে করলে এ সাজা দেড় বছর কমে আসে। ১৯৩৭ সালে তিনি মাকে দেখার জন্য সুসং-এ আসেন। তখন গ্রামের কৃষকেরা টঙ্কপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করছেন।

তারা এ আন্দোলনে মনিসিংহের কাছে সাহায্য চাইলেন। এ আন্দোলনে তিনি যোগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেন। ওই বছর নবেম্বর মাসে কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তাঁদের জমিদারী টঙ্কপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজ বংশ থেকে সম্পর্ক চ্যুৎ হন। দীর্ঘদিন এ আন্দোলন চলছিল।

১৯৪১ সালে এই আন্দোলনের কারণে মনিসিংহকে গ্রেফতার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ওই বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এই যুদ্ধেকালে কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘জনযুদ্ধের’ নীতি গ্রহণ করায় টঙ্ক আন্দোলন কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকে। ১৯৪৪ সালে মনিসিংহ সারা বাংলার কৃষাণসভার প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নিখিল ভারত কৃষাণ সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দক্ষ সংগঠকের পরিচয় দেন। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনে তিনি ময়মনসিংহ জেলার একটি আসন থেকে নির্বাচন করেন।

১৯৫০ সালে টঙ্কের পরিবর্তে ঢাকায় খাজনার নিয়ম চালু হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই টঙ্ক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ ৬০ মানুষ মারা যায়। এ সময় মনিসিংহ আত্মগোপনাবস্থায় ওই এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত টানা ২০ বছর তাঁকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়। এ সময় আইয়ুব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরুস্কার ঘোষণা করে।

১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকারের সময় মাত্র ১ মাস প্রকাশ্যে থাকতে পেরেছিলেন। ১৯৬৯ সালে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে স্বৈরাচার সকারের পুলিশ বাহিনী। এদের মধ্য কমরেড মনিসিংহ ছিলেন। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ ফেব্রুয়ারী সকলের সাথে তিনিও মুক্তি পান। ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড মনিসিংহের অবদান নিঃসন্দেহে অনিস্বীকার্য।

তাঁর প্রচেষ্ঠায় গড়ে উঠেছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী। যে বাহিনীই মূলত যুদ্ধের কৌশলী বাহিনী ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ে তিনিই মূল ব্য্যক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্ঠামণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তাঁর কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।

পাকিস্থানের পক্ষে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন মনিসিংহের দেশ বাংলাদেশের পক্ষে অষ্টম নৌবহর প্রেরণ করার প্রস্তুতি নিতে সে লেজগুটিয়ে পালায়। কমরেড মনিসিংহ ছিলেন পূর্ববঙ্গের সকলের প্রিয় বড় ভাই। ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯২৮ সাল থেকে পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে যান। ১৯৩৭ সালে তিনি পার্টির সদস্যপদ পান। ১৯৪২ সালে তিনি পার্টির ময়মনসিংহ জেলার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৪৩ সালে বোম্বেতে অনুষ্ঠিত পার্টির প্রথম সম্মেলনে পার্টির ময়মনসিংহ জেলা থেকে দু’জন অংশগ্রহণ করেন, তাঁর মধ্যে তিনি ছিলেন। ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় সম্মেলনে তিনি পূবপাকিস্থানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে অনুষ্ঠিত পার্টির তৃতীয় সম্মেলনে তিনি পুনরায় পূবপাকিস্থানের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। জেলে থাকা অবস্থায় পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ও ১৯৮০ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮৪ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৬ বছর অসুস্থ থাকার পর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর ৩১ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে মারা যান। জয়তু কমরেড মনিসিংহ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।